সেরা ইঞ্জিনের সন্ধানে

১৮৯৩ সালের ১০ আগস্ট। জার্মানির অগসবার্গ শহর। গবেষণাগারে৩ মিটার উঁচু এক ইঞ্জিনের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তিনজন বিজ্ঞানী। তাঁদের হিসাবমতে, এই অতিকায় ইঞ্জিনটি ৫ এইচপি (হর্সপাওয়ার) শক্তি তৈরি করতে পারবে (হর্সপাওয়ার হলো ব্রিটিশ ইমপেরিয়াল সিস্টেমে শক্তির একক। ১ এইচপি বলতে বোঝায় ৩৩ হাজার পাউন্ড বা ১৪ হাজার ৯৬৮ কিলোগ্রাম ভর ১ মিনিটে ১ ফুট উচ্চতায় ওঠাতে যে পরিমাণ শক্তি খরচ হয়)। গবেষক দলের প্রধান রুডলফ ডিজেল। তিনি এগিয়ে গিয়ে জ্বালানির প্রবাহ চালু করলেন ইঞ্জিনে। একটু একটু করে ইঞ্জিন চালু হতেই প্রচণ্ড চাপে বিস্ফোরণ ঘটে। ধারালো লোহার টুকরো ছিটকে পড়ে চারপাশে। এ দুর্ঘটনায় কেউ আহত না হলেও ডিজেল বুঝতে পারছিলেন এই ইঞ্জিনের ক্ষমতা। সৃষ্টি আর উদ্ভাবনের নেশায় নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন রুডলফ ক্রিস্টিয়ান কার্ল ডিজেল।

১৮৫৮ সালের ১৮ মার্চ প্যারিসে জন্মগ্রহণ করেন রুডলফ ডিজেল। বাড়ির দেয়ালঘড়ি খুলে সেগুলোর স্প্রিং, কাঁটা আর মোটর নিয়ে খেলতেন শিশু ডিজেল। পরিবারের বিভিন্ন অনুষ্ঠান, জন্মদিন আর উৎসবের পাওয়া উপহারসামগ্রীর মধ্যে খুঁজে ফিরতেন যন্ত্রপাতি। ১৮৬৭ সাল। একদিন মা–বাবার সঙ্গে ওয়ার্ল্ড ফেয়ারে ঘুরতে গেলেন। সেখানে নিকোলাস অগাস্ট অটোসের পেট্রল ইঞ্জিন দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন ডিজেল। স্টিম ইঞ্জিনের বদলে জ্বালানি থেকে শক্তি তৈরির প্রথম যন্ত্র ছিল সেটা। সেই যন্ত্রের প্রেমে পড়েন ছোট্ট ডিজেল। এরপর থেকে প্রতিদিন প্যারিসের টেকনিক্যাল জাদুঘরে গ্যাস ইঞ্জিন দেখতে যেতেন তিনি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করতেন যন্ত্রের ভেতরের কার্যক্রম। এভাবে একদিন নোটবুকে এঁকে ফেলেন ইঞ্জিনটার ভেতরের কাঠামো। ১৭৬৯ সালে তাঁর নজর কাড়ে তিন চাকার এক ট্রাক্টর। পৃথিবীর প্রথম স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রপেলড যন্ত্র ছিল সেটা। সেটা দেখেই ডিজেল নতুন এক ইঞ্জিনের ছবি আঁকেন মনে, যেটা আমূল বদলে দেয় পৃথিবীর যাতায়াত।

বেশি দিন প্যারিসে আর থাকা হয়নি ডিজেলের। ১৮৭০ সালে শুরু হয় ফ্রাঙ্কো–পার্সিয়ান যুদ্ধ। ফলে ডিজেলের মতো জার্মান পরিবারগুলো প্যারিসে কোণঠাসা হয়ে পড়ে। ট্রেনে চেপে কোনোমতে প্রাণ বাঁচিয়ে ইংল্যান্ডে চলে আসে ডিজেলদের পরিবার। সেখানেও সুবিধা করতে না পেরে জার্মানিতে বড় চাচার কাছে চলে যান ডিজেল। অগসবার্গ শহরে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা শুরু করেন তিনি। এ সময় পিস্টন নিয়ে খুব আগ্রহী হয়ে ওঠেন। সিলিন্ডার–পিস্টন ব্যবহার করে বাইসাইকেলের গতি বাড়ানোর চেষ্টা করতেন ডিজেল। ২১ বছর বয়সে ইউনিভার্সিটি অব মিউনিখ থেকে স্নাতক শেষ করেন। ইতিহাসের সর্বোচ্চ নম্বরের দখল ছিল ডিজেলের। পড়াশোনা শেষে আবারও প্যারিসে পাড়ি দেন। সেখানকার এক কারখানায় চাকরি জুটিয়ে নেন।

কিন্তু ডিজেল এবার আর্থিক সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়েন। সঙ্গে যুক্ত হয় অসহ্য মাথাব্যথা। এই দুটি সমস্যা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ভুগিয়েছে তাঁকে। তাই বলে কিন্তু থেমে থাকেনি ডিজেলের উদ্ভাবন। ১৮৮১ সালে নিজের নামে প্রথম কোনো উদ্ভাবনের পেটেন্ট পান তিনি। স্বচ্ছ বরফ তৈরির যন্ত্র উদ্ভাবন করেন ডিজেল। এ ছাড়া তিনি উচ্চ তাপে ও চাপে অ্যামোনিয়া গ্যাস ব্যবহার করে ইঞ্জিন বানানোর চেষ্টা করছিলেন। দিনে কারখানার চাকরি আর গভীর রাত পর্যন্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দিন পেরোচ্ছিল ডিজেলের।

এরই মধ্যে ‘রেশিওনাল হিট ইঞ্জিন’ নিয়ে গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন ডিজেল। তাঁর এই গবেষণাপত্র মূলত ফুয়েল ইঞ্জিনের ইঙ্গিত দিচ্ছিল। ডিজেল চেষ্টা করছিলেন এমন এক ধরনের ইঞ্জিন তৈরি করতে, যেটা পরিবহনযোগ্য, গোছানো ও যেকোনো মোটরে ব্যবহার করা যাবে খুব কম জ্বালানি ব্যবহার করেই। তবে গবেষণাপত্র থেকে বাস্তবে এই ইঞ্জিন উদ্ভাবনে বেগ পেতে হচ্ছিল তাঁকে। বারবার হাতে-কলমে ব্যর্থ হয়ে এবার নতুন পথে ভাবতে শুরু করেন তিনি। প্রচলিত সূত্রগুলো বাদ দিয়ে নিজেই নতুন তত্ত্ব তৈরি করেন। এই তত্ত্ব অনুসারে খুব দ্রুত ইঞ্জিনের তাপমাত্রা বাড়বে। ফলে বাড়বে ভেতরের চাপও। প্রচণ্ড এই চাপ সহ্য করার মতো ইঞ্জিন আবিষ্কার করা সম্ভব—সেটা কাউকে বোঝাতেই পারছিলেন না ডিজেল। অনেক ছোটাছুটির পর ১৮৯৩ সালে অগসবার্গ ইঞ্জিন ওয়ার্কস রাজি হয় এ কাজে তাঁকে সাহায্য করতে। শুরু হয় পৃথিবীর প্রথম ডিজেল ইঞ্জিন বানানোর কাজ।

প্রথম পরীক্ষায় বিস্ফোরণ ঘটলেও কিছু ছোটখাটো ভুল ঠিক করে আবার পরীক্ষায় নামেন ডিজেল। দুই বছরের মাথায় উদ্ভাবন করেন ২৩ এইচপি শক্তি উৎপাদন করতে সক্ষম ইঞ্জিন। ১৮৯৭ সালে সর্বশেষ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পরীক্ষার মুখোমুখি হয় ডিজেলের ইঞ্জিন। এই পরীক্ষা চলাকালে পর্যবেক্ষক হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয় ইউনিভার্সিটি অব মিউনিখের এক অধ্যাপককে। তিনি ডিজেলের ইঞ্জিন দেখে এতটাই মুগ্ধ হন, তখনই এটাকে পৃথিবীর সবচেয়ে সাশ্রয়ী ইঞ্জিন ঘোষণা করেন। তৎকালীন কমবাশন ইঞ্জিনের তুলনায় প্রায় দুই গুণ আর স্টিম ইঞ্জিনের তুলনায় চার গুণ বেশি শক্তি তৈরি করতে পারত এটি। ‘ভবিষ্যতের ইঞ্জিন’ নামে আখ্যায়িত হয় ডিজেলের ইঞ্জিন।

ডিজেলের আবিষ্কৃত ইঞ্জিন

এবার রাতারাতি বদলে যায় রুডলফ ডিজেলের ভাগ্য। দুনিয়াজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে খ্যাতি। মিউনিখের বিলাসবহুল বাড়িতে উঠে আসেন ডিজেল দম্পতি। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন ডিজেলের ইঞ্জিন কারখানা গড়ে তুলতে আগ্রহী বিনিয়োগকারীরা তাঁর কাছে। জার্মানির একটা ম্যাচ কারখানায় প্রথম ব্যবহার করা হয় ডিজেলের উদ্ভাবিত ইঞ্জিন। পরিবহন খাতেও বিপ্লব তৈরি করে ডিজেলের ইঞ্জিন। ডেনমার্কের ইস্ট এশিয়াটিক কোম্পানি প্রথম ডিজেল ইঞ্জিননির্ভর জাহাজ নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। কোপেনহেগেনে বিঅ্যান্ডডব্লিউ শিপ ইয়ার্ডে তৈরি হয় স্যালানডিয়া নামের এই জাহাজ। ১৯১১ সালে মাত্র তিন মাসে ৩৫ হাজার কিলোমিটার সমুদ্রপথ পাড়ি দেয় এটি। দ্রুতগতি, কম দাম আর রক্ষণাবেক্ষণ সহজ হওয়ায় দুনিয়াজুড়ে সমাদৃত হয় স্যালানডিয়া। প্রায় একই সময়ে সুইডেনের এবি ডিজেল মোটরস প্রতিষ্ঠান কাঠের একটি জাহাজের আরও একটি ইঞ্জিন বানায়। ১৯১০ সালে এই জাহাজে চড়ে গবেষক রোয়াল্ড অ্যামান্ডসেন প্রথম মানুষ হিসেবে উত্তর মেরুতে পৌঁছান। এটা সম্ভব হয়েছিল ডিজেল ইঞ্জিনের জন্যই।

এরপরও একটু একটু করে ইঞ্জিনের আরও উন্নতি করেন রুডলফ ডিজেল। শুরুতে পিট কয়লা দিয়ে ইঞ্জিন চালানোর পরিকল্পনা করলেও ধারাবাহিকভাবে ইঞ্জিন চালনার জন্য তরল জ্বালানি ব্যবহার করেন তিনি। পরে শুধু ফুয়েল ব্যবহার করেই ইঞ্জিন চালনার চেষ্টা করছিলেন। ১৯০০ সালের ওয়ার্ল্ড ফেয়ারে ডিজেল তাঁর ইঞ্জিন চালনা করেন পিনাট বাদামের তেল দিয়ে। এ ছাড়া নানা রকম জৈব তেল ব্যবহারের চেষ্টা করছিলেন। ১৯২০ সালের আগে পেট্রোলিয়াম তৈরির উপযাচক হিসেবে ফুয়েল উৎপাদনের পদ্ধতি আবিষ্কারের আগে পর্যন্ত ভোজ্যতেলেই চালানো হতো ডিজেলের ইঞ্জিন। এমনকি ডিজেল নিজেও এই বিশেষ জ্বালানি ব্যবহার করতে পারেননি।

সফলতা পেয়েছেন ডিজেল। কিন্তু পুরোনো সমস্যা পিছু ছাড়েনি তাঁর। অসহ্য মাথাব্যথা, বিষণ্নতা আর নিদ্রাহীনতায় ভুগছিলেন ডিজেল। বাণিজ্যিকভাবে ডিজেলের ইঞ্জিন খুব ভালো করলেও তাঁর ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক অবনতি হতে থাকে দিনে। এরই মধ্যে বাজারে প্রতিযোগী বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাঁর বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক চুরির অভিযোগ আনে। আদালতে এগুলো নিয়ে দীর্ঘদিন মামলা–মোকাদ্দমায় ছুটতে হয় ডিজেলকে। ফলে আরও ভেঙে পড়েন কালজয়ী এই উদ্ভাবক।

১৯১৩ সালে ১০ মিলিয়ন মার্ক (তৎকালীন জার্মান মুদ্রা) বিনিয়োগ হারান ডিজেল। ২০ বছরের প্রতিষ্ঠান ভেঙে পড়তে শুরু করে। আর্থরাইটিসে আক্রান্ত হয়ে ভয়ংকর জীবন কাটাতে শুরু করেন তিনি। এরই মধ্যে ধীরে ধীরে বেজে ওঠে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা। যুদ্ধে তাঁর ইঞ্জিন ব্যবহারের কারণে প্রাণ হারাবে অনেক মানুষ—এটা ভেবেই যেন মুষড়ে পড়ছিলেন রুডলফ ডিজেল। তবু একরকম চাপে পড়ে ইংল্যান্ডে যেতে রাজি হতে হয় তাঁকে। পরিকল্পনা ছিল ইংল্যান্ডে ডিজেল ইঞ্জিনের কারখানা বানানোর। এই পরিকল্পনার পরেই কী ঘটে ডিজেলের জীবনে, সেটা থেকে গেছে সাধারণ লোকচক্ষুর আড়ালে। ইংল্যান্ড পাড়ি দেওয়ার আগে স্ত্রী মার্থার জন্য উপহার নিয়ে আসেন ডিজেল। এক সপ্তাহ পর উপহারের ব্যাগ খোলার শর্ত দিয়ে জাহাজে চেপে বসেন তিনি।

ইংল্যান্ডের উদ্দেশে ডিজেলের যাত্রা শুরু ২৯ সেপ্টেম্বর। রাতে খাওয়ার পর পরদিন সকালে জাগিয়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন জাহাজের ক্রুকে। কিন্তু সকালে কেবিনে আর তাঁকে পাওয়া যায়নি। মসৃণ বিছানায় পড়ে ছিল ডিজেলের কালো হ্যাট আর জ্যাকেট। ১০ দিন পর নেদারল্যান্ডসের কোস্টগার্ড সাগরে খুঁজে পান এক অজ্ঞাতনামা লাশ। লাশের অবস্থা ছিল করুণ। তাই সেটি আবার পানিতেই ভাসিয়ে দেন তাঁরা। লাশের পকেটে থাকা পরিচয়পত্রই জানান দেয় রুডলফ ডিজেলের মৃত্যুর খবর।

মার্থা ডিজেল উপহারের ব্যাগে পান ২০ হাজার মার্ক, অর্থশূন্য ব্যাংক অ্যাকাউন্ট স্টেটমেন্ট আর আকাশছোঁয়া ঋণের কাগজপত্র। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে মানুষের কথা ভেবে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন রুডলফ ডিজেল। ফসিল ফুয়েল ছেড়ে এখন মানুষ ছুটছে বৈদ্যুতিক উৎসের দিকে। কিন্তু হাইড্রোজেনভিত্তিক বায়ো ফুয়েল জ্বালানিই ভবিষ্যৎ, যার কর্ণধার হয়ে থাকবেন ডিজেল ইঞ্জিনের উদ্ভাবক।