সমস্ত রাস্তা সোলার প্যানেলে ঢাকলে কেমন হতো?

মানব সভ্যতার উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে এনার্জি বা শক্তির চাহিদা। একটা সময় কাঠ পুড়িয়ে শক্তি পেতাম আমরা। তারপর এল কয়লা, তেল বা গ্যাসের মতো জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহার। ক্রমবর্ধমান শক্তির চাহিদা মেটাতে এই বহরে এখন যোগ হয়েছে পারমাণবিক শক্তি।

এসব উৎস চাহিদার বিপরীতে শক্তি যোগান দিতে পারছে ঠিকই, তবে পরিবেশের ক্ষতিও করছে। জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নির্গত কার্বন ডাই-অক্সাইড পৃথিবীর জলবায়ুকে বদলে দিচ্ছে মারাত্মকভাবে। হুমকির মুখে পড়েছে প্রাণ ও জলবায়ু।

পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখতে এখন তাই এসব শক্তির ওপর নির্ভর করলে চলবে না। প্রয়োজন নবায়নযোগ্য ও পরিবেশবান্ধব শক্তি। এ ধরনের শক্তির চমৎকার একটি উৎস সূর্য, পৃথিবীর প্রাণের পেছনে যেটির অবদান অনস্বীকার্য। ব্যবহারযোগ্য শক্তি তৈরিতেও কাজে লাগানো যায় সৌরশক্তি, উৎপাদন করা যায় সৌরবিদ্যুৎ।

বাংলাদেশসহ পুরো পৃথিবীতেই সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার বেড়েছে গত কয়েক দশকে। কিন্তু সেটা একটি দেশ বা শহরের পুরো শক্তিচাহিদা মেটানোর মতো পর্যায়ে পৌঁছেনি। এর একটা কারণ, স্থান ও যথাযথ উদ্যোগের অভাব।

সৌরবিদ্যুতের জন্য প্রচুর পরিমাণ ছোট আকারের সৌরকোষ সরাসরি রোদে রাখতে হয়। এত জায়গা কোথায় পাবেন? বাসা-বাড়ির ছাদে রাখা যায়। তবে সব বাসা-বাড়ির ছাদ সৌরকোষে ঢেকে দেওয়া একটু জটিল বটে।

একটা সমাধান হতে পারে, সড়ক-মহাসড়ক। একটি দেশে অনেকগুলো সড়ক থাকে। এসব সড়কে প্রচুর রোদ পড়ে সারাদিন। একবার কল্পনা করুন তো, এই সব সড়ক সৌরকোষ দিয়ে ঢেকে দিলে বা পুরো সড়কটিই সৌরকোষ দিয়ে বানালে কেমন হতো? আর এতে খরচই-বা কেমন পড়ত? একটা দেশের বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে ঠিক কী পরিমাণ সড়ক সৌরকোষে ঢেকে দিতে হবে? খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি হতো কি? এসব উত্তর জানার চেষ্টা করব। তার আগে সৌরবিদ্যুৎ কীভাবে তৈরি হয়, সেটা একটু জানা যাক।

সিলিকন দিয়ে তৈরি সৌরকোষে সূর্যের আলো পড়লে শক্তি তৈরি হয়। আসলে, এই শক্তি তৈরি হয় সিলিকনে সূর্যরশ্মি হিসেবে আসা ফোটন কণা ধাক্কা দিলে। সিলিকন একটি অর্ধপরিবাহী মৌল। অর্ধপরিবাহী একই সঙ্গে ধাতব পরিবাহী ও অপরিবাহীর মতো আচরণ করে। সূর্য থেকে আসা ফোটন কণা যখন সিলিকনকে ধাক্কা দেয়, তখন ফোটনের শক্তি সিলিকনের ইলেকট্রনকে মুক্ত ইলেকট্রনে পরিণত করে। এই মুক্ত ইলেকট্রনের স্রোতই তড়িৎ শক্তি।

২০০০ সালের পর থেকে পৃথিবীজুড়ে নবায়ন যোগ্য শক্তির ব্যবহার বেড়েছে প্রায় ২০০ শতাংশ। সোলার ইন্ডাস্ট্রি বা সৌরশক্তিনির্ভর শিল্পের জন্য এটা নিঃসন্দেহে সুখবর। শুধু ২০১৯ সালেই ১৭ হাজার মেগাওয়াট নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদিত হয়েছে পৃথিবীজুড়ে। অবাক করা বিষয় হলো, এই শক্তির মাত্র ৩ শতাংশ এসেছিল সৌরবিদ্যুৎ থেকে। এর কারণ, সৌরকোষ বা সোলার প্যানেল স্থাপনের জন্য জায়গা প্রয়োজন।

তাই রাস্তাগুলোকে যদি সোলার প্যানেল দিয়ে ঢেকে দেওয়া যায়, তাহলে শক্তিচাহিদার বড় অংশের জোগান দেওয়া যেতে পারে সৌরবিদ্যুৎ থেকে। কিন্তু আমরা যদি পুরো পৃথিবীর শক্তির চাহিদা সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে মেটাতে চাই, তাহলে ঠিক কতটুকু রাস্তা সৌরকোষে ঢেকে দিতে হবে?

২০১৬ সালে ওয়েওয়াট নামে যুক্তরাজ্যের একটি প্রতিষ্ঠান একটি সড়কের ১ কিলোমিটার সৌরকোষে ঢেকে দেয়। এটি বছরে প্রায় ২৮০ মেগাওয়াট-ঘন্টা বিদ্যুৎ তৈরি করতে পারে। পরিমাণটা একেবারে কম নয়। ২৫টি বাড়ির একবছরের চাহিদা পূরণ করতে পারে এ পরিমাণ শক্তি। শুধু যুক্তরাজ্যেই প্রায় ৪ লাখ কিলোমিটার রাস্তা আছে। এর ২০ শতাংশ, অর্থাৎ ৮০ হাজার কিলোমিটার রাস্তা সৌরকোষে মুড়িয়ে দিলে দেশটির বাৎসরিক মোট বিদ্যুৎ চাহিদার মাত্র ৫ শতাংশ পূরণ করা সম্ভব। এখন আসল কথাটা হলো, দামটা কেমন হবে?

