প্রযুক্তি
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেদিন দাবার বিশ্বচ্যাম্পিয়নকে হারিয়ে দিয়েছিল
৮০-এর দশকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে গবেষণা কাজ অনেক কমে গিয়েছিল। এই ক্ষেত্রে সেই সময় গবেষণা বা প্রযুক্তিগত উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য কোনো বিনিয়োগ হয়নি। তবে বিশেষ একটি ঘটনা আবারও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে খবরের কাগজে তুলে আনে। সেই ঘটনাটি ঘটে ১৯৯৭ সালের ১১ মে। আইবিএমের ডিপ-ব্লু তৎকালীন দাবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন গ্যারি কাসপারভকে হারিয়ে দিয়েছিল। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই সিরিজে আজ শোনাব সে দিনের গল্প।
প্রাচীনকাল থেকেই দাবা খেলাকে বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তিমত্তার প্রতীক হিসাবে ধরা হতো। কিন্তু ঠিক কবে এ খেলার প্রচলন হয়, তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক আছে। অনেক গবেষক মনে করেন, ভারতবর্ষে খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকে প্রচলিত ‘চতুরঙ্গ’ খেলাটি পরে দাবায় রূপান্তরিত হয়। এ খেলায় চারজন খেলোয়াড় বা গুটি ছিল। প্রতিটি দলে থাকত হাতি, ঘোড়া, রথ এবং পদাতিক সৈন্য। এই নাম থেকেই পরে ‘চেস’ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে (চতুরঙ্গ → চেস)।
দাবা খেলায় কৌশল, ধৈর্য এবং অগ্রিম পরিকল্পনার দরকার হয়। খেলোয়াড়দের স্মৃতিশক্তি, যুক্তি বিশ্লেষণ এবং সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা ব্যবহার করতে হয়। এ খেলার প্রতিটি চালই একেকটি সিদ্ধান্ত, যা ভবিষ্যতের ফলাফলের ওপর প্রভাব ফেলে। এই বিষয়টিই একে সাধারণ খেলার চেয়ে অনেক বেশি মস্তিষ্কনির্ভর করে তোলে।
দাবা খেলায় যে জিততে পারে, তাকেই বেশি বুদ্ধিমান বলে ধরে নেওয়া হয়। আর তাই দাবা খেলার মতো একটি জটিল খেলায় যদি কোনো কম্পিউটার মানুষের সঙ্গে সমানতালে লড়তে পারে, কিংবা হারাতে পারে —তাহলে সেটি হবে মানব মস্তিষ্ক বনাম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এক ঐতিহাসিক প্রতিযোগিতা। ১৯৪০ এবং ৫০-এর দশকে অ্যালান টুরিং ও ক্লড শ্যানন দাবার অ্যালগরিদম নিয়ে ভাবতে শুরু করেন। মার্কিন বহুজাতিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আইবিএম নিজেও ১৯৫৬ সালে প্রথম সম্পূর্ণ দাবার প্রোগ্রাম তৈরি করে, যা সেই সময়ের সবচেয়ে অত্যাধুনিক আইবিএম ৭০৪ মেইনফ্রেমে চালিত হতো।
৮০ ও ৯০-এর দশকেই আইবিএম ছিল প্রযুক্তি জগতের শীর্ষস্থানীয় নাম। তারা সব সময় চমৎকার কিছু প্রযুক্তি এনে মিডিয়া ও বাজার সরগরম রাখত। তাদের এন্টারপ্রাইজ সার্ভার, কম্পিউটারের মেইনফ্রেম থেকে শুরু করে বানিজ্যিক কাজের সফটওয়্যার সল্যুশন বিশ্বের প্রায় সব বড় প্রতিষ্ঠানগুলোতে রাজত্ব করত একচাটিয়াভাবে। তবে ১৯৮০-এর দশক পর্যন্ত কোনো কম্পিউটার শীর্ষস্থানীয় মানব খেলোয়াড়কে হারাতে পারেনি। আইবিএম এই সুযোগ কাজে লাগাতে চাইল। যদি তারা এমন যন্ত্র তৈরি করতে পারে, যা একজন বিশ্বচ্যাম্পিয়নকে হারাতে পারবে, তা হবে প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের এক দুর্দান্ত উদাহরণ।
এবার আপনাদের নিয়ে যাই ১৯৮৯ সনে। সেই সময়ে আইবিএমে গবেষণা পরিচালক হিসাবে ছিলেন চি-চুন তান (C.J. Tan)। তিনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চিপ তৈরিতে বিশেষভাবে আগ্রহী ছিলেন। সব সময় খোঁজ রাখতেন, কোনো গবেষক ভালো চিপ তৈরি করছে কি না। বিশেষ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চিপের ব্যাপারে তাঁর ছিল ভীষণ আগ্রহ। এমন সময়ে তিনি সন্ধান পান ফেং-হসিৎ সুই (Feng-hsiung Hsu) নামে এক তাইওয়ানিজ-মার্কিন কম্পিউটারবিজ্ঞানী এবং হার্ডওয়্যার ডিজাইনারের। সুই যুক্তরাষ্ট্রের করনেল ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি গবেষণার সময় একটি প্রজেক্ট তৈরি করেন। এর নাম ছিল চিপটেস্ট। এটি একটি বিশেষ ধরনের দাবা খেলার কম্পিউটার চিপ, যা দ্রুত দাবার চাল দিতে পারত। সুইয়ের তৈরি কম্পিউটার চিপ দেখে অভিভূত হন তান এবং তাঁকে আইবিএমে চাকরির প্রস্তাব দেন। পরে সুই আইবিএমে যোগ দেন। ধীরে ধীরে তিনিই হয়ে ওঠেন আইবিএমের দাবা প্রকল্পের অন্যতম কারিগর।
তবে কিছুদিন পরে আইবিএমের বাণিজ্যিক অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে। ১৯৯৩ সালের দিকে আইবিএম তাদের ইতিহাসের অন্যতম বড় আর্থিক ও কৌশলগত সংকটে পড়ে। অনেকেই ভেবেছিলেন কোম্পানিটি সম্ভবত ভেঙে যাবে। সেই দুঃসময়ে আইবিএমের সিইও হিসাবে দায়িত্ব নেন লুই ভি. গার্স্টনার। তিনি প্রতিষ্ঠানটির পুনর্গঠন করে আবার প্রযুক্তি দুনিয়ায় ফিরিয়ে আনেন, বিশেষ করে সফটওয়্যার ও সার্ভিস-কেন্দ্রিক ব্যবসার ওপর জোর দিয়ে। তিনি প্রকৌশলী নন, তবে ছিলেন দূরদর্শী কৌশলী ও ব্র্যান্ড কৌশলবিদ। শুধু যে ব্যবসাকে গুরুত্ব দিতেন, তা নয়; পাশাপাশি গবেষণাকেও গুরুত্ব দিতেন। গার্স্টনার বুঝতে পারেন, আইবিএম যে দক্ষ, তা প্রমাণ করতে হবে বড় কিছু করে। একদিন গার্স্টনারকে দাবা খেলার চিপ তৈরির কথা বলেন চি-চুন তান। এর গুরুত্ব বোঝেন গার্স্টনার। এমন একটি সিস্টেম তৈরিতে আইবিএম সফল হলে ভালো ব্র্যান্ডিং হবে, তাই তিনি এই প্রকল্পটিতে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করেন। বড় বড় গবেষক নিয়োগ দেন এবং হার্ডওয়্যার তৈরির জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা করে দেন। তিনি স্বপ্ন দেখেন, আইবিএমের কম্পিউটার যদি দাবা খেলায় মানুষকে হারাতে পারে, তাহলে তাঁদের হয়তো আর পিছে ফিরতে হবে না। সুই ও তান তখন সর্বশক্তি প্রয়োগ করলেন এর পেছনের প্রযুক্তিগত ব্যাপারগুলোর উন্নয়ন সাধনে। লুইস গার্স্টনার বলেছিলেন, ‘ডিপ-ব্লু কেবল দাবা খেলা নয়—এটি ছিল আইবিএমের প্রযুক্তিগত নেতৃত্ব প্রমাণের বিষয়।’ বিশ্বচ্যাম্পিয়নকে হারানো ছিল একপ্রকার জনসংযোগ বিস্ফোরণ, যা প্রতিষ্ঠানটির ব্র্যান্ডকে নতুনভাবে তুলে ধরবে।
সেই সূত্র ধরে প্রথম ম্যাচটি ১৯৯৬ সালে ফিলাডেলফিয়ায় অনুষ্ঠিত হয়। এই ম্যাচ আয়োজন করে অ্যাসোসিয়েশন ফর কম্পিউটিং মেশিনারি। অর্থাৎ কম্পিউটারের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ প্রস্তুতকারকদের সংগঠন। ডিপ-ব্লুর প্রথম সংস্করণটির নাম ছিল ‘ডিপ থট’। কিন্তু আইবিএমের মার্কেটিং দল এটির নাম পরিবর্তন করে ডিপ-এর সঙ্গে ‘ব্লু’ যোগ করে, কোম্পানির কর্পোরেট রং নীলের সঙ্গে মিল রেখে।
প্রথম ম্যাচে কাসপারভ ছিলেন আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। কারণ অতীতে কোনো কম্পিউটারকে হারাতে তাঁর কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি। এমনকি ডিপ-ব্লুর আগের সংস্করণ ডিপ থটকে সহজেই পরাজিত করেছিলেন ১৯৮৯ সালে। কিন্তু প্রথম প্রতিযোগিতায়, ১৯৯৬ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি, ডিপ-ব্লু গ্যারি কাসপারভকে হারিয়ে দেয়—এই প্রথম কোনো কম্পিউটার একজন বিশ্বচ্যাম্পিয়নকে আনুষ্ঠানিক ম্যাচে হারাল। এটি ছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা।
ডিপ-ব্লুর বিশেষ একটি চাল কাসপারভকে ভীষণ চমকে দেয়। যদিও এই চালে কোনো তাৎক্ষণিক লাভ বা জয়ের সম্ভাবনা ছিল না, তবে এটিকে কাসপারভ ‘একটি অত্যন্ত মানবিক চাল’ হিসেবে বর্ণনা করেন। তাঁর ভাষায়, ‘আমি যেন অন্য এক বুদ্ধির গন্ধ পাচ্ছিলাম।’
পরের গেমগুলোয় কাসপারভ তাঁর কৌশল বদলান। তিনি দ্বিতীয় ম্যাচটিকে শান্ত ও কৌশলগত পথে নিয়ে যান, যেখানে মানুষের অভিজ্ঞতা ও দূরদর্শিতা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ওপর প্রাধান্য পায়। সেই ম্যাচটি কাসপারভ ৪-২ ব্যবধানে জিতে নেন। এভাবে প্রথম ম্যাচে ডিপ-ব্লু জিতে গেলেও কাসপারভ পরের গেমগুলোতে ‘ইমোশনাল ব্লাফিং’ ট্যাকটিকস ব্যবহার করেন। ডেভেলপার জো হোয়াইট এ নিয়ে নিজের ডায়রিতে লেখেন, ‘চতুর্থ ম্যাচে কাসপারভ এমন এক চাল দিলেন, যা আমাদের প্রোগ্রাম অ্যানালাইসিসে ছিল না... মেশিন ‘রিস্টার্ট’ নিতে বাধ্য হয়েছিল!’ এই প্রতিযোগিতায় যদিও মানুষই জয়লাভ করে, কিন্তু ডিপ-ব্লু একটি গেম জিতে দেখিয়ে দেয়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখন শীর্ষ খেলোয়াড়দের টেক্কা দিতে পারে। কাসপারভ নিজেই বলেন, ‘আমি বোর্ডের ওপারে যেন কৃত্রিম বুদ্ধির ছায়া দেখছিলাম।’
এই ম্যাচের এক বছরের মধ্যে আইবিএমে সুইয়ের দল ডিপ-ব্লুর চিপ ও সফটওয়্যারের অনেক উন্নয়ন সাধন করেন। আইবিএম জোয়েল বেঞ্জামিনকে গ্র্যান্ডমাস্টার উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেয়। তিনি ডিপ-ব্লুর ওপেনিং স্ট্র্যাটেজি উন্নত করতে সাহায্য করেন। মজার ব্যাপার হলো, ডিপ-ব্লু জুনিয়র নামের একটি প্রটোটাইপ ম্যাচে বেঞ্জামিনের কাছে হেরে যায়। এরপর আইবিএম সিদ্ধান্ত নেয়—যাকে হারাতে পারছি না, তাকে নিয়েই কাজ করি!
সুইয়ের দল ডিপ-ব্লুতে উন্নত ডেটাবেস সংযুক্ত করেন। মূল্যায়ন ফাংশনের পাশাপাশি গ্র্যান্ডমাস্টার জোয়েল বেঞ্জামিনের পরামর্শে খেলার লজিকও উন্নত করা হয়। একদিকে তারা হার্ডওয়্যার এবং সফটওয়্যারের অ্যালগরিদম উন্নত করে, অন্যদিকে ডিপ-ব্লুর খেলার ধরন যেন আরও হেঁয়ালিপূর্ণ হয়ে ওঠে—যেন কাসপারভ তার পছন্দ-অপছন্দ আন্দাজ করতে না পারেন। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল, আইবিএম প্রতি গেমের পর ডিপ-ব্লুর অ্যালগরিদম উন্নত করতে পারত, কিন্তু কাসপারভ সেটা পারতেন না। তিনি অভিযোগ করেন, ‘আমি প্রতিবার একটি ভিন্ন ডিপ-ব্লুর মুখোমুখি হই।’ অর্থাৎ আগেরটির খেলার ধরন বুঝে নিয়ে পরেরটির সঙ্গে খেলার উপায় তাঁর ছিল না।
১৯৯৭ সালের মে মাসে নিউইয়র্কের ইকুইটেবল সেন্টারে দ্বিতীয় প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। সারা বিশ্বের সংবাদমাধ্যম, ইন্টারনেট এবং টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার হয় এ প্রতিযোগিতা। প্রথম গেমে কাসপারভ জিতলেও দ্বিতীয় গেমে ডিপ-ব্লু কাসপারভকে হারিয়ে দেয়—ইতিহাসে এই প্রথম কোনো কম্পিউটার একজন বর্তমান বিশ্বচ্যাম্পিয়নকে স্ট্যান্ডার্ড টাইম কন্ট্রোলে হারায়। কাসপারভ হেরে গেলেও পরে বোঝা যায়, সেটি আসলে ড্র করা যেত। তিনি নিজেই বলেন, ‘আমার পুরো ক্যারিয়ারে এটাই প্রথম, কোনো কারণ ছাড়াই আমি হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম।’ এটি বোঝায়, ডিপ-ব্লুর সঙ্গে খেলার চাপ কতটা ভয়াবহ ছিল।
পরের তিনটি গেমের সবকটি ড্র হয়। প্রতিটি ছিল কৌশলগত লড়াই। দুই পক্ষই নানা চেষ্টা করলেও কেউ জিততে পারেনি। পরিশেষে ম্যাচের স্কোর দাঁড়ায় ২.৫–২.৫। এরপরে ফাইনাল গেমটিই হয়ে ওঠে ফলাফল নির্ধারণী। সেটি ছিল প্রতিযোগিতার ষষ্ঠ গেম। এটি অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৭ সালের ১১ মে।
এই দিনটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিন। কারণ, ফাইনাল গেমে ডিপ-ব্লু মাত্র ১৯ চালে কাসপারভকে হারিয়ে দেয়। এটি ছিল এক চমকে দেওয়া ঘটনা। অতি দ্রুত পরাজয়। ম্যাচের ফলাফল দাঁড়ায় ডিপ-ব্লু ৩.৫ এবং কাসপারভ ২.৫।
পুরো পৃথিবী এই ম্যাচ নিয়ে আলোচনায় মেতে ওঠে। ‘মানুষ বনাম যন্ত্র’ ধারণাটি এর হাত ধরে যেন বাস্তবে রূপ নেয়। ডিপ-ব্লুর এই জয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে নতুনভাবে জনসম্মুখে পরিচিত করে তোলে। গ্যারি কাসপারভ বলেছিলেন, ‘কম্পিউটার আমার প্রত্যাশার চেয়েও অনেক বেশি শক্তিশালী।’ ইতিহাসে সেই প্রথম একজন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন পুরো একটি প্রতিযোগিতায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কাছে হার মানেন।
পরাজয়ের পর কাসপারভ অভিযোগ করেন, ডিপ-ব্লু হয়তো কোনো মানব দাবাড়ুর সাহায্য পাচ্ছিল! বিশেষ করে দ্বিতীয় খেলার একটি চাল খুব ‘মানবিক’ ছিল বলে উল্লেখ করেন তিনি। এটিই তাঁকে সন্দেহে ফেলে দেয়। ওদিকে আইবিএম দাবি করে, সব চাল ১০০% যান্ত্রিক। পরে জানা যায়, সেই চালটি আসলে এক ধরনের ‘বাগ’-এর ফলাফল। সে কারণেই ডিপ-ব্লু এলোমেলো চাল দিচ্ছিল। প্রোগ্রামটি এক পর্যায়ে কোনো সেরা চাল বেছে নিতে না পেরে একদম এলোমেলো একটি চাল দিয়ে ফেলে। কাসপারভ সেটাকে ভেবেছিলেন ডিপ-ব্লুর কোনো গভীর পরিকল্পনা, তবে বাস্তবে তা ছিল সফটওয়্যারের একটি বিভ্রাট মাত্র! এই ধারণার পেছনে ছিল একটা চলতি ধারণা—যন্ত্র কখনো এলোমেলো কিছু করবে না, ফলে নিশ্চয়ই এর পেছনে কোনো গভীর কৌশল আছে! এই মানসিক বিভ্রান্তি তাঁর খেলায় প্রভাব ফেলে। এর সূত্র ধরে কাসপারভ ডিপ-ব্লুর পুরো কোড দেখতে চাইলেও আইবিএম বাণিজ্যিক কারণে তা দেয়নি। পরে বিষয়টি দীর্ঘ বিতর্কের জন্ম দেয়।
ডিপ-ব্লু কীভাবে কাজ করে
ডিপ-ব্লুর মূলত দুটি প্রধান চালিকা শক্তি ছিল। প্রথমত, এর ছিল বিশাল প্রসেসিং ক্ষমতা। অর্থাৎ মুহূর্তের মধ্যেই দ্রুত গাণিতিক ক্যালকুলেশন করতে পারত। আর দ্বিতীয়ত ছিল এর সূক্ষ্ম ও উন্নত অ্যালগরিদম। এটি ম্যানুয়ালি ডিজাইন করা একটি সুপার-সার্চ ইঞ্জিন, যাতে ছিল প্রোগ্রামকৃত দাবার জ্ঞান। ডিপ-ব্লু তৈরি হয়েছিল আইবিএমের আরএস/৬০০০ এসপি প্ল্যাটফর্মের ওপর, যার ৩০টি প্রসেসিং নোড ছিল। প্রতিটি নোডে ছিল আইবিএম পাওয়ারনির্ভর প্রসেসর। সঙ্গে যুক্ত ছিল ৪৮০টি দাবা খেলার জন্য বিশেষভাবে তৈরি কম্পিউটার চিপ, যা দ্রুত দাবার চাল বিশ্লেষণ করতে পারত। প্রতিটি নোডে ১৬টি করে এমন দাবা চিপ ছিল। এই চিপগুলোর কারণে দাবার গাণিতিক ক্যালকুলেশন সরাসরি হার্ডওয়্যারে সম্পন্ন হতো, যা সাধারণ সফটওয়্যারের তুলনায় অনেক গুণ দ্রুত। ডিপ-ব্লুর জন্য ‘আইবিএম ইউনিক্স’ নামে একধরনের অপারেটিং সিস্টেম পুরো কম্পিউটেশন সমন্বয় করত। এ জন্য একসঙ্গে কাজ করত ৫০০+ প্রসেসর এবং দাবা চিপ!
ডিপ-ব্লুর অনুসন্ধানের গতি ছিল চমৎকার। ১৯৯৭ সালের ম্যাচে ডিপ-ব্লু প্রতি সেকেন্ডে গড়ে ১০–২০ কোটি পজিশন বিশ্লেষণ করতে পারত। নির্দিষ্ট সময়ে এটি ৩৩ কোটি পজিশন পর্যন্ত বিশ্লেষণ করেছিল! তুলনামূলকভাবে একজন দক্ষ মানব খেলোয়াড় প্রতি সেকেন্ডে গড়ে মাত্র কয়েকটি পজিশন বিশ্লেষণ করতে পারেন। ডিপ-ব্লু সাধারণভাবে প্রতি চালে ১২টি অথবা তারও বেশি চাল আগাম চিন্তা করতে পারত। কখনো কখনো এটি ২০টি চাল পর্যন্ত আগাম বিশ্লেষণ করতে পারত। এটি মিনিম্যাক্স এবং আলফা-বিটা প্রুনিং নামে বিশেষ ধরনের অ্যালগরিদম ব্যবহার করত। সঙ্গে আরও কিছু আধুনিক কৌশল যুক্ত করা হয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ ধাপে ধাপে গভীর বিশ্লেষণ, আগের বিশ্লেষণ সংরক্ষণ, ট্যাকটিক্যাল পজিশন সাবধানে হ্যান্ডেল করা এবং উন্নত সার্চ অপ্টিমাইজেশনের কথা বলা যায়।
কাসপারভের আক্রমণাত্মক স্টাইল মাথায় রেখে ডিপ-ব্লুকে এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছিল, যাতে তা সম্ভাব্য ভালো চালগুলোকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে বিশ্লেষণ করতে পারে। কম গুরুত্বপূর্ণ চালগুলোতে কম প্রসেসিং পাওয়ার খরচ করা হতো। এটি নিশ্চিত করত যে কম্পিউটার কোনো সাধারণ কৌশলে ফাঁদে পড়বে না। বিশেষ করে কাসপারভের বিপক্ষে এটাই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক।
দাবা খেলার শেষ পর্যায়ের অংশে, যেখানে দাবার গুটির সংখ্যা কমে যায়, সেই অংশ বোঝার জন্য ডিপ-ব্লু একটি তালিকা ব্যবহার করত। সেখানে স্বল্প সংখ্যক গুটি থাকলে পারফেক্ট চালগুলো কেমন হতে পারে, তার সম্পূর্ণ ডেটাবেস আগে থেকেই তৈরি করা ছিল। যদিও কাসপারভের বিপক্ষে খেলাগুলো সচরাচর সেই শেষ পর্যায় পর্যন্ত যেত না, তবে এই তালিকাটি ছিল ডিপ-ব্লুর যেতার অন্যতম হাতিয়ার।
ডিপ-ব্লুর পরে
এই ম্যাচের পরে কাসপারভ ১৯৯৮ সালে আরেকটি প্রতিযোগিতার আহ্বান করেন। আইবিএম তা প্রত্যাখ্যান করে। তাদের যুক্তি ছিল, তাদের লক্ষ্য পূর্ণ হয়েছে, এখন নতুন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরির কাজে মনোযোগ দেওয়াই বাস্তবসম্মত। পরে কাসপারভ আইবিএমের সঙ্গে কাজও করেন এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে সহায়ক শক্তি হিসেবে মেনে নেন। তিনি ‘অ্যাডভান্সড চেস’ ধারণা প্রচার করেন, যেখানে মানুষ ও যন্ত্র মিলে খেলে।
আইবিএম যে প্রচারণা চেয়েছিল, সেটা হয়ে গেল। এরপর প্রতিষ্ঠানটি এই প্রযুক্তি বাস্তব জীবনের বিভিন্ন সমস্যা ও ব্যবসায়িক সমস্যা সমাধানে কাজে লাগাতে শুরু করে। অর্থাৎ ডিপ-ব্লুকে পণ্যে রূপান্তর করে। ১৯৯৯ সালে আইবিএম কম্পিউটিং ইনস্টিটিউট চালু করে। সেখানে সুপারকম্পিউটিং এবং অ্যালগরিদম ব্যবহার করে অর্থনীতি ও বাজার বিশ্লেষণ, ফার্মাসিউটিক্যাল গবেষণা, শিল্প ও ব্যবসার কাজে এটিকে অপ্টিমাইজেশন করে। ডিপ-ব্লু দেখিয়ে দেয় কম্পিউটার হাজার হাজার সম্ভাবনার মধ্যে দ্রুত সমাধান খুঁজে পেতে পারে।
ডিপ-ব্লুর উত্তরসূরী হিসেবে পরে যাত্রা করে ডিপ-জিন প্রকল্প। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল জেনেটিক ও বায়োলজিক্যাল প্রক্রিয়া, যেমন প্রোটিন ফোল্ডিং, বিশ্লেষণ করা। এ সময় বাজারে আসে সুপারকম্পিউটার সিরিজ ব্লু-জিন। বিভিন্ন গবেষণা, ফিজিকসের নানা কাজ ও ওষুধ আবিষ্কারে ব্যবহৃত হয় এগুলো। পরে, ২০১১ সালে আইবিএম ওয়াটসন ‘জেপরডি!’ নামে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিখ্যাত কুইজ শোতে দুই সেরা মানব খেলোয়াড়কে হারিয়ে দেয়। এটি ছিল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ইতিহাসে আরেকটি মাইলফলক। ওয়াটসন মানুষের ভাষা বোঝে, বিশ্লেষণ করে, এবং দ্রুত সঠিক প্রশ্ন তৈরি করে উত্তর দেয়। শো-এর ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এটি মানব চ্যাম্পিয়নদের পরাজিত করে।
ওয়াটসনের ছিল ৯০টি সার্ভার এবং ২ হাজার ৮৮০ প্রোসেসর কোর সম্বলিত—উইকিপিডিয়া, বিভিন্ন বই ও অসংখ্য লেখা থেকে শেখা একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সিস্টেম। এটি ডিপ-কিউএ নামের একটি সফটওয়্যার-চালিত। এই সফলতার পরে ওয়াটসন দ্রুত ক্যান্সার চিকিৎসায় সহায়ক, ব্যাংকিং ও আইন খাতে তথ্য বিশ্লেষণ এবং কাস্টমার সার্ভিস চ্যাটবটে রূপ নেয়। ২০২৩ সালে আইবিএম চালু করে ওয়াটসনএক্স। এটি একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং ডেটা প্ল্যাটফর্ম, জেনারেটিভ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জন্য তৈরি। এতে ওয়াটসনএক্স ডটএআই (Watsonx.ai) নামে একট লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল বা এলএলএম মডেল আছে। এটি কোড জেনারেশন, ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসরসহ বিভিন্ন কাজ করতে পারে।
ডিপ-ব্লু কী বার্তা দেয়
১৯৯৭ সালের সেই দাবা ম্যাচ আমাদের দেখিয়েছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শুধু কল্পনা নয়, বাস্তবেই এক বড় শক্তি। ডিপ-ব্লু কেবল একটি যন্ত্র ছিল না, বরং ছিল মানুষের সৃজনশীলতা, বুদ্ধি এবং প্রযুক্তির মিলনস্থল। কাসপারভ একবার বলেছিলেন, ‘আমি ইতিহাসে প্রথমবার বোর্ডের ওপারে এক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে দেখেছি।’ অর্থাৎ আইবিএমের প্রকৌশলীরা এতে প্রথম ইন্টেলিজেন্স বা বুদ্ধিমত্তাকে সিলিকনে রূপান্তর করেছিলেন। এটি দেখিয়েছিল, বড় বড় সমস্যাকে বিশ্লেষণ করে যন্ত্র দিয়ে সমাধান করা সম্ভব। এই দৃষ্টিভঙ্গিই আজকের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উন্নয়নের ভিত্তি।
ডিপ-ব্লুর একটি অংশ বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউট এবং আরেকটি অংশ ক্যালিফর্নিয়ার কম্পিউটার ইতিহাসের জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। অবশ্য বর্তমানে স্মার্টফোনে অনায়াসেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই সিস্টেম চালানো যায়।
শেষের আগে আরও দুটি বিষয় বলতে চাই। এক, গ্যারি কাসপারভ ২০১৭ সালে একটি বই লেখেন, যার শিরোনাম ডিপ থিংকিং। এতে তিনি ডিপ-ব্লুর বিরুদ্ধে খেলার অভিজ্ঞতা এবং মানুষ ও কম্পিউটারের সম্পর্ক নিয়ে মূল্যবান শিক্ষা ও উপলব্ধি তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, সেই পরাজয়কে তিনি শুধু ব্যর্থতা হিসেবে দেখেন না। বরং তিনি মনে করেন, যন্ত্র যতই শক্তিশালী হোক, মানুষের কল্পনা, সৃজনশীলতা ও অভিযোজন ক্ষমতা অপ্রতিরোধ্য। আপনি যদি বই পড়তে ভালোবাসেন, তবে এই বই পড়ার অনুরোধ করব।
দুই, আইবিএম যদিও ডিপ-ব্লুকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাফল্য বলে প্রকাশ করেছে, কিন্তু এটি বর্তমানের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো ছিল না। এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন একধরনের সিস্টেম ছিল। এতে ‘ব্রুট ফোর্স’ নামে সাইবার সিকিউরিটিতে বহুল ব্যবহৃত একটি কৌশল ব্যবহৃত হতো। এ পদ্ধতিতে সম্ভাব্য সব বিকল্পগুলোকে একটি একটি করে পরীক্ষা করে সঠিক উত্তর বা সমাধান খোঁজা হয়। এটি অনেকটা তালাবদ্ধ তালা খোলার চেষ্টা করার মতো, যেখানে আপনি এক এক করে সব চাবি দিয়ে চেষ্টা করে যাবেন সঠিক চাবি মেলার আগপর্যন্ত।
যেমন ধরুন, একটি চার সংখ্যার পাসওয়ার্ড আছে। আপনি জানেন না সেটি কী। সম্ভাব্য পাসওয়ার্ড হতে পারে: ০০০০ থেকে ৯৯৯৯ পর্যন্ত (মোট ১০,০০০ সম্ভাবনা)। আপনি যদি এক এক করে ০০০০, ০০০১, ০০০২, ... করে করে পরীক্ষা করেন, সেটিই ব্রুট ফোর্স। এই পদ্ধতিতে ডিপ-ব্লু দাবার চালগুলো থেকে সব সম্ভাব্য চাল যাচাই করে, যে চালটি দিলে জেতার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি, সেই চালটি দিত। ডিপ-ব্লু কোনোভাবে তথ্য থেকে শিখতে পারত না, যা বর্তমানের সাধারণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা করতে পারে। এর সূত্র ধরে আসে আধুনিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ‘আলফাজিরো’ মতো প্রোগ্রামগুলো। এগুলো নিজেই খেলা শেখে এবং উন্নত হয়। সেই তুলনায় ডিপ-ব্লু ছিল একেবারে ভিন্ন।
তাহলে, ডিপ-ব্লু কি সত্যিই বুদ্ধিমান?
বিজ্ঞানীরা বলেন, ‘না। এটি একটি নির্দিষ্ট গেম-ভিত্তিক বিশ্লেষণাত্মক যন্ত্র।’ তবু ডিপ-ব্লু এক বৈপ্লবিক যন্ত্র। দাবার গ্র্যান্ডমাস্টারকে হারিয়ে দেওয়া তো বিপ্লবের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়!