প্রযুক্তি
এআই আর্টের মালিক কে?
মিডজার্নির মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে বললেই চট করে বানিয়ে দিচ্ছে দারুণ সব ছবি। কিন্তু সেই ছবির আসল মালিক কে? যিনি নির্দেশ দিচ্ছেন, যাঁরা এআই বানিয়েছেন, নাকি যাঁদের ছবি দেখে বুদ্ধিমত্তাটি শিখেছে এ ধরনের ছবি বানানো? আইন, নৈতিকতা ও ভবিষ্যৎ…
পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় চিত্রকর্ম কোনটি? অনেকেই হয়তো লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির মোনালিসার কথা বলবেন। প্যারিসের ল্যুভ মিউজিয়ামে রাখা চিত্রকর্মটি আমারও পছন্দ। তবে আর্ট স্টাইল বা অঙ্কনশৈলীর দিক থেকে ভাবলে আমার সবচেয়ে পছন্দের শিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ।
‘মিডজার্নি’ সম্পর্কে প্রথম যেদিন জানতে পারি, সেদিন থেকেই মাথায় একটা চিন্তা ঘুরছিল। কেমন হতো, যদি নিজের পছন্দের চিত্রকর্মটি ভ্যান গঘের হাতে আঁকা হতো? সেদিনই মিডজার্নির ডিসকর্ড সার্ভারের প্রম্পটে লিখলাম, ‘ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের স্টাইলে আঁকা মোনালিসা।’ এই অসম্ভব কাজটিই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে করে দেয় জেনারেটিভ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাটি। আউটপুট হিসেবে তৈরি করে দেয় ওপরের ছবিটি।
মোনালিসার চিরচেনা সেই মুখটা দূর থেকেই বোঝা যাচ্ছে। তবে ছবিটি একটু ভালো করে খেয়াল করলে হয়তো ভ্যান গঘের মতো আঁকাবাঁকা পেইন্ট ব্রাশের স্ট্রোক চোখে পড়বে। ভ্যান গঘের বিখ্যাত চিত্রকর্ম ‘দ্য স্টারি নাইটের’ মতো ঘূর্ণিপাকের নীল আকাশও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার তৈরি এই ছবিতে স্পষ্ট।
প্রশ্ন হলো, মিডজার্নি এআইয়ের তৈরি এ ছবির মালিক কে? মোনালিসা নামের ছবিটি তো লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির চিত্রকর্ম। সে হিসেবে নতুন এই ছবিও তাঁরই হওয়ার কথা। তবে ব্রাশ টেকনিক, রঙের প্যালেট, পেইন্ট স্টাইল—সবকিছুই তো ভ্যান গঘের। তাহলে এই নতুন মোনালিসার মালিক কি ভ্যান গঘ?
আপনাকে আরও একটু অবাক করে দিই। ছবিটি কিন্তু এঁকে দিয়েছে মিডজার্নির এআই। তাহলে, মিডজার্নির ডেভেলপার টিমও কি হতে পারে এই ছবির মালিক? অবশ্য ছবিটির মালিক হওয়ার সম্ভাবনা আছে আমারও। কারণ, এ ছবিটি তৈরি করার জন্য মিডজার্নিকে নির্দেশ দিয়েছিলাম আমি। তাহলে কি আমিই মালিক এই ছবির? প্রশ্নগুলোর উত্তর স্পষ্ট নয়। এ জন্যই মিডজার্নি, স্টেবল ডিফিউশন ও ডাল.ই-এর মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রোগ্রামগুলো নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। তবে এসব জটিলতা শুধু জেনারেটেড আউটপুটের মালিকানা নিয়ে নয়, বিতর্কটার শুরু ইমেজিনেটিভ এআই মডেলগুলোর গোড়াতেই।
যদিও ওপেন এআইয়ের ডাল.ই ২-এর মতো বেশ কয়েকটি এআই প্রোগ্রাম ব্যবহারের শর্তাবলিতে জেনারেটেড ছবিগুলোর কপিরাইট দেওয়া হয়েছে ব্যবহারকারীকেই। তবে কপিরাইটের জটিলতা কিন্তু ট্রেনিং ডেটাসেট থেকেই চলছে। এআই ইমেজিনেশন প্রোগ্রামগুলোকে ট্রেইন করার জন্য প্রয়োজন হয় বিশালাকার ডেটাসেটের। এই ডেটাসেটে থাকে অসংখ্য ছবি। এসব ছবির বেশির ভাগই নেওয়া হয় ইন্টারনেট থেকে। ডেটাসেট থেকে মেশিন লার্নিংয়ের সাহায্যে জেনারেটিভ মডেলগুলো শিখে একটা নির্দিষ্ট প্রম্পট বা নির্দেশের জন্য ইমেজ স্পেস থেকে ছবি তৈরি করে আনতে হয়।
তবে এই ডেটাসেটে থাকা বেশির ভাগ ছবিই ইন্টারনেটের বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া হয়। এগুলোর কপিরাইট আছে। এআই মডেলগুলোকে এ রকম কপিরাইটসহ ছবিগুলো দিয়েই ট্রেইন করা হয়। এ কারণেই বিভিন্ন আর্টিস্ট তাঁদের সৃষ্টিকর্মের এ রকম বিনা অনুমতিতে ব্যবহারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলছেন।
ইতিমধ্যে তিনজন আর্টিস্ট এই মডেলের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের একটি আদালতে মামলা করেছেন। সারাহ এন্ডারসন, কেলি ম্যাকারনান ও কার্লা ওরটিজ নামের তিনজন আর্টিস্ট মামলা করেছেন মিডজার্নি, স্ট্যাবল ডিফিউশন ও ড্রিমআপের বিরুদ্ধে। তাঁদের মতে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঠিক ও নৈতিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে যেসব আর্টিস্টদের ছবি ব্যবহার করা হয়েছে, তাঁদের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক।
তবে অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, এআই মডেলগুলোকে ট্রেইন করতে ব্যবহৃত ছবিগুলো ব্যবহার করা মোটেই অন্যায্য নয়। কেননা, এসব ইমেজিনেশন প্রোগ্রাম সরাসরি ওই ছবিগুলো ব্যবহার করে নতুন ছবি তৈরি করে না। বরং ডেটাসেটে থাকা ছবিগুলো ব্যবহার করে বস্তু, প্রাণী ও অ্যাবস্ট্র্যাক্ট কনসেপ্টগুলো দেখতে কেমন হয়, তা শেখে।
এই শিক্ষা ব্যবহার করে নতুন প্রম্পট টেক্সটের জন্য ইমেজ স্পেসের একটি নির্দিষ্ট ফ্রেম তুলে আনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। পুরো প্রক্রিয়াটি গণিতের কোনো সূত্র শিখে, সেই সূত্র ব্যবহার করে নতুন গাণিতিক সমস্যা সমাধান করার মতো। সে জন্য পৃথিবীর কোনো সরকার থেকেও এসব জেনারেটিভ মডেলের ব্যবহার এখন পর্যন্ত নিষিদ্ধ করা হয়নি।
এ রকম এআই মডেলের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবে বিতর্ক থাকতে পারে অনেক। ট্রেনিং ডেটাসেটে ব্যবহৃত ছবিগুলো ব্যবহারের আগে ওই ছবির মালিকদের থেকে অনুমতি নেওয়া সম্ভব হলে হয়তো এআই মডেলগুলো নিয়ে চুরির অভিযোগ উঠবে না। তবে আসলেই কী হবে, সে প্রশ্নের জবাব জানে কেবল ভবিষ্যৎ।
লেখক: ব্যবস্থাপক, ডেফ্টাইল্ড
সূত্র: সেন্টার ফর আর্ট ল, ট্রেডমার্ক লয়্যার ম্যাগাজিন