মোবাইল ফোন আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। কল করা, মেসেজ পাঠানো, ইন্টারনেট ব্রাউজিং, ছবি তোলা, গেম খেলাসহ আরও কত কাজ যে করা হয় মোবাইল দিয়ে, এর কোনো হিসাব নেই। সকাল থেকে শুরু করে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত পুরোটা সময় একটা মোবাইল ফোন সচল থাকতে পারে এর ব্যাটারির জন্য। যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে মোবাইল ফোন ব্যবহার করছেন, হয়তো খেয়াল করেছেন, কখনো কখনো ফোনের পেছনের অংশটা অস্বাভাবিক উঁচু হয়ে ওঠে। মনে হয় ব্যাটারিটা যেন এর জায়গা ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। কেন এমন হয়? উত্তর: মোবাইলের ব্যাটারি ফুলে উঠলে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রিচার্জেবল ডিভাইস বা গ্যাজেটের ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাটারি ফুলে যাওয়ার ঘটনাও দিন দিন বাড়ছে। অনেক সময় ব্যাটারি এত ফুলে যায় যে এর ফলে ডিভাইসের ভেতরটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মাঝেমধ্যে এতে বিস্ফোরণ বা আগুন লাগার মতো ঝুঁকিও তৈরি হয়। অনেকের মনে মোবাইলের এই ব্যাটারি ফুলে ওঠা নিয়ে অনেক প্রশ্ন জাগে। চলুন জেনে নেওয়া যাক, কেন ফুলে ওঠে মোবাইলের ব্যাটারি, এটা কতটা বিপদজনক এবং এমন হলে কী করা উচিৎ।
ব্যাটারি মূলত কয়েকটি কারণে ফুলে ওঠে। একটি কারণ হলো, ব্যাটারি গরম ও ঠান্ডা হওয়ার স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এতে ব্যাটারি যখন গরম হয়, তখন একটু ফোলে; আর যখন ঠান্ডা হয়, তখন ফোলাটা কিছুটা কমে।
এখন বেশির ভাগ মোবাইলে ব্যবহার করা হয় লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি। অন্যান্য রিচার্জেবল ব্যাটারির তুলনায় লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির শক্তি ও আয়ুষ্কাল বেশি। সে কারণেই এর ব্যবহার এত বেশি। ল্যাপটপ, ট্যাব, ই-বাইক, ই-স্কুটার, পাওয়ার ব্যাংকের মতো নানা ধরনের রিচার্জেবল ডিভাইজে এ ব্যাটারি ব্যবহার করা হয়। সাধারণত একটি মোবাইল ফোনের ব্যাটারি ২-৩ বছর পর্যন্ত ভালো থাকে এবং এরপর এর ক্ষমতা কমতে শুরু করে। গড়ে একটি ব্যাটারি প্রায় ৩০০-৫০০ বার সম্পূর্ণ চার্জ করা যায়। কিছু ফোন ভালোভাবে ব্যবহার করলে এর ব্যাটারি আরও বেশি দিন টিকতে পারে। তবে ব্যবহার এবং চার্জ করার অভ্যাসের ওপর নির্ভর করে কিছু ফোনের ব্যাটারি দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। এ সময়ই ব্যাটারি ফুলে ওঠে।
