সাক্ষাৎকার
আমি চাই, সবাই বুঝুক, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আসলে জাদু না— রুম্মান চৌধুরী, সিইও এবং সহপ্রতিষ্ঠাতা, হিউম্যান ইন্টেলিজেন্স
বিশ্বখ্যাত সাময়িকী টাইম প্রকাশিত ‘টাইম ১০০ এআই’ তালিকায় স্থান পেয়েছেন বাংলাদেশি বিজ্ঞানী রুম্মান চৌধুরী। তিনি ডাটা সায়েন্টিস্ট ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর প্রযুক্তি রিভিউ প্রতিষ্ঠান হিউম্যান ইন্টেলিজেন্স-এর সিইও এবং সহপ্রতিষ্ঠাতা। এর আগে তিনি টুইটারের মেশিন লার্নিং ইথিকস (নৈতিকতা) দলের প্রধান হিসেবে কাজ করেছেন। টাইম ম্যাগাজিনকে দেওয়া তাঁর এ সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার, সৃষ্ট শঙ্কা, নৈতিকতা ও পৃথিবীর অর্থনৈতিক কাঠামোয় এর ভূমিকাসহ নানা বিষয়। সাক্ষাৎকারটি বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য অনূদিত হলো।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রেখেছেন, এমন ১০০ ব্যক্তির তালিকা প্রকাশ করেছে বিশ্বখ্যাত সাময়িকী টাইম। গত সেপ্টেম্বর ২০২৩-এর শুরুর দিকে ‘টাইম ১০০ এআই’ নামের এ তালিকা প্রকাশ করে তারা। এআইয়ের অগ্রগতির জন্য কাজ করছেন, নৈতিকতা প্রসঙ্গে এআই নিয়ে প্রশ্ন ছুড়ছেন এবং সমাজের বিভিন্ন সমস্যা মোকাবিলায় এআই ব্যবহার করছেন—এই তিন ধরনের মানুষই এতে স্থান পেয়েছেন। এ তালিকায় রয়েছেন এআইয়ের কঠোর সমালোচক, বিজ্ঞানী, লেখক, শিল্পী, এআইয়ের পক্ষে অবস্থান নেওয়া ব্যক্তি এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা। এ তালিকার প্রায় সবার সাক্ষাৎকার নিয়েছে টাইম।
এ তালিকায় স্থান পেয়েছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত রুম্মান চৌধুরী। তিনি ডাটা সায়েন্টিস্ট ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর প্রযুক্তি রিভিউ প্রতিষ্ঠান হিউম্যান ইন্টেলিজেন্স-এর সিইও এবং সহপ্রতিষ্ঠাতা। এর আগে তিনি টুইটারের মেশিন লার্নিং ইথিকস (নৈতিকতা) দলের প্রধান হিসেবে কাজ করেছেন।
২০১৭ সালে বিবিসির ১০০ উইম্যান তালিকায় স্থান পেয়েছিলেন তিনি। ২০১৮ সালে ফোর্বস তাঁকে ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার রূপদানকারী পাঁচজনের একজন’ হিসাবে উল্লেখ করে। বিজ জার্নাল তাঁকে নিজ ক্ষেত্রে অনূর্ধ্ব ৪০-এর একজন হিসেবে তুলে ধরে। অর্থাৎ ৪০-এর কম বয়সেই তিনি নিজ ক্ষেত্রের সেরা বলে বিবেচিত হন তাদের কাছে।
তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্ভাবনার দুয়ার যেমন খুলে দিয়েছে, তেমনি তৈরি করেছে শঙ্কাও। বিষয়টা দারুণভাবে ফুটে উঠেছে টাইম সাময়িকীকে দেওয়া রুম্মান চৌধুরীর সাক্ষাৎকারে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার, সৃষ্ট শঙ্কা, নৈতিকতা ও পৃথিবীর অর্থনৈতিক কাঠামোয় এর ভূমিকাসহ নানা বিষয় উঠে এসেছে এ আলোচনায়। টাইম জানিয়েছে, সাক্ষাৎকারটি সংক্ষিপ্ত ও পরিমার্জিত আকারেই প্রকাশ করেছে তারা।
‘টাইম ১০০ এআই’ তালিকাটি আগে অনলাইনে প্রকাশিত হলেও ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হলো সদ্যই। এই ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে স্থান পেয়েছেন রুম্মান চৌধুরী। বিষয়টি আমাদের জন্য যেমন অনুপ্রেরণার, তেমনি তাঁর এ সাক্ষাৎকার বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের চিন্তার খোরাক যোগাবে। তাই সাক্ষাৎকারটি বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য অনূদিত হলো।
প্রশ্ন :
টাইম: বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, এ নিয়ে আপনার সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা কী?
রুম্মান চৌধুরী: এটা ক্ষমতার কেন্দ্রায়নের গতি বাড়িয়ে দিয়েছে এবং খুব অল্প কিছু মানুষের হাতে গড়ে উঠছে সম্পদের পাহাড়। প্রথমত, এটা নির্দিষ্ট কিছু শিল্প সরাসরি ধ্বংস করে দিচ্ছে, শেষ করে দিচ্ছে কিছু মানুষের জীবীকা। দ্বিতীয়ত, এই মানুষগুলো মোটেও বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষের চাহিদা, ইচ্ছা, দৃষ্টিভঙ্গি বা মতামতের প্রতিনিধিত্ব করে না। অথচ তারা ঠিকই তাদের প্রযুক্তি গোটা বিশ্বের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। আমরা পৃথিবীকে বিনা মূল্যে যেসব জিনিস দিচ্ছি, তাদের সম্পদ সেগুলোর ওপর নির্ভর করেই গড়ে উঠছে। যেমন আমরা রেডিটে যা পোস্ট করছি, আমাদের যেসব ছবি ইন্টারনেটে আছে, বন্ধুদের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমাদের যে কথোপকথন হচ্ছে, যেসব বইয়ের রিভিউ আমরা অনলাইনে পোস্ট করছি—তারা আক্ষরিক অর্থেই এই সব, যা কিছু আমরা বিনা মূল্যে ইন্টারনেটে দিয়েছি, আমাদের যে অবদান—সব সেঁচে নিয়ে নিয়েছে একটা নতুন ও মজার কিছু বানানোর জন্য। এ থেকে তারা যে আউটপুট দিচ্ছে, সেখান থেকে তারা অর্থোপার্জন করছে আমাদের কাছেই ওটা বিক্রি করে, আমাদের থেকেই ফি নিচ্ছে তারা এ জন্য। আর এসব করতে গিয়ে তারা অনেক মানুষের জীবীকা শেষ করে দিচ্ছে, কেড়ে নিচ্ছে মুখের গ্রাস।
প্রশ্ন :
টাইম: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যাপারে কোন জিনিসটা আরও বেশি মানুষ বুঝুক বলে আপনি চান?
রুম্মান চৌধুরী: আমি চাই, সবাই বুঝুক, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আসলে জাদু না। এটা গণিত, কোডে বসানো গণিত। এখানে প্রথম কথা হলো, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাবিষয়ক যেসব ইস্যু বা বিষয় উঠে এসেছে, তার প্রায় সব অতীতে অন্য কোনো না কোনোভাবে ঠিকই করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ মনে করে প্রোগ্রামার বা এআই ডেভেলপাররা যেন জাদু জানেন। যেন তাঁদের হাতে অনন্য ধরনের ক্ষমতা আছে, যেন তাঁরা আর সবার চেয়ে স্মার্ট। এই বিষয়টা একদমই সত্যি নয়। কিন্তু এই ক্ষেত্রের মানুষেরা এ কথাটা বারবার বলেন, ছড়িয়ে দিতে চান। এই মানুষগুলো নিজেদের বানানো প্রযুক্তিকে ঘিরে একধরনের রহস্য বজায় রাখতে চান। উদ্দেশ্য একটাই, অন্যদের সরিয়ে রাখা ও ব্যবহার করা। তৃতীয় বিষয়টি হলো, মানুষ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সমালোচনা করতে, একে প্রশ্ন করতে বা এটা আসলেই ঠিকভাবে কাজ করছে কি না, তা জিজ্ঞাসা করতে কেমন যেন ভয় পায়। এমনকি অনেকে তো মনে করেন, কোনো বিষয়ের বিশেষজ্ঞের চেয়েও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ভালো সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
প্রশ্ন :
টাইম: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কোন ব্যাপারে অনেক বিশেষজ্ঞও ভুল করেন?
রুম্মান চৌধুরী: সেন্টিয়েন্ট (বুদ্ধিমান) কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ধারণা। অনেক মানুষ, এমনকি বিশেষজ্ঞরাও চ্যাট ফাংশনালিটি নকল করার বিষয়টিকে কীভাবে সেন্টিয়েন্টের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন, এটা দেখে আমি আসলেই বিষ্মিত হই। খুব স্বাভাবিক ও সহজে ব্যবহার্য একটি চ্যাট ইন্টারফেস—যেটা তুলনামূলক স্বাদু লেখা লিখতে পারে, এতে একদম ডুবে গিয়ে এত সহজে বোকা বনে যাওয়াও সম্ভব! মানুষের মধ্যে চেতনা কীভাবে আসে, আমরা তো সেটা এখনো বুঝতেই পারিনি (এ জিনিস নকল করার মতো কোড করা তো অনেক দূরের কথা)!