এসওএস সিগন্যাল কী? বিপদে পড়লে কীভাবে পাঠাবেন?

বিপদের সময় একমাত্র আশা হতে পারে একটি সঠিক সংকেত। জরুরি পরিস্থিতিতে জীবন বাঁচাতে এসওএস (SOS) সিগন্যাল পাঠানো হয়। কিন্তু কীভাবে পাঠাতে হয় এ সিগন্যাল? চলুন, জেনে নেওয়া যাক বিভিন্ন পরিস্থিতিতে কীভাবে এই জরুরি সংকেত পাঠানো হয়…

ধরুন, সমুদ্রের মাঝে হারিয়ে গেছেন। কিংবা আটকা পড়েছেন ঘন জঙ্গলে। কী করবেন? এমন পরিস্থিতে SOS (এসওএস) সিগন্যালই হতে পারে আপনার জীবনের একমাত্র আশা।

বিপদে পরলে আমরা ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে চিৎকার করি। প্লেন বা হেলিকপ্টার নিয়ে কেউ বিপদে পড়লে বলে ‘মেডে’ (Mayday)। ফরাসি ভাষায় এর অর্থ ‘আমাকে সাহায্য করুন’। কিন্তু আপনি যদি বাংলাদেশের বাইরে গিয়ে বিপদে পড়েন, আর ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে চিৎকার করেন, তাহলে কেউ হয়তো আপনার কথা বুঝবে না। তখন কি করবেন? এ সমস্যা সমাধানের জন্য একটা আন্তর্জাতিক সংকেত নির্বাচন করা হয়। এ সংকেতকেই বলা হয় এসওএস। অনেকটা ইংরেজি ভাষার মতো। সব দেশে গিয়ে আপনি ইংরেজিতে কথা বলে মানুষকে বোঝাতে পারবেন। এসওএস সংকেতের সাহায্যেও আপনি যেকোনো দেশে সাহায্য পাবেন।

১৯০০ সাল থেকে আন্তর্জাতিকভাবে এ সংকেত ব্যবহৃত হচ্ছে। শুরুতে অবশ্য জাহাজ উদ্ধারের জন্য এ সংকেত ব্যবহৃত হতো। ধীরে ধীরে এ সংকেত সব দেশে পৌঁছে যায়। কারণ, এ সংকেত মনে রাখা ও বোঝা খুব সহজ। আগুনের ধোঁয়া, টর্চের আলো, শব্দ, উঁচু স্থান থেকে আলোর সংকেত ছাড়াও নানা ভাবে এ সংকেত পাঠানো যায়। চলুন, সেই সংকেতগুলো সঙ্গে পরিচিত হই; জেনে নিই, কখন কোন পরিস্থিতে কোন সংকেত ব্যবহার করবেন।

আরও পড়ুন

আগুনের ব্যবহার

জরুরি অবস্থায় প্রস্তুতিই মূল বিষয়। দুর্গম পাহাড়, ঘন জঙ্গলে কিংবা অজানা জায়গায় হারিয়ে গেলে কী করবেন? আগুন জ্বালাতে পারেন। প্রাচীনকাল থেকে মানুষ নানা ভাবে আগুন জ্বালাতে শিখেছে। এটা বেশ কার্যকরী উপায়। আগুন জ্বালালে উদ্ধারকারীরা সহজেই হারিয়ে যাওয়া ব্যক্তির কাছে পৌঁছাতে পারে। তবে এই পদ্ধতিটি ব্যবহারের সময় কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মাথায় রাখতে হয়। নিরাপত্তা বিধি মানার সঙ্গে সঙ্গে আরও কিছু বিষয় মাথায় রাখতে হয়।

প্রথমে আশপাশের জায়গা পর্যবেক্ষণ করে মোটামুটি খোলা জায়গা নির্বাচন করতে হবে। সারারাত আগুন জ্বালানোর জন্য সংগ্রহ করতে হবে পর্যাপ্ত শুকনো কাঠ বা শুকনো পাতা। যাতে রাতেও দূর থেকে আগুন দেখা যায়। আগুন জ্বালানোর আশপাশের জায়গা পরিষ্কার করে নিতে হবে, যাতে আগুন অনিয়ন্ত্রিত ভাবে ছড়িয়ে না পরে। আর দিনের আলোয় সাহায্যের জন্য আগুনের পাশে কাঠ বা পাথর দিয়ে যথাসম্ভব বড় আকারের SOS বা HELP লিখে রাখতে পারেন।

ধোঁয়ার ব্যবহার

বিপদ থেকে বাঁচতে ব্যবহার করতে পারেন ধোঁয়া। সে জন্য পাশাপাশি এক সারিতে তিন জায়গায় আগুন জ্বালাতে পারেন। অথবা আগুন এমনভাবে জ্বালাতে পারেন যাতে দূর থেকে দেখলে ত্রিভুজের মতো দেখায়। দিনের আলোয় দূর থেকে আগুনের শিখা দেখা না যেতে পারে। এ অবস্থায় আগুনের গাঢ় ধোঁয়া ব্যবহার করতে পারেন। অনেক দূর থেকে এ ধোঁয়া দেখা যায়। সেক্ষেত্রে অবশ্য বাতাস অনুকূলে থাকতে হবে।

আগুনের ধোঁয়া যত ওপরে উঠবে, তত দূর থেকে তা দেখা যাবে। উদ্ধারকারীদের কাছে সাহায্যের সংকেত পৌঁছানোও সহজ হবে। এমন জায়গায় আগুন জ্বালাতে হবে যাতে ধোঁয়া জঙ্গলের গাছপালায় আটকে না যায়। তাই যথাসম্ভব ফাঁকা জায়গায় আগুন জ্বালাতে হবে। উদ্ধারকারীরা হেলিকপ্টারে কাছাকাছি আসলে আগুনের ওপর দিতে হবে সবুজ পাতা। এতে আগুন থেকে ঘন সাদা ধোঁয়া  তৈরি হবে। উদ্ধার কাজ শেষ হলে আগুন নেভানোর সময় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যাতে দাবানলের মতো দুর্ঘটনা না ঘটে।

আরও পড়ুন

টর্চলাইট ব্যবহার

রাতের অন্ধকারে জরুরি অবস্থায় টর্চলাইটের সাহায্যেও সংকেত পাঠাতে পারেন। এ জন্য টর্চলাইট প্রথমে তিনবার দ্রুত অন-অফ করতে হবে। এরপর আগের চেয়ে ধীরে আবার তিনবার। তারপর আবার তিনবার দ্রুত অন-অফ করতে হবে। দ্রুত বলতে এক সেকেন্ডের কম সময় বোঝানো হচ্ছে। আর ধীরে মানে এক সেকেন্ডের বেশি সময়। আসলে এটাও এক ধরনের মোর্স কোডের ব্যবহার।

 

মোর্স কোড ব্যবহার

ধরুন, দল বেঁধে বনে ঘুরতে গেছেন। হঠাৎ দেখলেন আপনি একা। বাকিরা কেউ আপনার আশপাশে নেই। এমন পরিস্থিতে কি করবেন? এ ধরনের পরিস্থিতিতে ব্যবহার করতে পারেন মোর্স কোড। সে জন্য কোনো দরজা, জানালা বা দেয়ালে লাঠি বা পাইপের আঘাতে শব্দ করে এসওএস সংকেত পাঠাতে পারেন। প্রথম তিনবার দ্রুত, তারপর তিনবার ধীরে, এবং আবার তিনবার দ্রুত শব্দ করতে হবে। সংকেতটা হবে অনেকটা এরকম: (..._ _ _ ...)। এখানে এসওএস-এর ‘এস’ বোঝাতে প্রথম তিনটি বিন্দু, ‘ও’ বোঝাতে তিনটি ড্যাশ এবং শেষ ‘এস’ বোঝাতে আরও তিনটি বিন্দু।

 

আয়না ব্যবহার

দূরের কোনো জাহাজ, নৌকা বা বিমানের দৃষ্টি আকর্ষণ করার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো সূর্যের আলো প্রতিফলিত করে এসওএস সংকেত পাঠানো। প্রথমে তিনবার সংক্ষিপ্তভাবে, তারপর তিনবার দীর্ঘভাবে এবং শেষে আবার তিনবার সংক্ষিপ্তভাবে আলো প্রতিফলিত করতে হবে। এই পদ্ধতির নাম হেলিওগ্রাফি। প্রাচীন গ্রিসে হেলিওগ্রাফির সাহায্যে যোগাযোগ করা হতো। আবহাওয়া অনুকেলে থাকলে এ প্রায় ৩২ মাইল দূর থেকেও দেখা যায় সংকেত। হাতের কাছে আয়না না থাকলে ভাঙা কাঁচের বোতল, টিন, ফয়েল পেপার অথবা রোদে চকচক করে এমন বস্তুও ব্যবহার করা যায়।