সৌরকোষে ঢাকা রাস্তা তৈরির খরচ দেখলে আমরা বিষয়টা বুঝতে পারব। একটু আগে যে ওয়েওয়াটের তৈরি সড়কের কথা বললাম, সেটা ফ্রান্সের নরম্যান্ডিতে অবস্থিত। এটি তৈরি করতে খরচ হয়েছিল প্রায় ৫৫ লাখ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ৬০ কোটি টাকা।

প্রচলিত অন্যান্য বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের তুলনায় এই ব্যয় খুব একটা কম নয়। রাস্তাকে কার্যকর সৌরবিদ্যুতের উৎসে রূপান্তর করার আগে তাই ব্যয় কমানো জরুরী।

এখন আরেকটি প্রশ্ন আসে। সৌরকোষে মোড়া সড়ক পৃথিবীর জন্য কতটা উপকারী হবে?

প্রথমত, কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ কমাতে এ ধরনের সড়ক বড় ভূমিকা পালন করবে। বর্তমানে সড়ক তৈরির অন্যতম প্রধান উপাদান হলো পিচ। হাইড্রোকার্বনভিত্তিক এই জৈবযৌগটিও মূলত জীবাশ্ম জ্বালানীর একধরনের উপজাত। পিচের পরিবর্তে সৌরকোষ দিয়ে সড়ক বানালে জীবাশ্ম জ্বালানির এই উপজাতের উৎপাদন কমবে। পাশাপাশি রাস্তা থেকে নবায়নযোগ্য শক্তি তৈরি হওয়ার ফলে কয়লা, তেল বা গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে আসবে। ফলে কমে যাবে পরিবেশের কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ।

দ্বিতীয়ত, পিচ—বলা ভালো, এর মূল উপাদান অ্যাসফল্ট সূর্যের আলোর প্রায় ৮০ থেকে ৯৫ শতাংশ শোষণ করে। ফলে, রাস্তা ও এর আশেপাশের তাপমাত্রা অনেক বেশি হয়। এর বদলে সৌরকোষ দিয়ে সড়ক বানালে এই তাপের পরিমাণ কমবে। যার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে আবহাওয়া ও জলবায়ুতে। শহরের গড় তাপমাত্রা কম হলে শহরের অধিবাসীরাও আরামে থাকতে পারবে। যদি সৌরকোষে ঢাকা এসব রাস্তাকে ‘স্মার্ট সড়ক’ হিসেবে তৈরি করা যায়, তাহলে রাস্তা থেকে বৈদ্যুতিক গাড়ি চার্জ করে নেওয়াও সম্ভব তাত্ত্বিকভাবে।

সবকিছুরই যেমন ভালো-খারাপ দিক থাকে, তেমন সৌরকোষে তৈরি সড়কেরও আছে। এ প্রযুক্তিতে পৃথিবীর সব দেশ রাস্তা বানাতে চাইলে বর্তমানে নির্মাণ কাজের সঙ্গে সংযুক্ত অনেকেই চাকরি হারাবেন। চাকরি হারানো এসব মানুষকে নতুন করে নতুন প্রযুক্তিতে কাজ করতে পারার উপযোগী করে প্রশিক্ষিত করতে হবে। আর ব্যয়ের বিষয়টা তো আগেই বলেছি।

তা ছাড়া সৌরকোষের ওপরে সাধারণত স্বচ্ছ কাচ বা কাচের মতো পদার্থের মসৃণ প্রলেপ দেওয়া থাকে। এতে সিলিকনের ওপর সূর্যের আলো ভালোভাবে পড়তে পারে। রাস্তার ক্ষেত্রে এ ধরণের মসৃণ পৃষ্ঠ এখনও উপযোগী নয়। বৃষ্টি বা তুষারপাতে মসৃণ তল পিচ্ছিল হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে গাড়ির টায়ারেও আনতে হবে পরিবর্তন।

সৌরকোষ দিয়ে সড়ক তৈরির কাজটি শুধু কল্পনা নয়। এর বাস্তব প্রয়োগ পৃথিবীতে এখনই আছে। তবে সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনায় এই প্রকল্প খুব একটা লাভজনক নয়। অন্তত এ মুহূর্তে।

প্রশ্নটা যখন নবায়নযোগ্য জ্বালানি, তখন বিকল্প অনেক উপায় আমাদের হাতে আছে। বিজ্ঞানীরা ফিউশন বিক্রিয়া ঘটিয়ে শক্তি সংগ্রহের উপায় নিয়ে কাজ করছেন বহুদিন হলো। নক্ষত্রের মাঝে এই প্রক্রিয়ায় শক্তি উৎপন্ন হয়। এই পদ্ধতি পুরোপুরি চালু হলে শক্তির যোগান যেমন বাড়বে, তেমনি কমবে খরচ ও পরিবেশ দূষণ। সূর্যের কৌশল যদি আমরা হাতের মুঠোয় আনতে পারি, তাহলে হয়তো সূর্যের আলোর ব্যবহারের জন্য এতো আয়োজনের আর প্রয়োজন পড়বে না।

লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেঁজগাও কলেজ, ঢাকা

সূত্র: হোয়াটইফ শো, উইকিপিডিয়া, সায়েন্স ফোকাস