কোয়ান্টাম কম্পিউটারের জগতে

১৯৯৪ সালের কথা। কোয়ান্টাম কম্পিউটার তখনো খাতা-কলমের তাত্ত্বিক জগতের ঘেরাটোপে বন্দী। বিজ্ঞানীদের চিন্তায় দারুণ এক সম্ভাবনা হিসেবে এটি কেবল উঁকি দিচ্ছে। এ রকম সময় গণিতবিদ পিটার শোর ফ্যাক্টরিংয়ের ওপর নির্ভর করে একটা অ্যালগরিদম আবিষ্কার করেন। ফ্যাক্টর মানে উৎপাদক। একজন গণিতবিদ ফ্যাক্টরিং নিয়ে কাজ করবেন, সেটাই স্বাভাবিক। গণিতজ্ঞরা ছাড়া এ নিয়ে আর কারও চিন্তা (বা দুশ্চিন্তা) করার কোনো কারণ নেই।

কিন্তু শোরের অ্যালগরিদম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জগৎকে কিছুদিনের মধ্যেই একদম নাড়িয়ে দিয়েছিল। প্রযুক্তিজগতের সবাই অবাক বিস্ময়ে আবিষ্কার করলেন, এই অ্যালগরিদম ব্যবহার করে পুরো ইন্টারনেটের জগৎকে মুঠোয় পুরে ফেলা সম্ভব! দুর্ভেদ্য কোনো কিছুর ভয়ংকর দুর্বলতাকে প্রকাশের জন্য ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে। অ্যাকিলিস হিল।

হোমারের বিখ্যাত মহাকাব্য ইলিয়াড–এ বীর অ্যাকিলিস ট্রয়ের যুদ্ধে অংশ নেন। তার মা থেটিস তাকে শিশুকালে স্টিক্স নদীতে গোসল করিয়েছিলেন। জাদুর এই নদীর পানি মানুষকে অমরত্ব দিতে পারে। কিন্তু নদীতে গোসল করানোর সময় থেটিস অ্যাকিলিসের গোড়ালি ধরেছিলেন। সে জন্য তার গোড়ালির খানিকটা অংশ শুকনো থেকে যায়। এটিই ছিল অ্যাকিলিসের দুর্বলতা। সেই দুর্বলতা জেনে ফেলে প্রতিপক্ষ। গোড়ালিতে তিরের আঘাতে মারা যান বীর অ্যাকিলিস।

শোরের অ্যালগরিদম ইন্টারনেট জগতের জন্য অ্যাকিলিস হিল হয়ে এল। খুব দ্রুত কাজ করতে পারে, এ রকম কোনো কম্পিউটারে কেউ যদি এই অ্যালগরিদম রান করে, তাহলে ভেঙে ফেলা যাবে শক্তিশালী প্রায় সব এনক্রিপশন। খোলা বইয়ের মতো পড়ে ফেলা যাবে মানুষের গোপনীয় সব তথ্য।

শোরের কাছে এ রকম কোনো কম্পিউটার ছিল না। তিনি শুধু একটা হাইপোথেটিক্যাল যন্ত্রের জন্য অ্যালগরিদম লিখছিলেন। হাইপোথেটিক্যাল কথাটার বাংলা প্রকল্প। তবে এটা শুনে কিছু সেভাবে বোঝা যায় না। হাইপোথেটিক্যাল বলতে বোঝায়, সম্ভাবনাময় কল্পনা। সম্ভাবনাময় কাল্পনিক যে যন্ত্রের জন্য শোর অ্যালগরিদম লিখেছিলেন, তার নাম কোয়ান্টাম কম্পিউটার। ১৯৯৪ সালের সেই পেপার, মানে গবেষণাপত্রে তিনি লিখেছিলেন, ‘কোয়ান্টাম বলবিদ্যা ব্যবহার করে কম্পিউটারের হিসাব-নিকাশের ক্ষমতা বাড়িয়ে ফেলা সম্ভব কি না, এই প্রশ্নের কোনো সন্তোষজনক জবাব কারও জানা নেই।’ শোরের সেই প্রশ্নের জবাব এখন ধীরে ধীরে আসতে শুরু করেছে।

