ফ্রিজের ভেতরে খাবার পচে না কেন?

প্রচণ্ড দাবদাহে অস্থির প্রকৃতি। ঘর থেকে বেরোলেই কাঠফাটা রোদ্দুর। বাইরে থেকে ঘুরে এসেছেন। গলা শুকিয়ে কাঠ। বাসায় পা দিয়েই ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানির বোতল বের করে গলা ভেজালেন। এই চিত্রটা বোধ হয় অনেকেরই চেনা। যদিও, বাইরে গরম থেকে এসে অনেক ঠান্ডা পানি খাওয়া উচিত নয়। হঠাৎ তাপমাত্রার এরকম পরিবর্তন শরীরকে কষ্ট দেয়।

যাহোক, শুধু ঠান্ডা পানিই নয়, ফলমূল, শাকসবজি থেকে শুরু করে রান্না করা তরকারি পর্যন্ত সবই আমরা সংরক্ষণ করি ফ্রিজে। কিন্তু এই ফ্রিজ বা রেফ্রিজারেটর কাজ করে কীভাবে?

ফ্রিজের মূল নীতিটি আসলে খুব সহজ। খাবার শীতল রাখার মাধ্যমে পচন রোধ করা। কিন্তু শীতল করলে খাবার পচে না কেন?

বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, ইস্ট, ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাকের মতো যেসব অণুজীব খাবার পচিয়ে ফেলে, সেগুলো বেশি সক্রিয় থাকে একটি অপটিমাম বা অনুকূল তাপমাত্রায়। সাধারণত ৩০ থেকে ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো তাপমাত্রায় এসব অণুজীব বেশি সক্রিয় থাকে। অর্থাৎ এটাই তাদের জন্য অনুকূল তাপমাত্রা। এর কিছু কম তাপমাত্রায় এরা কিন্তু মরে যায় না। শুধু এদের সক্রিয়তা কমে যায়। কিন্তু তাপমাত্রা বেশি হলে কী হয়? প্রশ্নটা মজার, কিন্তু উত্তরটা সবার জানা।

আমরা কেন খাবার রান্না করে খাই? তার অন্যতম কারণ, নির্দিষ্ট তাপমাত্রার বেশি তাপমাত্রায় মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর অণুজীবেরা আর বাঁচতে পারে না। সাধারণত ৬৫ থেকে ৭৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় খাবার রান্না করলেই হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা হু-এর মতে, ৬৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রায় ব্যাকটেরিয়া অতিদ্রুত মারা যায়। তবে কিছু ব্যাকটেরিয়া অনেক বেশি তাপমাত্রা সহ্য করে বাঁচতে পারে। এদেরকে বলে থার্মোফাইল বা তাপপ্রিয় ব্যাকটেরিয়া। তবে এরা মানুষের জন্য ক্ষতিকর নয়।

এখানে বিষয়টা হলো, খাবার রান্নার অন্যতম কারণ জীবাণুদের মেরে ফেলা। কিন্তু খাবার শীতল রাখা হয় মূলত এই জীবাণুদের সক্রিয়তা কমিয়ে দেওয়ার জন্য। বিশেষ করে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম তাপমাত্রায় এদের সক্ষমতা বলতে গেলে হারিয়েই ফেলে। তবে মরে যেহেতু যায় না, তাই ফ্রিজে দীর্ঘদিন খাবার রাখলে নষ্ট হয়ে যায় অনেক সময়।

কথা হলো, এই যে সক্রিয়তা বা সক্ষমতা, এখানে ঠিক কীসের সক্ষমতার কথা বলছি আমরা? ব্যাকটেরিয়ার বংশবৃদ্ধির সক্ষমতার কথা বলছি। ব্যাকটেরিয়া বংশবৃদ্ধি করে গুণিতক হারে, আর এর ফলেই মূলত পচে যায় খাবার। ব্যাকটেরিয়ার এই সক্ষমতা কমে যায় ১০ ডিগ্রির কম তাপমাত্রায়।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, ফ্রিজের ভেতরে এটা করা হয় কীভাবে?

আমরা ফ্রিজের কমপ্রেসরের কথা শুনেছি। দেখেওছি হয়তো, ফ্রিজের নিচে, পেছনের অংশে থাকে সাধারণত। এই কমপ্রেসরসহ পুরো যে সিস্টেমটা ফ্রিজের ভেতরটাকে ঠান্ডা রাখে, তার নাম কমপ্রেশন সিস্টেম। এই পুরো সিস্টেম বা ব্যবস্থাটির মূল উপাদান চারটি। এর সঙ্গে আরও দুটি উপাদান লাগে। অর্থাৎ পুরো ফ্রিজে কাজ করে মূলত ছয়টি উপাদান।

প্রথমে কমপ্রেশন সিস্টেমের বাইরের দুটি উপাদানের কথা জেনে নিই।

এক, ফ্রিজের বডি বা দেহ। এটা তাপের কুপরিবাহী। সেজন্য ফ্রিজের ভেতরের ঠান্ডা বাইরে বেরিয়ে যায় না। আর বাইরের গরম ভেতরে ঢোকে না।

