ইন্টারনেট আসলে ঠিক কীভাবে কাজ করে?

ফেসবুকে ঢুকতে চাচ্ছেন। কম্পিউটারে ব্রাউজার ওপেন করলেন। গুগলে ফেসবুক লিখে সার্চ করতেই চলে এল ইউআরএল (facebook.com)। সেটায় ক্লিক করেই ঢুকে গেলেন। পুরো কাজটা করতে সময় লেগেছে হয়তো মাত্র ১ মিনিট। কিন্তু এর মধ্যে কত কিছু হয়ে গেছে, তা ভাবলেও অবাক হতে হবে।

আপনার রিকোয়েস্ট আলোক সিগন্যাল হয়ে ঘুরে এসেছে পুরো পৃথিবী। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সার্ভারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। নিশ্চিত করেছে সব যেন ঠিকভাবে হয়। জটিল ও সুদীর্ঘ এক প্রক্রিয়া এটি। আর আপনার কাছে? কয়েকটা ক্লিক শুধু। চলুন, এই কয়েকটি ক্লিকের পেছনের সুদীর্ঘ প্রক্রিয়াটি সহজ ভাষায়, ধাপে ধাপে ও সংক্ষেপে জেনে নেওয়া যাক।

প্রথমেই বলি, ইন্টারনেট কথাটির বাংলা প্রতিশব্দ ‘অন্তর্জাল’। এই শব্দটি ইংরেজি বা শাব্দিক অর্থটাকে বেশ ভালোভাবে প্রকাশ করে। কথাটির মানে, পৃথিবীর সব কম্পিউটারের মাঝে জালের মতো একধরনের সংযোগ। এই সংযোগে যেকোনো কম্পিউটার চাইলে সাধারণভাবে যুক্ত হতে পারে। তবে বিভিন্ন দেশের সরকারিভাবে কোনো ওয়েবসাইট ব্লক করে রাখা বা কোনো প্রতিষ্ঠানের ক্ষতিকর বা ম্যালিশিয়াস সাইটগুলোকে ব্লক করে দেওয়া ভিন্ন বিষয়।

যাহোক, প্রসঙ্গে ফিরি। শুরুর সেই উদাহরণ ভাবা যাক। আপনি ব্রাউজার ওপেন করলেন। ইউআরএলের ঘরে টাইপ করলেন বিজ্ঞানচিন্তার ওয়েবসাইটের ঠিকানা—bigganchinta.com। এখন, কী ঘটছে ঘটনাটা?

প্রথমত, সব ওয়েবসাইটের একটা আইপি অ্যাড্রেস বা ঠিকানা থাকে। এই ঠিকানাটা নিবন্ধন করা থাকে ওয়েবসাইটের নাম ও ইউআরএলের বিপরীতে। যেমন বিজ্ঞানচিন্তা ডট কম-এর বিপরীতে একটা ঠিকানা বা আইপি অ্যাড্রেস আছে। এটা আসলে আপনার কাজে লাগে না, কারণ আপনি ইংরেজিতে টাইপ করেন ইউআরএল। কিন্তু কম্পিউটার তো আর ইংরেজি বোঝে না। এটি ইউআরএলের বিপরীতে সংখ্যায় লেখা এই ঠিকানাটা খুঁজে নেয়, এবং সে অনুযায়ী সংযোগ তৈরির চেষ্টা করে। কীভাবে, তাতে একটু পরে আসছি।

আইপি অ্যাড্রেস সাধারণত ৩২ বিটের হয়। একটি বিট মানে বাইনারি ডিজিট। এর মান ০ বা ১ হতে পারে। এরকম ৩২টা শূন্য বা এক মিলে হয় একটি আইপি অ্যাড্রেস। তবে আমরা সেটাকে লিখি ‘ডটেড ডেসিম্যাল’ হিসেবে। প্রতি ৮টি বিটকে আমরা একটি দশমিক সংখ্যা হিসেবে লিখি। তারপর একটা করে ডট দিই। যেমন 192.15.67.12। এরকম আইপি অ্যাড্রেস আপনি নিশ্চিয়ই নানা সময়ে এফটিপি সার্ভারে ঢোকার জন্য ব্যবহার করেছেন। না করলেও সমস্যা নেই, জেনে রাখুন, এই আইপি অ্যাড্রেস মূলত ওয়েবসাইটের ইউআরএল-কেই বোঝায়।

এবারে বলি, ইউআরএল থেকে কম্পিউটার আইপি অ্যাড্রেসটা খুঁজে বের করে কীভাবে। ডোমেইন নেইম সার্ভার নামে একধরনের ডাটাবেজ আছে। এই ডাটাবেজ, বাংলায় যাকে বলে তথ্যশালা—এতে তালিকা করে প্রতিটি ডোমেইন নেম (ওয়েবসাইটের নাম) ও ইউআরএল লিঙ্কের বিপরীতে সঠিক আইপি অ্যাড্রেসটি লেখা থাকে। কম্পিউটার এই তালিকা দেখে সঠিক আইপি অ্যাড্রেস খুঁজে নেয়।

তারপরের ধাপে এটি সেই আইপি অ্যাড্রেসের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করতে শুরু করে। এ জন্য তাকে অনেকগুলো সার্ভারের মধ্য দিয়ে তথ্য পাঠাতে হয়। যেমন ফেসবুক ডট কম-এ ক্লিক করলে, আপনার কম্পিউটার থেকে রিকোয়েস্ট যায় আপনার ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারের কাছে। মানে, যাদের থেকে নিয়ে আপনি ইন্টারনেট চালান। রিকোয়েস্ট মানে তাকে জানানো, আমি ওই ওয়েবসাইটে বা ওয়েবপেজে ঢুকতে চাই।

