খেলা দেখার রসায়ন

খেলা দেখার সময় কেউ এই দল সমর্থন করেন, তো কেউ ওই দল। এ নিয়ে মারামারি হয়, জমে ওঠে আড্ডা, বেধে যায় তর্ক। চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় তোলেন অনেকে প্রিয় দল জিতে গেলে। হেরে গেলে হৃদ্‌যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারাও যান কেউ কেউ। আমাদের দেহের সব কর্মকাণ্ডই ঘটে বিভিন্ন রাসায়নিকের প্রভাবে। খেলা দেখা ও সমর্থনের উত্তেজনা কিংবা হতাশার পেছনের বিভিন্ন রাসায়নিকের কথা…

খেলা দেখার সময় হরমোনেরও তারতম্য ঘটে। টেস্টোস্টেরন হরমোন নিঃসৃত হয় বেশি। এই হরমোন ডমিন্যান্স বা কর্তৃত্বের অনুভূতি তৈরি করে। ফলে যে দর্শকদের দল জেতে, তাঁরা আপারহ্যান্ড নিতে চান

ফুটবল–জ্বরে আক্রান্ত সারা বিশ্ব। রাত জেগে কাতার বিশ্বকাপ দেখছেন ফুটবলপ্রেমীরা। কিন্তু কেবল কি দেখছেন? উত্তেজনা, আনন্দ–বেদনা ও অনিয়ন্ত্রিত আবেগে ভেসে যাচ্ছেন অনেকেই। প্রিয় দল হারলে কেউ কেউ নাকি আত্মহত্যা পর্যন্ত করেন। শোনা গেছে, বাংলাদেশেই আর্জেন্টিনা-সৌদি আরব ম্যাচের পর হৃদ্‌যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছেন একজন। আবার প্রিয় দল জিতলে বা গোল দিলে চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় তোলেন ভক্তরা, রাতদুপুরে মিছিল বের করেন রাস্তায়। কেন এই উন্মাদনা? খেলা দেখার সময় দর্শকের মন ও মস্তিষ্কের ভেতর কী এমন ঘটে যে তাঁরা এ রকম আচরণ করেন?

দর্শকের মস্তিষ্ক

বিজ্ঞানীরা বলেন, আমাদের মস্তিষ্ক যখন খেলা দেখে, তখন আসলে কেবল ‘দেখে’ না, খেলায় অংশগ্রহণও করে। মানে, ‘স্পেকটেটিং ব্রেন’ হয়ে ওঠে ‘প্লেয়িং ব্রেন’। এটা ঘটে মিরর নিউরনের জন্য, যা সাধারণত থাকে আমাদের মস্তিষ্কের ডান দিকে। মানুষ যখন কোনো উত্তেজক বা কায়িক শ্রমযুক্ত খেলা বা কর্মকাণ্ড দেখে, তখন এর সঙ্গে নিজেকে যুক্ত হতে সাহায্য করে এই নিউরনগুলো। এগুলো তখন ব্যাপক হারে উদ্দীপ্ত হয় এবং নিউরনাল ডিসচার্জ ফায়ার করতে থাকে। এর সঙ্গে অ্যাড্রিনালিন ও কর্টিসোলের মতো স্ট্রেস হরমোন নিঃসৃত হয় প্রচুর পরিমাণে। ফলে বেড়ে যায় হৃৎস্পন্দন, দ্রুত হয় শ্বাসের হার। একজন দর্শকের যে পরিমাণে হৃৎস্পন্দন বা শ্বাসের হার বাড়ে, মানে কার্ডিওরেসপিরেটরি ব্যায়াম হয়, তা একজন খেলোয়াড়ের চেয়ে খুব একটা কম নয়। দর্শকের মস্তিষ্কে একই সঙ্গে বিপুল পরিমাণে তৈরি হতে থাকে ডোপামিন নামের নিউরোট্রান্সমিটার। এটি আমাদের আবেগকে উদ্দীপ্ত করে।

আমাদের সমর্থিত দল যখন জিততে থাকে বা ভালো খেলে, মস্তিষ্ক তখন বেশি করে ডোপামিন তৈরি করে। ডোপামিন ভালো লাগা ও খুশির অনুভূতি সৃষ্টি করে। ফলে আমরা খুশিতে-আনন্দে চেঁচাই, লাফালাফি করি। ইতিবাচক অনুভূতি সৃষ্টি করে এটা। আবার যখন দল হারতে থাকে বা আশানুরূপ খেলতে পারে না, তখন মস্তিষ্ক নিঃসরণ করে কর্টিসোল ও সেরোটনিন। ফলে বিষণ্ন হয়ে পড়ে মন, বাড়তে থাকে অ্যাংজাইটি বা উদ্বেগ। অতিরিক্ত উদ্বেগ হলে উল্টাপাল্টা আচরণ, যেমন চেয়ার ভেঙে ফেলা, বোতল–ছোড়াছুড়ি বা হাত কামড়ানো বিচিত্র নয়।

খেলা দেখে হার্ট অ্যাটাক?

নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন-এ প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রবন্ধ দাবি করছে, উত্তেজক খেলা দেখার পর মাইনর বা মৃদু কার্ডিওভাসকুলার ইভেন্ট; অর্থাৎ হৃদ্‌যন্ত্রের সমস্যা দেখা দেওয়া অস্বাভাবিক নয়। এই গবেষণায় ২০০৬ সালে জার্মানির মিউনিখে বিশ্বকাপ খেলার সময়টাকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। দেখা গিয়েছিল, মিউনিখের হাসপাতালগুলোতে সে সময় হৃদ্‌যন্ত্রের সমস্যা নিয়ে ভর্তির হার বেড়ে যায় অন্য সময়ের তুলনায়। বিজ্ঞানীরা বলেন, এর কারণ, ফাইট অ্যান্ড ফ্লাইট রেসপন্স। খেলোয়াড় নিজে যেমন এই রেসপন্সের মধ্য দিয়ে যান, তেমনি তাঁর সঙ্গী হন দর্শকও। সিমপ্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম উদ্দীপ্ত হয়, প্রচুর অ্যাড্রিনালিন রাশ ঘটে। ফলে হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়, রক্তচাপ বাড়ে, সংকুচিত হয় রক্তনালিগুলো। কখনো অ্যারিদমিয়া বা অস্বাভাবিক অনিয়মিত হৃৎস্পন্দনও হতে পারে। হৃৎপিণ্ডের রক্ত পাম্প করার হার বাড়তে পারে, এমনকি ৩০০ থেকে ৪০০ গুণ পর্যন্ত। বিপুল পরিমাণে ও বিপুল শক্তিতে রক্ত পাম্প করার কারণে রক্তনালির ভেতরের দেয়াল ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, বিশেষ করে যাঁদের আগে থেকেই হার্টের রোগের ঝুঁকি আছে। এ থেকে হতে পারে প্রদাহ। ফলাফল, ব্লক সৃষ্টি ও হার্ট অ্যাটাক। তাই খেলা দেখার সময় বা পরে হার্ট অ্যাটাকের যে ঘটনা শোনা যায়, তা পুরোপুরি বানোয়াট নয়।

খেলা হরমোন

খেলা দেখার সময় হরমোনেরও তারতম্য ঘটে। টেস্টোস্টেরন হরমোন নিঃসৃত হয় বেশি। এই হরমোন ডমিন্যান্স বা কর্তৃত্বের অনুভূতি তৈরি করে। ফলে যে দর্শকদের দল জেতে, তাঁরা আপারহ্যান্ড নিতে চান। খেলা শেষ হওয়ার পর মারামারি বা বিপক্ষকে আক্রমণের পেছনে দায়ী এ হরমোন। ২০১২ সালে স্পেন-নেদারল্যান্ডস বিশ্বকাপ ম্যাচের পর কিছু দর্শকের রক্ত পরীক্ষা করা হয়। এ নিয়ে গবেষণা করেন বিজ্ঞানীরা। স্প্যানিশ দর্শকদের রক্তে টেস্টোস্টেরন উল্লম্ফনের প্রমাণ মেলে। কেবল পুরুষদের মধ্যে নয়, নারীদের মধ্যেও।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

স্ট্রেস ও খেলা

খেলা দেখা এক বিরাট স্ট্রেসও বটে। আগেই বলা হয়েছে, কর্টিসোল বা অ্যাড্রিনালিনের মতো স্ট্রেস হরমোন বিপুল পরিমাণে নিঃসৃত হয় খেলা দেখার সময়। এর কারণ, দর্শক জানেন, যা ঘটতে যাচ্ছে, তার ওপর তাঁদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। শেষ মুহূর্তে গোল হতেও পারে, আবার না-ও হতে পারে। দল জিতে যেতে পারে, হারতেও পারে। এই অনিশ্চয়তা স্ট্রেস বাড়ায়। রক্তে স্ট্রেস হরমোনগুলোর পরিমাণ খেলা শেষ হওয়ার পরও রয়ে যায় দীর্ঘ সময়। ফলে দর্শক বাড়ি ফেরার পরও এই স্ট্রেস থেকে মুক্তি পান না সহজে। কেউ হয়তো বিমর্ষ হয়ে থাকেন, কাঁদেন হাউমাউ করে। কেউ মিছিল বের করেন আনন্দে। এভাবে তাঁদের স্ট্রেস ধীরে ধীরে প্রশমিত হয়।

তবে কি খেলা দেখা ভালো নয়

এতই যখন ঝামেলা, তাহলে খেলা না দেখলে কী হয়? যাঁরা খেলাধুলার ভক্ত নন, তাঁরা প্রায়ই ডাই-হার্ড ফ্যানদের কাণ্ডকারখানা দেখে বিরক্ত হন। কী এমন আছে ওতে যে এত নাচানাচি করতে হবে? কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলেন, খেলাধুলার সঙ্গে দর্শক হিসেবে সম্পৃক্ত হওয়াও একধরনের আনন্দ দেয়। ভালো লাগার অনুভূতি সৃষ্টি করে। নিত্যদিনের বিরক্তিকর রুটিন থেকে দেয় মুক্তি। সেন্স অব বিলংগিং বা সবার কিংবা দেশের সঙ্গে একাত্মতাবোধ বাড়ায়। দল জিতলে আত্মবিশ্বাস বাড়ে। একরকম সম্মিলিত বিজয়বোধ বা কালেকটিভ গ্লোরি এনে দেয় খেলা দেখায় শামিল হওয়ার কারণে। এমনকি খেলা দেখায় ব্যায়ামও হয়। আগেই বলেছি, অ্যারোবিক এক্সারসাইজের সমান শ্রম হয় খেলা দেখার সময়। তাই খেলাধুলা করার মতো খেলা দেখাও খারাপ নয়। কিন্তু নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করা শিখতে হবে। স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট জানতে হবে।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি ও মেটাবলিজম, গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজ, ঢাকা