ইন্টারনেটের আসল আবিষ্কারক কে

ইন্টারনেট কে আবিষ্কার করেছেন? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া বেশ কঠিন। বৈদ্যুতিক বাতি বা টেলিফোনের আবিষ্কার হিসেবে যেমন শুধু একজনের নাম বলা যায় না, তেমনি ইন্টারনেটের ক্ষেত্রেও একজনের নাম বলা কঠিন। 

যেকোনো মহান আবিষ্কারের পেছনে অনেক মানুষের অবদান থাকে। ইন্টারনেটের গল্পটিও ঠিক সেরকম। এটি কোনো একজন ব্যক্তির সাধনার ফল নয়। অনেক বিজ্ঞানী ও ইঞ্জিনিয়ারের কয়েক দশকের সম্মিলিত চেষ্টার ফসল ইন্টারনেট। আজ আমরা যে ইন্টারনেট ব্যবহার করি, তার পেছনে আছেন অনেক কারিগর। চলুন, সেই গল্পটা শোনা যাক।

ইন্টারনেটের কথা উঠলেই যে নামটি সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয়, তিনি ব্রিটিশ কম্পিউটার বিজ্ঞানী স্যার টিম বার্নার্স লি। তবে তিনি কিন্তু পুরো ইন্টারনেট আবিষ্কার করেননি। তিনি আবিষ্কার করেছিলেন ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব। এটি বর্তমানের ইন্টারনেটের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ মাত্র।

ব্রিটিশ কম্পিউটার বিজ্ঞানী স্যার টিম বার্নার্স লি
সার্ন

১৯৮৯ সালের মার্চ মাসে তিনি এই ধারণাটি প্রস্তাব করেন। তখন তিনি সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় অবস্থিত ইউরোপীয় আণবিক গবেষণা সংস্থা সার্নে কর্মরত ছিলেন। তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীদের জন্য তথ্য আদান-প্রদান সহজ করা।

এই লক্ষ্যেই তিনি HTML, HTTP ও URL-এর মতো প্রযুক্তিগুলো তৈরি করেন। এগুলো আজও ওয়েবের ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে। তিনিই বিশ্বের প্রথম ওয়েব ব্রাউজার তৈরি করেন। ১৯৯০ সালের ২০ ডিসেম্বর তিনি বিশ্বের প্রথম ওয়েবসাইট info.cern.ch চালু করেন।

তবে বার্নার্স লি নিজেই স্বীকার করেছেন, তাঁর ব্যবহৃত হাইপারটেক্সট ও ইন্টারনেটের মতো বেশিরভাগ প্রযুক্তি আগে থেকেই আবিষ্কৃত হয়েছিল। তিনি শুধু সেগুলো সফলভাবে একত্রিত করে একটি নতুন রূপ দেন।

মজার ব্যাপার হলো, নিজের এই সৃষ্টি নিয়ে বার্নার্স-লি এখন বেশ চিন্তিত। তিনি মনে করেন, তাঁর আবিষ্কার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। ২০১৮ সালের ফেসবুক-কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা ডেটা কেলেঙ্কারির পর তিনি এই বিষয়টি উপলব্ধি করেন। তিনি দেখেন, ওয়েব এখন ভালো-মন্দ উভয় কাজেই ব্যবহৃত হচ্ছে। এটি ভুল তথ্য ছড়ানোর একটি বড় মাধ্যমে পরিণত হয়েছে।

ওয়েবের পেছনের কারিগরেরা

টিম বার্নার্স লি ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব তৈরি করেন। কিন্তু এর ভিত্তি তৈরি করেছিলেন অন্য বিজ্ঞানীরা। চলুন, তাঁদের কয়েকজনের কথা জেনে নিই।

জেসিআর লিকলাইডার

মার্কিন মনোবিজ্ঞানী ও কম্পিউটার বিজ্ঞানী জেসিআর লিকলাইডার
হিস্ট্রি অব ডোমেইনস

ইন্টারনেটের স্বপ্নদ্রষ্টা বলা হয় মার্কিন মনোবিজ্ঞানী ও কম্পিউটার বিজ্ঞানী জেসিআর লিকলাইডারকে। ১৯৬২ সালে তিনি ‘গ্যালাকটিক নেটওয়ার্ক’ নামে একটি ধারণা দেন। তিনি এমন এক বিশ্বব্যাপী নেটওয়ার্কের স্বপ্ন দেখেন, যেখানে সবাই যেকোনো জায়গা থেকে তথ্য ও প্রোগ্রাম ব্যবহার করতে পারবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তরের অ্যাডভান্সড রিসার্চ প্রজেক্টস এজেন্সি বা ডারপাতে কাজ করার সময় তিনি এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে যান।

লিওনার্ড ক্লেইনরক

মার্কিন কম্পিউটার বিজ্ঞানী লিওনার্ড ক্লেইনরক
গেটি ইমেজ

মার্কিন কম্পিউটার বিজ্ঞানী লিওনার্ড ক্লেইনরক ১৯৬১ সালে ‘প্যাকেট সুইচিং’ তত্ত্বের জন্ম দেন। এটি আধুনিক ইন্টারনেটের মূল ভিত্তি। তাঁর তত্ত্ব অনুসারে, তথ্যের ছোট ছোট ‘প্যাকেট’ পাঠিয়ে কম্পিউটারগুলো একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। এ বিষয়ে ১৯৬৪ সালে তিনি একটি বই প্রকাশ করেন। এই ধারণাই আধুনিক ইন্টারনেট ডেটা ট্রান্সফারের ভিত্তি।

পল ব্যারান

পল ব্যারান
হিস্ট্রি অব ডোমেইনস

পোলিশ-আমেরিকান ইঞ্জিনিয়ার পল ব্যারান একটি বিকেন্দ্রীভূত নেটওয়ার্কের প্রস্তাব দেন। মানে এর কোনো কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ বিন্দু থাকবে না। ১৯৬০-এর দশকে তিনি মার্কিন বিমান বাহিনীর জন্য এই ধারণাটি তৈরি করেন। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল, নেটওয়ার্কের কোনো অংশ শত্রুর আক্রমণে ধ্বংস হলেও বাকি অংশ সচল থাকবে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হবে না।

লরেন্স রবার্টস

মার্কিন বিজ্ঞানী লরেন্স রবার্টস
ইন্টারনেট হল অব ফেম

মার্কিন বিজ্ঞানী লরেন্স রবার্টস ডারপার প্রধান বিজ্ঞানী ছিলেন। তিনি ব্যারান ও ক্লেইনরকের ধারণাগুলোকে একত্রিত করেন। এর মাধ্যমে তিনি একটি কার্যকরী নেটওয়ার্ক তৈরি করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি প্রকাশ করেন ‘আরপানেট’ পরিকল্পনা। এই আরপানেটকেই ইন্টারনেটের পূর্বসূরি বলা হয়। ১৯৬৯ সালের ২৯ অক্টোবর এর মাধ্যমে প্রথম বার্তা আদান-প্রদান হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে এই যোগাযোগ সম্পন্ন হয়।

ভিন্ট সার্ফ ও রবার্ট কান

দুই মার্কিন কম্পিউটার বিজ্ঞানী ভিন্ট সার্ফ ও রবার্ট কান
নর্দার্ন ভার্জিনিয়া ম্যাগাজিন

এই দুজন মার্কিন কম্পিউটার বিজ্ঞানীকে ‘ইন্টারনেটের জনক’ বলা হয়। তাঁরা যৌথভাবে TCP/IP তৈরি করেন। এটি এক ধরনের সার্বজনীন নিয়ম বা ভাষা। এই ভাষা ব্যবহার করেই ভিন্ন ভিন্ন নেটওয়ার্কের কম্পিউটারগুলো একে অপরের সঙ্গে কথা বলে। এটি ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত হয়। ১৯৮৩ সালের ১ জানুয়ারি আরপানেট আনুষ্ঠানিকভাবে TCP/IP ব্যবহার শুরু করে। এই দিনটিকেই অনেকে ইন্টারনেটের জন্মদিন হিসেবে পালন করেন।

সুতরাং, দেখা যাচ্ছে, ইন্টারনেট কোনো একজন ব্যক্তির একক আবিষ্কার নয়। এটি কয়েক দশক ধরে বহু মেধাবী মানুষের স্বপ্ন, শ্রম এবং সহযোগিতার এক সম্মিলিত ফল।

সূত্র: বিবিসি সায়েন্স ফোকাস