দুই, খুব গুরুত্বপূর্ণ উপাদান—রেফ্রিজারেন্ট বা শীতক দ্রব্য। এটি মূলত ফ্রিজের ভেতরে খাবার থেকে তাপ শুষে নেয়। এখানে মূল নীতিটি খুবই সরল। আমরা জানি, তাপ প্রবাহিত হয় উষ্ণ বস্তু থেকে শীতল বস্তুতে। ফ্রিজের ভেতরেও এটাই ঘটে। শীতক দ্রব্যটি শীতল থাকে, তাই উষ্ণ খাবার থেকে তাপ শীতক দ্রব্যে চলে আসে। বর্তমানে শীতক দ্রব্য হিসেবে বহুল ব্যবহৃত হয় ড্রাই আইস। এটি মূলত কঠিন কার্বন ডাই-অক্সাইড, ফ্রিজে এর তরল রূপটি ব্যবহৃত হয়।

এবারে ফ্রিজের কমপ্রেশন সিস্টেমের চারটি উপাদানের কথা বলি। পুরো ব্যবস্থাটি একটা চক্রের মতো কাজ করে। উপাদানগুলো হলো—

এক, ইভাপোরেটর বা বাষ্পীভবনকারী অংশ—এগুলো মূলত কিছু প্যাঁচানো টিউব। ফ্রিজ খুললে ভেতরে এই টিউব দেখা যায়। এর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার সময় তরল শীতক দ্রব্য তাপ শুষে নেয় ও বাষ্পে পরিণত হয়।

দুই, কমপ্রেসর—এরপর বাষ্পীয় শীতক দ্রব্যটি চলে যায় কমপ্রেসরের ভেতরে। কমপ্রেসর প্রচণ্ড চাপে সংকুচিত করে এটিকে, পাশাপাশি অনেক উষ্ণ হয়ে ওঠে এই বাষ্প। এর মাধ্যমে কমপ্রেসর শীতক দ্রব্যটির প্রবাহ চালু রাখে। সেজন্যই কমপ্রেসর নষ্ট হয়ে গেলে ফ্রিজ কাজ করে না। কারণ তখন শীতক দ্রব্যটি আর প্রবাহিত হতে পারে না ঠিকভাবে।

তিন, কনডেনসার—এগুলোও টিউবের মতো, দেখা যায় ফ্রিজের পেছনে। এর ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় শীতক দ্রব্যটি তাপ ছেড়ে দিয়ে শীতল হতে থাকে। একইসঙ্গে পরিণত হতে থাকে বাষ্পে। আর টিউবগুলো এ তাপে গরম হয়ে যায়। ফ্রিজের পেছনে হাত দিলে তাই দেখা যায়, গরম হয়ে আছে।

আর চার, এক্সপানশন ভালভ—এটি মূলত একধরনের পাম্প হিসেবে কাজ করে। রেফ্রিজারেন্ট বা শীতক দ্রব্যটির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে এই ভালভ। ফ্রিজের ভেতরে কত ডিগ্রি তাপমাত্রা রাখতে হবে, তা ঠিক করে দেওয়া যায় এখানে থাকা রেগুলেটর বা নিয়ন্ত্রকের মাধ্যমে। কনডেনসার থেকে তরল শীতক দ্রব্য বা ড্রাই আইস যখন এখানে আসে, তখন রেগুলেটরের মান অনুযায়ী ভালভ এটিকে ইভাপোরেটরের ভেতর দিয়ে পরিচালিত করে।

শেষ একটি প্রশ্ন নিয়ে কথা না বললে আলোচনাটি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আজকের দিনে সাধারণত নরমাল ফ্রিজ ও ডিপ ফ্রিজ একসঙ্গে থাকে। নরমাল ফ্রিজে পানি তরল থাকে, শাক-সবজি ও রান্না করা খাবার সংরক্ষণ করা হয়। আর ডিপ ফ্রিজে জমে যায় পানি, বরফ বসানো যায়, সংরক্ষণ করা হয় কাঁচা মাছ-মাংস। দুটোর তাপমাত্রা ভিন্ন রাখা হয় কীভাবে?

উত্তরটা সহজ। রেগুলেটরের মাধ্যমে ঠিক করে দেওয়া হয়, ফ্রিজের কোন অংশটিতে তাপমাত্রা কেমন থাকবে। নরমাল ফ্রিজে সাধারণত ১ থেকে ৫ ডিগ্রির মতো তাপমাত্রা রাখা হয়। আর ডিপ ফ্রিজের তাপমাত্রা রাখতে হয় মাইনাস ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম।

এভাবেই ফ্রিজের ভেতরে খাবার ঠান্ডা রাখার মাধ্যমে খাবার সংরক্ষণ করা হয়।

লেখক: সহসম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা