নিজেই শিখুন আরডুইনো - ২

আরডুইনোকে নির্দেশ জানানোর উপায়

কম্পিউটারকে যেকোনো কাজ করতে বলার জন্য তাকে প্রোগ্রাম লিখে জানাতে হয়, আমরা কম্পিউটারকে দিয়ে কী করাতে চাচ্ছি। ঠিক তেমনি আরডুইনোকে দিয়ে যেকোনো কাজ করাতে হলে দুটি কাজ করতে হবে। প্রথমত, আরডুইনোর সঙ্গে যদি কোনো সেন্সর বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইস সংযুক্ত করতে হয়, সেটা তো করবই। আর আরডুইনো আসলে কী করবে, সেটা তাকে বোঝানোর জন্য কোড লিখে আরডুইনোকে জানিয়ে দিতে হবে। এ জন্য আমাদের আরডুইনো প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজে সব নির্দেশনা লিখতে হবে আর ব্যবহার করতে হবে আরডুইনো আইডিই (ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট এনভায়রনমেন্ট)। তবে ভয় পাওয়ার কিছুই নেই, কারণ আরডুইনো প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ খুবই সোজা। সি প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজের সঙ্গে আরডুইনো ল্যাঙ্গুয়েজের সিনট্যাক্স প্রায় একই রকমের। অর্থাৎ সি-তে যেভাবে ভ্যারিয়েবল ডিকলেয়ার, ইফ-এলস কন্ডিশন, বিভিন্ন লুপ লেখা হয়—সেগুলো জানা থাকলে আরডুইনোতেও প্রোগ্রাম লেখা যাবে।

আরডুইনো আইডিই কী

আরডুইনো আইডিই হচ্ছে একধরনের ডেভেলপমেন্ট সফটওয়্যার, আরডুইনোর জন্য প্রোগ্রাম লিখে কোডটা আরডুইনোতে পাঠানোর জন্য। একটা ডেভেলপমেন্ট সফটওয়্যার ব্যবহার করে নতুন কিছু তৈরি করা যায়। যেমন আরডুইনো আইডিইর কাজ হলো আরডুইনোর জন্য কোড লিখে সেটাকে আরডুইনো বোর্ডের কাছে পৌঁছে দেওয়া। আরডুইনো আইডিইতে কয়েকটা জিনিস থাকে, সেগুলো এই কাজটা করতে সাহায্য করে। এগুলো হলো—

ক. একটা টেক্সট এডিটর, যেখানে আমরা কোড লিখতে পারি।

খ. একটা কম্পাইলার, এর কাজ হচ্ছে আমাদের লেখা কোডকে কম্পিউটারের উপযোগী ভাষায় রূপান্তর করা। কম্পিউটার সাধারণত বাইনারি সংখ্যা, অর্থাৎ ০ আর ১ ছাড়া আর কিছুই বুঝতে পারে না। কিন্তু এই বাইনারি ভাষায় সবকিছু লেখা আমাদের জন্য আবার কঠিন। তাই আমরা নির্দেশগুলো যে ভাষায় লিখি, সেটাকে কম্পিউটার বুঝতে পারে, এমন ভাষায় রূপান্তর করাটা জরুরি। এই কাজটাই করে দেয় কম্পাইলার। ধরি, আজকে বাংলাদেশ আর চীনের প্রধানমন্ত্রী সংলাপে বসলেন। সেখানে কিন্তু বাংলাকে চায়নিজ ভাষায় এবং চায়নিজকে বাংলা ভাষায় রূপান্তর করার জন্য এক বা একাধিক দোভাষী থাকবেন। তেমনি আরডুইনো আইডিইতে দোভাষীর মতো কম্পাইলার আছে। যখন আমরা কোড লিখি, সেটাকে কম্পাইলার কম্পিউটারের উপযোগী ভাষায় রূপান্তর করে দেয়।

গ. আইডিইতে একটা ডিবাগার থাকে। ডিবাগারের কাজ হলো প্রোগ্রামে ভুল আছে কি না, থাকলে কীভাবে সেই ভুল ঠিক করা যায়, সেই কাজে সাহায্য করা।

ঘ. আইডিইতে একটা বিশেষ ইন্টারফেস থাকে, সেটা আইডিইতে লেখা কোডকে আরডুইনো বোর্ডে আপলোড করতে সাহায্য করে। আপলোড করা মানে হলো আমাদের লেখা নির্দেশগুলো আরডুইনো বোর্ডকে জানিয়ে দেওয়া।