তাদের কাছ থেকে এটা যায় তারা যাদের কাছ থেকে ইন্টারনেট নিচ্ছে, তাদের কাছে। যদি তারা সরাসরি বাংলাদেশ সরকার থেকে ইন্টারনেট নিয়ে থাকে, তবে তাদের কাছ থেকে এই রিকোয়েস্ট যাবে বিটিসিএলের সার্ভারে। সেখান থেকে এটি আবার ফেসবুকের এশিয়ান সার্ভারে যাবে, প্রয়োজনে সেখান থেকে যাবে যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো অঞ্চলের সার্ভারে। সেই সার্ভার অনুমতি দিলে সংযোগ তৈরি শুরু হবে। এই পুরো প্রক্রিয়াটি এমনভাবে করা হয় যেন সবচেয়ে কম সার্ভার বা ধাপ ও সম্ভাব্য ভুল যথাসম্ভব এড়িয়ে আপনাকে নির্ধারিত ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়া যায়।

 সংযোগ তৈরি হয়ে গেলে আপনার কম্পিউটার তখন কাঙ্ক্ষিত সার্ভারের সঙ্গে যোগাযোগ করে। সার্ভারকে বলে, আমি এই ওয়েবপেজটি দেখতে চাই। সেটা হতে পারে ফেসবুক বা একটি ইউটিউব ভিডিও কিংবা যেকোনো কিছু। এই পুরো কথাবার্তাটি একটি নিয়ম মেনে হয়, ইন্টারনেটের ভাষায়। এই নিয়মটিকে বলা হয় টিসিপি/আইপি—ট্রান্সমিশন কন্ট্রোল প্রটোকল/ইন্টারনেট প্রটোকল। এ নিয়ম মেনে ইন্টারনেটে তথ্য আদান-প্রদান করা হয় ডাটা প্যাকেট হিসেবে। ডাটা প্যাকেট মানে, বিষয়টি আসলেই তা-ই, তথ্যের প্যাকেট। এ সময় যেন কোনো ভুল না হয়, বা ভুল হলে তা যেন ঠিক করে নেওয়া যায়, সেজন্য প্যাকেটের শুরু এবং শেষে একটা ক্যাপ বা চিহ্ন (আসলে সংখ্যা, ০ বা ১) বসানো থাকে। এই চিহ্ন দেখে বোঝা যায়, প্যাকেট যেভাবে পাঠানো হয়েছে, সেভাবেই পৌঁছেছে কি না। কোনো ভুল হলে, সেটাও শনাক্ত করা যায় এই চিহ্ন দেখে।

একে একে প্রয়োজনীয় ডাটা প্যাকেটগুলো আপনার কম্পিউটারের ঠিকানায় এসে পৌঁছাতে থাকে। প্যাকেটগুলো ওপেন করে, মানে খুলে দেখে ব্রাউজার। দেখে, প্যাকেটগুলোর ভেতরের তথ্য জিগস পাজলের মতো। কোনটির সঙ্গে কোনটি জোড়া দিতে হবে, তা ব্রাউজার বুঝতে পারে ওই শেষের চিহ্ন দেখেই। এভাবে যত তথ্য এটি জোড়া দেয়, তত সে বুঝতে পারে, জিনিসগুলো আসলে একটা এইচটিএমএল ওয়েব পেজ। এইচটিএমএল মানে, হাইপারটেক্সট মারকাপ ল্যাঙ্গুয়েজ। আমরা জানি, এ ভাষাতেই যেকোনো ওয়েবসাইট তৈরি করা হয়।

একটি ওয়েব পেজ ডিসপ্লে করা বা দেখানোর জন্য প্রয়োজনীয় সব প্যাকেট এসে পৌঁছালে ওয়েবসাইটটা ঠিকভাবে দেখা যায়। সব প্যাকেট এসে না পৌঁছালে আমরা দেখি লোডিং হচ্ছে। আবার কম্পিউটারকে সার্ভার যখন বলে, সব প্যাকেট চলে এসেছে, কিন্তু কম্পিউটার দেখে আসলে সব প্যাকেট আসেনি, কিছু মিসিং আছে, তখন ওয়েবপেজ ভেঙে যায়।

এটা একদম বেসিক আলোচনা। বাস্তবে আরও জটিল অনেকগুলো বিষয় হয়। সব ওয়েবপেজ এখন স্থির থাকে না। ফেসবুক বা ক্রিকইনফোর মতো ওয়েবসাইটগুলোর পেজ নিজে নিজে রিলোড হয়, নতুন কন্টেন্ট স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে আসে। একে বলে ডাইনামিক ওয়েবপেজ। আর যেসব পেজ রিলোড না দিলে নতুন করে আপডেট হয় না নিজে নিজে, সেগুলোকে বলে স্ট্যাটিক ওয়েবপেজ।

ওয়েব প্রযুক্তি দিন দিন আরও উন্নত হচ্ছে। তাই এত কিছু হয়ে গেলেও আমরা লিঙ্কে ক্লিক করে মুহূর্তেই ওয়েবসাইটে ঢুকে যেতে পারি। এর পেছনে কত মানুষের দিনরাতের পরিশ্রম আছে, তা বোঝা যায় না। প্রযুক্তির কাজ অবশ্য এটিই—আমাদের জীবনকে সহজ করে দেওয়া। তবে এই যে পেছনে এত মানুষের পরিশ্রম, এর কথাও আমাদের মনে রাখতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না।

সূত্র: বিবিসি সায়েন্স ফোকাস, উইকিপিডিয়া

লেখক: সহসম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা