কোয়ান্টাম কম্পিউটারে হলোগ্রাফিক ওয়ার্মহোল

হলোগ্রাফিক ওয়ার্মহোল

প্রথমবারের মতো কোয়ান্টাম কম্পিউটার ব্যবহার করে ওয়ার্মহোলের প্রকৃতি বোঝার চেষ্টা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয় ও ক্যালটেকের একদল বিজ্ঞানী। কম্পিটার সিমুলেশনে তৈরি করেছেন ওয়ার্মহোল। তাঁদের গবেষণাপত্রটি নেচার জার্নালের ১ ডিসেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।

ওয়ার্মহোল হলো, স্থানকালের মধ্য একধরনের সুড়ঙ্গ। খুব অল্প সময়ে অকল্পনীয় দুরত্ব অতিক্রম করা সম্ভব এর মাধ্যমে। বাস্তবে ওয়ার্মহোলের প্রমাণ এখনও মেলেনি। তবে তাত্ত্বিকভাবে এর অস্তিত্ব আছে। যদিও বিজ্ঞানীরা ওয়ার্মহোলের বৈশিষ্ট্য বা খুঁটিনাটি সম্পর্কে এখনও প্রায় কিছুই জানেন না।

১৯৩৫ সালে আলবার্ট আইনস্টাইন ও নাথান রোজেন যুগ্মভাবে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন—‘দ্য পার্টিকেল প্রবলেম ইন দ্য জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি’। একই বছর আইনস্টাইন, রোজেন ও বোরিস পোডলস্কি যুগ্মভাবে লেখেন—‘ক্যান কোয়ান্টাম মেকানিক্যাল ডেসক্রিপশন অব ফিজিক্যাল রিয়েলিটি বি কনসিডারড কমপ্লিট?’ এই দুটো আপাত ভিন্ন গবেষণা থেকে ওয়ার্মহোল হেঁয়ালির সূচনা। এত বছর পর এসে, এই হলোগ্রাফিক ওয়ার্মহোল পদার্থবিজ্ঞানীদের ওয়ার্মহোলের বাস্তব প্রকৃতি সম্পর্কে বুঝতে সাহায্য করবে বলে মনে করছেন গবেষকরা।

শিল্পীর কল্পনায় ওয়ার্মহোল

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি বা ক্যালটেকে কর্মরত পদার্থবিজ্ঞানী মারিয়া স্পিরোপুলু তাঁদের এই গবেষণা সম্পর্কে বলেন, ‘মহাকর্ষের মাঝে বাস্তব একটি ওয়ার্মহোলের মূল বৈশিষ্ট্যগুলো কেমন হবে, তা বের করার একটি উপায় (কোয়ান্টাম সিস্টেম) আমরা খুঁজে পেয়েছি। তবে বর্তমানে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং যে পর্যায়ে আছে, সেটা আমাদের সমাধানটা সম্পূর্ণ পরীক্ষা করে দেখতে পারবে না। আজকের কোয়ান্টাম কম্পিউটিং প্রযুক্তি এটা পরীক্ষা করার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে ওঠেনি এখনো।’

এ নিয়ে একটি দারুণ মজার কথা বলেছেন গবেষণা দলের একজন সদস্য, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ড্যানিয়েল জেফরি। তিনি এই ‘ওয়ার্মহোল টেলিপোর্টেশন প্রটোকল’-সিমুলেশনের প্রধান ডেভেলপার। তাঁর ভাষ্যমতে, ‘আমরা এবং যে কোয়ান্টাম কম্পিউটারে এই হলোগ্রাফিক ওয়ার্মহোলটি তৈরি করা হয়েছে, সেই কম্পিউটারটি যে বাস্তবতায় অবস্থান করছে, স্বয়ং হলোগ্রাফিক ওয়ার্মহোলটি কিন্তু সেই বাস্তবতায় অবস্থান করছে না! করছে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের ভেতরে সৃষ্ট একটি ভিন্ন বাস্তবতায়। হলোগ্রাফিক প্রিন্সিপল বলে, কোয়ান্টাম কম্পিউটারের কিউবিটগুলো, এবং এতে সৃষ্ট হলোগ্রাম দুটো ভিন্ন বাস্তবতায় অবস্থান করছে। এটি একই পদার্থবিজ্ঞানের ভিন্ন রূপ। কিন্তু এ ধরনের দ্বৈততার ধারণা কীভাবে ধারণ করতে হয়, তা এখনো রহস্যময়।’

মহাবিশ্বে ঋণাত্মক শক্তি আছে। এই ঋণাত্মক শক্তি থাকে প্রতিপদার্থ বা অ্যান্টিম্যাটারের কণায়।

মানেটা নিশ্চয়ই পরিষ্কার। অতিসরলীকরণ করে বললে, হলোগ্রাফিক এই ওয়ার্মহোল শুধুই কম্পিউটারে তৈরি অ্যানিমেশন। বাস্তব কিছু নয়। আর পদার্থবিজ্ঞানীরা এখনও সত্যিকারের ওয়ার্মহোল তৈরি করার মতো কোনো পরিস্থিতিও দেখতে পাচ্ছেন না। কারণ ওয়ার্মহোল তৈরির জন্য প্রয়োজন ঋণাত্মক শক্তি বা নেগেটিভ এনার্জি। তবে এটি ব্যবহারের মতো প্রযুক্তি আমাদের কাছে নেই। কখনো এরকম কোনো প্রযুক্তি আবিষ্কার করা যাবে কি না, তাও নিশ্চিত না।

মহাবিশ্বে ঋণাত্মক শক্তি আছে। এই ঋণাত্মক শক্তি থাকে প্রতিপদার্থ বা অ্যান্টিম্যাটারের কণায়। তবে বড় পরিসরে প্রতিপদার্থ তৈরি তো দূরে থাকুক, খুব সামান্য প্রতিপদার্থ তৈরি করতেও বর্তমানে প্রচুর শক্তি খরচ হয়ে যায়। ব্যয় হয় প্রচুর টাকা। প্রায় অর্ধ শতক ধরে গবেষণা করেও বিজ্ঞানীরা আজও কয়েক গ্রাম প্রতিপদার্থ তৈরি ও জমিয়ে রাখার উপায় বের করতে পারেননি। তার মানে, ঋণাত্মক শক্তি সহসা ব্যবহারযোগ্য হয়ে উঠবে বা ধরা দেবে মানুষের হাতে, এমনটা ভাবা বাতুলতা। ঋণাত্মক শক্তি নিয়ে এত গবেষণা ও প্রচেষ্টার কারণ আছে অবশ্য। পদার্থের সঙ্গে প্রতিপদার্থের সংঘর্ষ হলেই বিস্ফোরণ ঘটে। বেরিয়ে আসে খাঁটি, শতভাগ শক্তি। আর এর রেসিপিটাও বলে গিয়েছেন স্বয়ং আইনস্টাইন—E = mc2

কোয়ান্টাম কম্পিউটারে হলোগ্রাফিক ওয়ার্মহোল সৃষ্টি আমাদের সবকিছুর তত্ত্বের খোঁজে কিছুটা হলেও এগিয়ে নেবে, এটুকু আশা করাই যায়।

প্রসঙ্গে ফিরি। হলোগ্রাফিক ওয়ার্মহোলের এই গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অর্থায়নে। গবেষণাটির আনুষ্ঠানিক নাম, কোয়ান্টাম কমিউনিকেশন চ্যানেলস অব ফান্ডামেন্টাল ফিজিকস। এর উদ্দেশ্য ছিল, কোয়ান্টাম মহাকর্ষকে ভালোভাবে বোঝা। কোয়ান্টাম মহাকর্ষ মূলত কোয়ান্টাম বলবিদ্যা ও সাধারণ আপেক্ষিকতাকে এক সুতোয় বাঁধার ত্বত্ত। বিজ্ঞানীদের ধারণা, এই দুটোকে এক সুতোয় বাঁধলেই পাওয়া যাবে সবকিছুর তত্ত্ব—দ্য থিওরি অব এভরিথিং। এই দুই বিপরীত তত্ত্বকে একত্রিত করে একটি সার্বজনীন তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা বিজ্ঞানীদের বহুদিনের লক্ষ্য। কারণ, এই দুই তত্ত্বকে মেলানো গেলে মিলবে মহাবিশ্বের বিপুল রহস্যের সমাধান।

ওয়ার্মহোল ভ্রমণ কোনোভাবে কোয়ান্টাম অ্যান্ট্যাঙ্গেলমেন্টের সঙ্গে সম্পর্কিত কি না সেটাও একটি বড় প্রশ্ন। সেই প্রশ্নের জবাবও খোঁজা হচ্ছে এই গবেষণায়। খোঁজা হচ্ছে স্থানকালের সঙ্গে কোয়ান্টাম মহাকর্ষের সম্পর্ক।

বিজ্ঞানীদের ছোট্ট এই পদক্ষেপ আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে, তা এখনই বলার উপায় নেই। তবে কোয়ান্টাম কম্পিউটারে হলোগ্রাফিক ওয়ার্মহোল সৃষ্টি আমাদের সবকিছুর তত্ত্বের খোঁজে কিছুটা হলেও এগিয়ে নেবে, এটুকু আশা করাই যায়। পাশাপাশি, বলা বাহুল্য, এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় সেসব বিজ্ঞান কল্পগল্পের কথা, যেগুলো বলে, আমরা হয়তো বাস করছি একটি হলোগ্রাফিক মহাবিশ্বে। আসলেই কি তা-ই? কে জানে!

লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা

সূত্র: সায়েন্স অ্যালার্ট