আইডিই কীভাবে ব্যবহার করব

আমরা চাইলে অনলাইনে সরাসরি, কিংবা কম্পিউটারে অফলাইনে অথবা মোবাইল ফোনে আইডিই ব্যবহার করে কোড লিখতে পারি এবং আরডুইনো বোর্ডে আপলোড করতে পারি। আমরা মূলত কম্পিউটারের অফলাইন সফটওয়্যারটি নিয়ে সবগুলো প্রজেক্টের কাজ করব পরের পর্বগুলোতে। আজকে তিনটি উপায় সম্পর্কেই হালকা জেনে রাখব।

ক. অনলাইনে যদি কোড লিখতে চাই, তাহলে চলে যেতে হবে এই ঠিকানায় https://create.arduino.cc/editor। প্রথমে একটি অ্যাকাউন্ট তৈরি করে নিতে হবে। এই অ্যাকাউন্টে লেখা সব কোড আরডুইনোর ক্লাউডে জমা থাকবে।

খ. যদি অফলাইনে কম্পিউটারে কোড লিখতে চাই, তাহলে আরডুইনো আইডিই সফটওয়্যার ডাউনলোড করে নিতে হবে প্রথমে। ডাউনলোড করা যাবে এই ঠিকানা থেকে https://www.arduino.cc/en/Main/Software। এই ঠিকানায় গেলে আমরা দেখতে পারব ‘Download the Arduino IDE’ লেখা আছে।

উইন্ডোজ, ম্যাক, লিনাক্স তিনটি অপারেটিং সিস্টেমের জন্যই সফটওয়্যার দেওয়া আছে। নিজের প্রয়োজনীয় সফটওয়্যারটি এখান থেকে নামিয়ে নিতে হবে। এখন আরডুইনো সফটওয়্যারের সংস্করণ চলছে ১.৮.৫। আমরা হালনাগাদ সফটওয়্যারটিই নামাব। পুরোনো সংস্করণ নামানোর প্রয়োজন নেই। উইন্ডোজের বেশ কিছু অপশন দেওয়া আছে, এর মধ্যে উইন্ডোজ ইনস্টলারটি নামালে সহজে ইনস্টল করা যাবে কম্পিউটারে। সফটওয়্যারটি ডাউনলোড করা হয়ে গেলে সেটি ডাবল ক্লিক করে ইনস্টল করে নিতে হবে। ইনস্টল করার সময় বেশ কিছু ড্রাইভার কম্পিউটারে ইনস্টল করার জন্য অনুমতি চাইতে পারে। সবগুলো অনুমতি অবশ্যই দিতে হবে, তা না হলে ঠিকমতো আরডুইনো কোড কম্পাইল করে বোর্ডে আপলোড করা যাবে না। ইনস্টল করা শেষ হয়ে গেলে আইডিই সফটওয়্যার চালু হবে, তখন একটি মূল পাতা আসবে। সেটি নিয়ে আমরা একটু পরে আলোচনা করছি।

গ. যেসব মোবাইল ফোনে ওটিজি (অন দ্য গো) সাপোর্ট করে, সেই ফোনগুলোতে আরডুইনোর কোড লেখা ও বোর্ডে আপলোড করা যায়। যেমন অ্যান্ড্রয়েড ফোনের জন্য গুগল প্লে স্টোর থেকে ‘ArduinoDroid - Arduino IDE’ নামিয়ে নিতে হবে। এই অ্যাপ মোবাইল ফোনে প্রায় ২১০ মেগাবাইট জায়গা দখল করবে। কাজেই পর্যাপ্ত মেমোরি খালি আছে কি না, দেখে নিতে হবে। এই সফটওয়্যারের পাশাপাশি ওটিজি কেব্লও ব্যবহার করতে হবে। ওটিজি কেবেলর সঙ্গে আরডুইনোর ইউএসবি প্লাগ সংযুক্ত করতে হবে। এরপর আইডিইতে কোড লিখে বোর্ডে কোড আপলোড করা যাবে।

আইডিইর মূল পাতায় কী থাকে

আইডিইর মূল পাতা খুললে আমরা ডান পাশের ছবির মতো একটা পর্দা দেখতে পাব। পর্দায় বেশ কিছু ফিচার থাকে।

১. মাঝখানে যে সাদা অংশ দেখা যাচ্ছে, এটাই টেক্সট এডিটর। এখানে আমরা আমাদের প্রয়োজনীয় কোড লিখতে পারব। এখানে দুটি ডিফল্ট ফাংশন দেওয়া আছে, সেগুলো সম্পর্কে আমরা পরের পর্বে জানব।

২. একদম ওপরে সাদা অংশে আমাদের কোডের নাম ও আমাদের সফটওয়্যারের সংস্করণ লেখা থাকে। তার নিচে একটা মেন্যুবার আছে। যেখানে ফাইল, এডিট, স্কেচ ইত্যাদি মেন্যু আছে। এই মেন্যুবারের কাজ সম্পর্কে আমরা পরে জানতে পারব।

৩. মেন্যুবারের ঠিক নিচে বিভিন্ন চিহ্ন দেওয়া একটি বাটনবার আছে। প্রথমে একটা টিক মার্কের মতো ভেরিফাই বাটন আছে। কোড লেখার পর সেটায় কোনো ভুল আছে কি না, দেখার জন্য ভেরিফাই অপশনে ক্লিক করলে জানা যায়।

৪. কোডে কোনো ভুল আছে কি না, আমাদের কোড আরডুইনোর মেমোরিতে কত জায়গা দখল করবে ইত্যাদি নোটিশ আকারে দেখা যায় একদম নিচে থাকা প্রোগ্রাম নোটিফিকেশন এরিয়ায়।

৫. ভেরিফাইয়ের পাশে একটি অ্যারো সাইনের মতো আপলোড বাটন আছে। কোড আরডুইনো বোর্ডে আপলোড করতে হলে এই আপলোড বাটনে আমরা ক্লিক করব।

৬. তবে বোর্ডে আপলোড করার আগে দুটি কাজ করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আরডুইনোর আসলে অসংখ্য মডেলের বোর্ড আছে। আর কম্পিউটার থেকে আরডুইনোতে কোড পাঠানোর সময় সেটি একটি কমিউনিকেশন পোর্ট ব্যবহার করে কাজ করে। তাই কোড আপলোড করার সময় কোন বোর্ডে আমরা কোড আপলোড করব আর বর্তমানে কম্পিউটারের কোন পোর্ট আমরা ব্যবহার করব, সেগুলো জানিয়ে দিতে হয়। আমরা যদি মেন্যুবারে থাকা টুলস অপশনটি ক্লিক করি, তাহলে দেখতে পারব, সেখানে দুটি অপশন আছে—বোর্ড ও পোর্ট। প্রথমে বোর্ড ক্লিক করে সেখান থেকে আমাদের ব্যবহার করা আরডুইনো বোর্ড সিলেক্ট করে দিতে হবে। যেমন যদি আমরা আরডুইনো উনো ব্যবহার করি, তাহলে সেটি নির্বাচন করে দিতে হবে। আরডুইনো বোর্ডকে যখন আমরা ইউএসবি কেবল দিয়ে কম্পিউটারের একটি ইউএসবি পোর্টে সংযুক্ত করব, তখন কম্পিউটার আরডুইনো বোর্ডকে একটি কমিউনিকেশন পোর্ট ব্যবহারের সুযোগ করে দেবে। টুলস থেকে পোর্ট সিলেক্ট করলে এক বা একাধিক পোর্ট দেখা যাবে, যেমন COM3, COM5 ইত্যাদি। যেই পোর্ট আরডুইনো ব্যবহার করছে, সেই পোর্টের সঙ্গে আরডুইনো বোর্ডের নামও ব্র্যাকেটে দেওয়া থাকবে। যেমন COM5 (Arduino/Genuine Uno)। সেই পোর্টকে নির্বাচিত করে দিতে হবে। বোর্ড ও পোর্ট নির্বাচিত করে না দিলে কোড কোনোভাবেই আপলোড হবে না।

আমরা এখন জানি, কীভাবে আরডুইনো আইডিইতে কোড লিখতে হয় ও আপলোড করার নিয়ম কী? আগামী পর্বে আমরা আরডুইনোতে কোড লেখার সিনট্যাক্স সম্পর্কে জানতে পারব এবং আমাদের প্রথম প্রজেক্টটি সম্পন্ন করতে পারব।

লেখক: প্রশিক্ষক, মাকসুদুল আলম বিজ্ঞানাগার, বাংলাদেশ বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ সমিতি