গত বছর গুগলের জন মার্টিনিস ও সার্জিও বোইজো তাঁদের ব্লগে লিখেছেন, ‘আমাদের হিসাব অনুযায়ী যে হিসাব-নিকাশ করতে পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুতগতির সুপারকম্পিউটারের ১০ হাজার বছর লেগে যাওয়ার কথা, আমাদের যন্ত্র সেটা ২০০ সেকেন্ডের মধ্যেই করে ফেলেছে।’ এটা করা সম্ভব হয়েছে ‘কোয়ান্টাম সুপ্রিমেসি’র বাস্তব প্রয়োগের জন্য। এদিকে গত মাসে (নভেম্বর ২০২০) প্যান জিয়ানওয়েইর নেতৃত্বে চীনের ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (ইউএসটিসি) একদল বিজ্ঞানী তাঁদের কোয়ান্টাম কম্পিউটারে সাধারণ কম্পিউটারের চেয়ে ১০০ ট্রিলিয়ন গুণ দ্রুত একটি হিসাব সফলভাবে সম্পন্ন করার কথা জানিয়েছেন। চীনের সরকারি সংবাদমাধ্যম জানহুয়ার তথ্যমতে, এটি গুগলের কম্পিউটারের চেয়ে ১০ বিলিয়ন গুণ দ্রুত কাজ করতে পারে। তাঁদের গবেষণাপত্রটি সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।

গবেষণাগারে করা এসব হিসাব-নিকাশ অবশ্য বাস্তবে কোনো কাজে লাগবে না। শোরের অ্যালগরিদম বাস্তবে প্রয়োগের মতো কম্পিউটার এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। তবে গুগল, আইবিএম, আমাজনের পাশাপাশি বিভিন্ন স্টার্টআপ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত বিজ্ঞানীরা বাস্তবে কাজে লাগবে, এ রকম কোয়ান্টাম কম্পিউটার উদ্ভাবনের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এসব কোম্পানি ও বিভিন্ন দেশের সরকার কোয়ান্টাম কম্পিউটার উদ্ভাবনের জন্য প্রতিবছর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে। জানা গেছে, চীন প্রতিবছর ১০ বিলিয়ন ডলারের মতো বিনিয়োগ করে একটা সফল কোয়ান্টাম কম্পিউটিং ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স গবেষণাগার বানানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রও বিলিয়নখানেক ডলারের মতো বিনিয়োগ করেছে। আবার আইবিএম ও গুগলের মতো কোম্পানিগুলোর প্রতিটা ১০০ মিলিয়নের বেশি বিনিয়োগ করতেও ইতস্তত করছে না। কারণ, কোয়ান্টাম কম্পিউটার যে শুধু কম্পিউটার প্রযুক্তি ও ইন্টারনেটকে বদলে দেবে, তা–ই নয়, এটি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, মানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তিকেও এগিয়ে নেবে অনেক গুণ।

আর যে মুহূর্তে কোয়ান্টাম কম্পিউটার বাস্তব হয়ে উঠবে, সঙ্গে সঙ্গে ধসে পড়বে প্রচলিত সব এনক্রিপশন। আমাদের ই–মেইল থেকে শুরু করে ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড—সবকিছুর পেছনের নিরাপত্তাব্যবস্থা অর্থহীন হয়ে যাবে চোখের পলকে।

শোরের অ্যালগরিদম ও কোয়ান্টাম কম্পিউটার হতে পারে প্রযুক্তির জন্য আশীর্বাদ ও সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের জ্বালানি। একই সঙ্গে এটি হতে পারে তথ্যনির্ভর আধুনিক জীবনযাত্রার জন্য ভয়ংকর এক হুমকি। কথা হলো, সম্ভাবনাময় এই কল্পনা বাস্তবতা হয়ে ওঠার পথে কত দূর এগিয়েছে?