ফ্লেয়ার ব্যবহার

ফ্লেয়ার ওনেক রকম হতে পারে। ফ্লেয়ার গান আমাদের কাছে পরিচিত। ছাড়াও আছে ডিস্ট্রেস ফ্লেয়ার যা আতসবাজির মতো কাজ। তবে যেটাই ব্যবহার করতে চান না কেন, আগে থেকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হবে। জরুরি সংকেত পাঠাতে এগুলোও ব্যবহৃত হয়। ওপরে উঠে এগুলো লাল আলো ও ধোঁয়া ছড়ায়। বিমান বা জাহাজ থেকে সহজেই এই আলো ও ধোঁয়া দেখা যায়। একটি ফ্লেয়ার ৪০ সেকেন্ড পর্যন্ত জ্বলে। উদ্ধারকাজে সাহায্য ছাড়াও বন্য প্রাণীদের থেকে বাঁচাতে ফ্লেয়ার ব্যবহার করা যায়। উজ্জ্বল লাল আলোয় প্রাণীরা ভয় পায়।

 

পতাকা ব্যবহার

জরুরী অবস্থায় উজ্জ্বল রঙের কাপড় বা প্লাস্টিক থাকলে তা একটি লম্বা লাঠির সঙ্গে বেঁধে পতাকার মতো তৈরি করে সাহায্য চাওয়া যায়। লাটি উঁচু ডালের বেঁধে কিংবা মাটিতে পুতে রাখতে পারেন। পতাকা বাঁধার কাজ হয়ে গেলে নিরাপদ স্থানে বিশ্রাম নিতে পারেন। আশপাশে সাহায্যকারী কেউ থাকলে পতাকা দেখেই আপনাকে উদ্ধার করবে।

হাত-পা নেড়ে সাহায্য চাওয়া

বিপদের সময় হাত-পা নেড়ে দূরের ব্যক্তিকে নিজেদের অবস্থা বুঝাতে পারেন। তবে উদ্ধারকারীর চেয়ে আপনার দূরত্ব কতটা, তার ওপর নির্ভর করে এ এ সংকেত কতটা কার্যকরী হবে।

আরও পড়ুন

মোবাইল ফোন ব্যবহার

জরুরী অবস্থায় আপনার উপকারী বন্ধুর মতো সাহায্য করতে পারে সঙ্গে থাকা মোবাইল ফোনটা। দূর্গম জায়গায় নেটওয়ার্ক পাবে না, এটাই স্বাভাবিক। তবে স্মার্টফোনে থাকা SOS অপশনের সাহায্যে আপনি সাহায্য চাইতে পারবেন। আইফোনে এসওএস সংকেত দেওয়ার জন্য একটি ফিচার রয়েছে। জরুরী অবস্থায় আইফোনের সাইড বাটন ও একটি ভলিউম বাটন একসঙ্গে চেপে ধরে এই ফিচারটি চালু করা যায়। এতে স্ক্রিনে ‘ইমার্জেন্সি এসওএস’ লেখা ওঠে। তারপর ওই লেখায় চাপ দিলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জরুরি সেবায় কল চলে যায়। তবে যারা অ্যান্ড্রয়েড ব্যবহারকারী, তাঁরাও এ ফিচার ব্যবহার করতে পারেন। ফোন লকের নিচে ‘এসওএস ইমার্জেন্সি’ বা ‘ইমার্জেন্সি কল’ কিংবা শুধু ‘ইমার্জেন্সি’ লেখা থাকে। সেখানে চাপ দিলে সরাসরি ৯৯৯ কল চলে যাবে। এভাবেও সাহায্য চাইতে পারেন।

সূত্র: ওলি ওলারটনের হাউ টু সারভাইভ অলমোস্ট এনিথিং বই অবলম্বনে

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