বর্তমানে কম্পিউটার চলে ‘বিট’ দিয়ে। বিট কথাটা এসেছে ‘বাইনারি ডিজিট’ থেকে। এটিকে বলা যায় তথ্যের একক। প্রতিটি বিটকে একটা সুইচের মতো কল্পনা করা যেতে পারে। এর মান হতে পারে ০ বা ১। বৈদ্যুতিক সিগন্যালের জন্য ০ কে ‘অফ’ বা অচলাবস্থা কিংবা যেকোনো প্রশ্নের ‘না-বোধক’ উত্তর বলে ধরা হয়। আর ১ মানে ‘অন’ বা ‘হ্যাঁ-বোধক’ উত্তর।

কম্পিউটার যে ভাষা বোঝে, সেই ভাষা বিট দিয়ে লেখা। অনেকগুলো বিট পাশাপাশি বসে এর স্থানাঙ্কের ওপর নির্ভর করে গণিতের বিভিন্ন জটিল হিসাব বা আমাদের ব্যবহৃত ভাষার (যেমন ইংরেজি) শব্দ, বাক্য ইত্যাদিকে বোঝাতে পারে। যেমন ‘Bigganchinta’–এর বাইনারি হচ্ছে 01000010 01101001 01100111 01100111 01100001 01101110 01100011 01101000 01101001 01101110 01110100 01100001।

কোয়ান্টাম কম্পিউটার বিটের বদলে তথ্যের একক হিসেবে ব্যবহার করে কিউবিট। প্রতিটি কিউবিট আসলে একটা পরমাণু বা অতিপারমাণবিক কণা। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অদ্ভুতুড়ে নিয়ম ব্যবহার করে তথ্য জমা রাখে। এর মান একই সঙ্গে ০ বা ১ কিংবা এর মধ্যকার যেকোনো কিছু (যেমন ০.২) হতে পারে। এই যে একই সঙ্গে সব ধরনের মান হতে পারে, একে বলা হয় ‘সুপারপজিশন’। তার ওপর এই কিউবিটরা একে অন্যের সঙ্গে ‘এনট্যাঙ্গেলড’ অবস্থায় থাকতে পারে। আসলে এর মধ্যে কোন মানটা আছে, সেটা বোঝার জন্য ব্যবহার করতে হয় পরিসংখ্যান। একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা ভালো বোঝা যাবে।

উদাহরণে যাওয়ার আগে এনট্যাঙ্গেলড কী, তা একটু বোঝার চেষ্টা করা যাক। অতিসরলীকরণ করে বললে এর সহজ উদাহরণ হলো, দুই পায়ের একজোড়া মোজা। দুই পায়ের দুটো মোজাকে একটা বাক্সে রেখে দেওয়া হয়েছে। দুজন মানুষকে বাক্সের সামনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হলো। এবার বাতি নিভিয়ে দিয়ে তাদের বলা হলো, প্রত্যেককে একটা করে মোজা তুলতে হবে। তোলার পর মোজা দুটোর রং দেখতে না দিয়ে, মোজা পকেটে ঢুকিয়ে তাদের একজনকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো রংপুর। আরেকজনকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো কারওয়ান বাজার। এখন যতক্ষণ তারা মোজা দুটো দেখবে না; ততক্ষণ আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারব না, কার পকেটে কোন পায়ের মোজাটা আছে। অর্থাৎ মোজা দুটো আছে এনট্যাঙ্গেলড অবস্থায়।

যে মুহূর্তে রংপুরের মানুষটি তার পকেট থেকে মোজা বের করে দেখবে সেটা ডান পায়ের; সেই মুহূর্তেই কারওয়ান বাজারের মানুষটির পকেটের মোজা হয়ে যাবে বাঁ পায়ের। এই যে এত দূরে থাকার পরও রংপুরের মানুষটির পকেটে কোন পায়ের মোজা আছে, তা জানার মাধ্যমে কারওয়ান বাজারের মানুষটির পকেটে কোন মোজাটা আছে, তা বের করে ফেলা যায়; এর মানে এখানে তথ্যের আদান-প্রদান হচ্ছে। ভিন্নভাবে বললে শুধু একটি মোজাকে নিয়ে হিসাব করে মোজাটির বৈশিষ্ট্য কী, তা বের করা যাবে না। দুটো মোজা মিলে তৈরি পুরো ‘মোজা-ব্যবস্থা’কে একসঙ্গে হিসাবে ধরতে হবে। আসলে পুরো উদাহরণটা দেওয়া হয়েছে অতিসরলীকরণ করে। বাস্তবে হিসাবটা আরও জটিল। তবে অতিপারমাণবিক কণাগুলোর কোয়ান্টাম জগৎ যেহেতু আমাদের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা থেকে একেবারেই আলাদা, সে জন্য আমাদের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা থেকে এগুলোকে বোঝার চেষ্টা করলে এ রকম অতিসরলীকরণ না করে উপায় নেই। স্বয়ং আইনস্টাইন একে বলেছিলেন, ‘স্পুকি অ্যাকশন অ্যাট আ ডিসট্যান্স’। মানে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার ভাষায় বললে, এনট্যাঙ্গেলড থাকা সব কটি কণার ভরবেগ, অবস্থান, স্পিন ইত্যাদিকে একসঙ্গে একটা সিস্টেম বা ব্যবস্থা ধরে হিসাব করতে হবে। E = mc2 বলে, শক্তিকে ভরে ও ভরকে শক্তিতে রূপান্তর করা যায়। শক্তি ভরে রূপান্তর হওয়ার সময় কখনো একটি কণা উৎপন্ন হয় না। দুটো কণা উৎপন্ন হয়। উৎপন্ন এ রকম দুটো কণার মোট স্পিন হবে শূন্য। অর্থাৎ একটির স্পিন যদি হয় ঘড়ির কাঁটার দিকে, আরেকটির হবে ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে। মানে কণা দুটো এনট্যাঙ্গেলড অবস্থায় আছে। আগের উদাহরণটায় মোজার জায়গায় কণা বসিয়ে চিন্তা করলে এনট্যাঙ্গেলমেন্ট ব্যাপারটা কিছুটা হয়তো বোঝা যাবে।

বর্তমানে কম্পিউটার চলে ‘বিট’ দিয়ে। বিট কথাটা এসেছে ‘বাইনারি ডিজিট’ থেকে। এটিকে বলা যায় তথ্যের একক। প্রতিটি বিটকে একটা সুইচের মতো কল্পনা করা যেতে পারে। এর মান হতে পারে ০ বা ১। বৈদ্যুতিক সিগন্যালের জন্য ০ কে ‘অফ’ বা অচলাবস্থা কিংবা যেকোনো প্রশ্নের ‘না-বোধক’ উত্তর বলে ধরা হয়। আর ১ মানে ‘অন’ বা ‘হ্যাঁ-বোধক’ উত্তর।

এখন সুপারপজিশনে থাকা এসব এনট্যাঙ্গেলড কণার মান কী, সেটা বোঝার জন্য পরিসংখ্যান কীভাবে ব্যবহার করা হয়, তা দেখা যাক। ধরি, দুটো কণা বা কিউবিট সুপারপজিশনে আছে। প্রতিটার স্পিন আবার +১/২ অথবা -১/২ হতে পারে। অর্থাৎ এর চারটি অবস্থা হতে পারে (দুটি কণা, প্রতিটার সম্ভাব্য ২ ধরনের স্পিন)। তাহলে এর চারটা স্টেট বা অবস্থা হবে ০০, ০১, ১০, ১১।

যারা বাইনারি গণিত জানে, তারা এটা ভালো বুঝবে। না জানলে একটা জিনিস মনে রাখলেই হবে। বাইনারি ০০ মানে ০ (দশভিত্তিক সংখ্যা ব্যবস্থা অনুযায়ী), ০১ মানে ১, ১০ মানে ২ আর ১১ মানে ৩। এখানে আসলে ০ থেকে ৩–এর যেকোনোটার থাকার সম্ভাবনাই ২৫%। এখন কেউ যদি এই কম্পিউটারকে আমার অনুপস্থিতিতে ০-৩–এর যেকোনো একটা সংখ্যা বলে যায়; এর মধ্যে কোনটা আছে, সেটা আমি বুঝব কীভাবে?

কম্পিউটারকে জিজ্ঞাসা করলে সে একবার বলবে ২, একবার বলবে ১, আবার বলবে ৩ ইত্যাদি। কিন্তু কম্পিউটারকে ১ লাখবার জিজ্ঞাসা করা হলে দেখা যাবে, যেকোনো একটি সংখ্যা সে অন্যগুলোর তুলনায় অনেক বেশি বলেছে। ধরা যাক, সে ২–এর কথা বলেছে প্রায় ৫৭ হাজারবার। আর বাকি ৩টার কথা বলেছে গড়ে ১৪ হাজারবার। এই পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যাবে, কিউবিট ২টায় আসলে ২ আছে।

জন মার্টিনিস সেই ১৯৮০ সালে কোয়ান্টাম কম্পিউটার নিয়ে কাজ শুরু করেন। সে সময় ‘কিউবিট’ শব্দটা আবিষ্কার পর্যন্ত হয়নি। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ায় তাঁর কাজের বিষয়বস্তু ছিল ফোটন বা অন্য কোনো অতিপারমাণবিক কণা থেকে তথ্য কীভাবে বের করে আনা যায়। কিন্তু এ রকম অতিক্ষুদ্র কিছু নিয়ে কাজ করাটা প্রায় দুঃসাধ্য। কারণ, এটা করতে হলে একদিকে সুপারপজিশন ও এনট্যাঙ্গেলমেন্ট যেমন ধরে রাখতে হবে, তেমনি কণাগুলো যেন খানিকটা আলাদা থাকে, নিজেদের অস্তিত্ব বিলীন করে না দেয়, তা–ও নিশ্চিত করতে হবে। সমস্যাটা হচ্ছে, এগুলোকে বেশি আলাদা করে ফেললে এগুলো এনট্যাঙ্গেলড থাকে না। সহজ করে বললে, হিসাব–নিকাশের জন্য এগুলোর নিজেদের মধ্যে যে যোগাযোগ রাখতে হয়, সেটা ভেঙে পড়ে।

বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কিউবিটগুলোকে কথা শোনানোর চেষ্টা করেছেন মার্টিনিস। এর মধ্যেই তিনি যোগ দিয়েছেন গুগলে। সেখানে তিনি কাজ করেছেন সিকামোরে। ৫৪ কিউবিটের এই কম্পিউটারই (পড়ুন, প্রসেসর) ওপরে আলোচিত সেই অসাধ্য সাধন করেছে। ১০ হাজার বছরের হিসাব করে ফেলেছে মাত্র ২০০ সেকেন্ডে।

ক্যালিফোর্নিয়ার গোলেটায় একটি চেম্বারের মধ্যে রাখা আছে ৫৪টি কিউবিট। পরম শূন্য তাপমাত্রার ১ ডিগ্রির মধ্যে নামিয়ে আনা হয়েছে এগুলোর তাপমাত্রা। এর মান শূন্য ডিগ্রি ফারেনহাইটের ৫০০ ডিগ্রিরও নিচে, যা আসলে সম্ভাব্য সর্বনিম্ন তাপমাত্রা।

কম্পিউটারকে কথা শোনানো বা নির্দেশ দেওয়ার উপায় হচ্ছে প্রোগ্রামিং। সিকামোরের কিউবিটগুলোকে নির্দেশ দেওয়ার জন্য মৃদু মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গ চেম্বারে ছুড়ে দেওয়া হয়। এই তরঙ্গ কিউবিটগুলোকে আন্দোলিত করে, ফিসফিস করে বলে দেয় কী করতে হবে।

আগেই বলেছি, এর সবচেয়ে বড় সমস্যাটা হচ্ছে, কিউবিটগুলোকে খানিকটা আলাদা রেখে এনট্যাঙ্গেলমেন্ট ও সুপারপজিশন টিকিয়ে রাখা। সামান্য ডিস্টার্ব হলেও এগুলোর সুপারপজিশন ও এনট্যাঙ্গেলমেন্ট ভেঙে যায়। যে কণার মান সুপারপজিশনে ছিল ০ ও ১ এবং এর মধ্যকার সবকিছু, তা ০ কিংবা ১-এ পরিণত হয়। ভেঙে যায় এগুলোর মধ্যকার যোগাযোগ বা এনট্যাঙ্গেলমেন্ট। ফলে যে হিসাব করা হচ্ছিল, তা নষ্ট হয়ে যায়।

এর ফলে আরেকটা বড় সমস্যা বা হেঁয়ালির সৃষ্টি হয়। কোয়ান্টাম কম্পিউটারকে যদি এমন কোনো জটিল সমস্যার সমাধান করতে বলা হয়, যা করতে সাধারণ কম্পিউটারের হাজার বছরের বেশি লেগে যাবে, তাহলে কোয়ান্টাম কম্পিউটার সঠিক ফলাফল দিচ্ছে কি না, সেটা বোঝার উপায় কী? এর সহজ উত্তর হলো, শোরের অ্যালগরিদম ব্যবহার করে কোয়ান্টাম কম্পিউটারে একটা মেসেজ ইনপুট দেওয়া। আউটপুটে যদি সেই মেসেজটা পড়া যায়, তাহলেই বোঝা যাবে কম্পিউটার কাজ করছে। সমস্যা হলো, এখন পর্যন্ত তৈরি ‘শিশু-কোয়ান্টাম-কম্পিউটার’গুলো শোরের অ্যালগরিদম নিয়ে কাজ করতে পারে না।

এই সমস্যা সমাধান করেন অ্যারনসন ও তাঁর দল। বোসন স্যাম্পলিংয়ের একটি আইডিয়া দেন তাঁরা। ফোটনের মতো বলবাহী বোসন কণারা কোনো বাধার গায়ে ধাক্কা খাওয়ার পর কী রকম আচরণ করবে, এ পদ্ধতিতে তা অনুমান করতে হয়। সাধারণ সুপারকম্পিউটারের জন্যও এই সমস্যার সমাধান করা বেশ কঠিন। কারণ, এতে কোয়ান্টাম বলবিদ্যানির্ভর প্রচুর হিসাব-নিকাশ কষতে হয়। বলা বাহুল্য, কোয়ান্টাম কম্পিউটারের জন্য কাজটা খুবই সহজ। অ্যারনসন ও তাঁর দল শুধু পরীক্ষণের আইডিয়া দিয়েই ক্ষান্ত হননি, ফলাফলটা সঠিক কি না, সেটা পরিসংখ্যানের ওপর ভিত্তি করে কীভাবে যাচাই করে দেখা যায়, তা–ও বের করেছেন।

গুগল ও ইউএসটিসি—দুটি গবেষণাগারেই অ্যারনসনের এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। ইউএসটিসি তো জিউঝ্যাং নামে ৭৬ কিউবিটের আস্ত একটি প্রোটোটাইপ কোয়ান্টাম কম্পিউটারই বানিয়ে ফেলেছে বোসন স্যাম্পলিংয়ের জন্য! এ ক্ষেত্রে তারা কিউবিট হিসেবে ব্যবহার করছে ফোটন। এতে বেশ কিছু বাধা ও আয়না বসানো একটি পথের মধ্য দিয়ে লেজার রশ্মি হিসেবে ফোটনকে ছুড়ে দেওয়া হয়। শুনেই বোঝা যাচ্ছে, যেকোনো ধরনের কাজ করার জন্য এটি বানানো হয়নি। বরং পথে বাধার মুখে পড়লে বোসন কণারা কী রকম আচরণ করে, এই সুনির্দিষ্ট সমস্যা সমাধানের জন্যই এটি বানানো হয়েছে।

জিউঝ্যাংয়ে করা পরীক্ষণ সফল হয়েছে। জানা গেছে, ফোটনকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং এটি ব্যবহার করে কোয়ান্টাম হিসাব-নিকাশ করা সম্ভব।

এদিকে গুগলও অ্যারনসনের পদ্ধতি সফলভাবে প্রয়োগ করতে পেরেছে। এতে প্রশংসা যেমন জুটেছে, তেমনি জুটেছে সমালোচনা। কারণ, এসব কোয়ান্টাম কম্পিউটার কাজ করতে পারে ঠিকই, কিন্তু এগুলো নির্দিষ্ট এই কাজ ছাড়া আর কিছু কতটা সঠিকভাবে করে, সেটা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। সেই হেঁয়ালিটা তাই ওভাবেই রয়ে গেছে আজও। কোয়ান্টাম কম্পিউটার যে সমস্যা সমাধান করবে, তা যে সঠিক সমাধান, সেটা বোঝার উপায় কী?

সত্যিকার কর্মক্ষম কোয়ান্টাম কম্পিউটার বানাতে হলে হাজার হাজার কিউবিটযুক্ত প্রসেসর বানাতে হবে। সেগুলো হিসাবে কী পরিমাণ ভুল করছে, এই ভুল ঠিক করে নেওয়ার উপায় কী ইত্যাদি বের করে নিতে হবে প্রকৌশলীদের। তারপরই কেবল এ ধরনের কম্পিউটার ব্যবহার করা যাবে চিকিৎসাক্ষেত্রে, ওষুধ প্রস্তুত করার জন্য প্রয়োজনীয় সিমুলেশন তৈরিতে কিংবা শোরের অ্যালগরিদম ব্যবহার করে ভেঙে ফেলা যাবে যেকোনো এনক্রিপশন। তবে অ্যারনসনের মতো অভিজ্ঞ গবেষকেরা মনে করেন, আগামী এক যুগের মধ্যে এ রকম কিছু করা সম্ভব হবে না।

প্রশ্ন হলো, এ নিয়ে তাহলে এত চিন্তার কী আছে। উত্তরটা আগেই বলেছি। চীন, যুক্তরাষ্ট্র যেমন সরকারিভাবে কোয়ান্টাম কম্পিউটার গবেষণায় বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে, তেমনি বিভিন্ন প্রাইভেট কোম্পানিও বিনিয়োগ করছে প্রচুর। যারাই এটি প্রথম উদ্ভাবন করতে পারবে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, প্রযুক্তি, চিকিৎসা ইত্যাদি ক্ষেত্রে তারা একলাফে এগিয়ে যাবে অনেক দূর। দেখা দিতে পারে ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা। ভেঙে পড়তে পারে মানুষের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা।

সেটা যাতে না হয়, সে জন্য বিভিন্ন দেশের সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো চেষ্টা করছে কোয়ান্টাম কম্পিউটার দিয়ে ভাঙা যাবে না, এ রকম এনক্রিপশন গড়ে তুলতে। এ ধরনের বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে তারা। তবে আশার কথা হলো, কোয়ান্টাম কম্পিউটার উদ্ভাবিত হলে সেটা দিয়ে নতুন ধরনের এনক্রিপশনও তৈরি করা যাবে। যা ভাঙা যাবে না কোয়ান্টাম কম্পিউটার দিয়েও। বাংলায় যাকে বলে ‘যেমন বুনো ওল, তেমনি বাঘা তেঁতুল’!

যত যা–ই হোক, কোয়ান্টাম কম্পিউটার শেষ পর্যন্ত শুধুই একটা যন্ত্র। চমৎকার সব ভালো কাজে এর ব্যবহার যেমন সম্ভব, ভয়ংকর অস্ত্র হিসেবেও এটি প্রয়োগ করা যেতে পারে। নির্ভর করবে ব্যবহারকারীর ওপর। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক সভ্যতায় নতুন প্রযুক্তির হাত ধরে হিরোশিমায় বোমা যেমন বিস্ফোরিত হয়েছে, তেমনি উদ্ভাবিত হয়েছে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। ফেসবুক ও কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার তথ্য কেলেঙ্কারি মানুষের ব্যক্তিজীবনকে যেমন ঝুঁকিতে ফেলেছে, তেমনি কৃষ্ণগহ্বরের ছবি তোলা থেকে শুরু করে তুলনামূলক অনেক দ্রুত সময়ে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কারও হয়েছে এই প্রযুক্তির হাত ধরেই।

প্রযুক্তি যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, আগামী যুগে না হলেও আমাদের জীবদ্দশায় আমরা হয়তো সত্যিকার কাজে লাগে, এ রকম কর্মক্ষম কোয়ান্টাম কম্পিউটার দেখে যেতে পারব। মানবতা সেদিন আধুনিক এই প্রযুক্তির ভালো ব্যবহারে আরও এগিয়ে যাবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক: শিক্ষার্থী, কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগ, ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: নিউজ উইক ম্যাগাজিন ও সায়েন্স ইলাস্ট্রেটেড