ব্যাটারি মূলত কয়েকটি কারণে ফুলে ওঠে। একটি কারণ হলো, ব্যাটারি গরম ও ঠান্ডা হওয়ার স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এতে ব্যাটারি যখন গরম হয়, তখন একটু ফোলে; আর যখন ঠান্ডা হয়, তখন ফোলাটা কিছুটা কমে। এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এ জন্য মোবাইল ফোনগুলো এমনভাবেই ডিজাইন করা হয় যাতে ভেতরের কম্পার্টমেন্টে একটু বাড়তি জায়গা থাকে। এতে ব্যাটারি একটু ফুললেও কোনো সমস্যা হয় না, ওই বাড়তি জায়গাতেই হয়ে যায়। কিন্তু স্বাভাবিক এ প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটলে ফোন ঠান্ডা হওয়ার সময় পায় না এবং ব্যাটারি ক্রমশ ফুলতে থাকে।
আরেকটি কারণ দেখা যায়—সেটা হলো, লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির মধ্যে প্রত্যাশিত বিক্রিয়া। যখন এই মোবাইল চার্জে দেওয়া হয়, তখন ব্যাটারির লিথিয়াম আয়ন এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে প্রবাহিত হয়। আর যখন ব্যাটারি কোনো ডিভাইসকে পাওয়ার সরবরাহ করে, তখন এরা প্রবাহিত হয় বিপরীত দিকে। এই আয়নগুলো ইলেকট্রোলাইট নামে একধরনের রাসায়নিকের মধ্যে ভাসমান থাকে। ইলেকট্রোলাইটকে বাংলায় বলা যায়, লবণ ও পানির দ্রবণ। লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির মধ্যে লিথিয়ামের কোনো লবণ—যেমন লিথিয়াম হেক্সাফ্লুরোফসফেট (LiPF6)। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, যতবার ব্যাটারি চার্জ এবং ডিসচার্জ করা হয়, তত এই রাসায়নিক ইলেকট্রোলাইটের সঙ্গে বিক্রিয়ায় ধীরে ধীরে ভেঙে যেতে শুরু করে এবং গ্যাস উৎপন্ন করে। যখন এই গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে যায়, তখন ডিভাইসের ব্যাটারি ফুলে উঠতে শুরু করে। কিছুদিন যাওয়ার পর ব্যাটারির ভেতরে অতিরিক্ত গ্যাস তৈরি হয়ে চাপ সৃষ্টি করে। এতেই মোবাইলের পেছনের দিক ফুলে ওঠে, অর্থাৎ ব্যাটারি পুরোপুরি ফুলে ওঠে। আবার ব্যাটারিতে এই গ্যাস জমার আরেকটি কারণ, উৎপাদনের সময়কার ত্রুটি। যদি কোনো ব্যাটারি প্রস্তুতকারক সঠিকভাবে ব্যাটারি তৈরি না করে, তাহলে চার্জ করার সময় ধীরে ধীরে গ্যাস তৈরি হতে পারে। ফলে ফোন বেশিক্ষণ চার্জে রাখা ও ব্যবহারে অতিরিক্ত গরম হয়ে ফুলতে শুরু করে।
বাড়িতে যদি কোনো ফোলা ব্যাটারি বা এমন ব্যাটারিসহ কোনো ডিভাইস খুঁজে পান, তবে কিছু বিষয় মনে রাখা জরুরি। প্রথমত, ব্যাটারি বা সেটি যে ডিভাইসের মধ্যে রয়েছে, তা ব্যবহার করা বন্ধ করতে হবে।
এ ছাড়াও, বাইরে থেকে ব্যাটারি আঘাত পেলে বা ক্ষতিগ্রস্থ হলে ফুলে যেতে পারে। পাশাপাশি ব্যাটারি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পুরোনোও হয়ে যায়। তখন এর ভেতরের রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলো আর আগের মতো করে হয় না, বিক্রিয়া খানিকটা বদলে যায়। এর ফলে ব্যাটারির বিভিন্ন অংশ দুর্বল হয়ে যেতে পারে। এমনকি দীর্ঘ সময় ধরে ব্যাটারি ব্যবহার না করে বা চার্জ না করে ফেলে রাখলেও এমনটা হতে পারে। এ ছাড়া এমনিতে সাধারণভাবে অবশ্য ব্যাটারি ফুলে যাওয়ার কথা নয়। বড় ধরনের উৎপাদনগত ত্রুটি না থাকলে বেশির ভাগ ব্যাটারিরই সাধারণভাবে কয়েক বছর পর্যন্ত ভালোভাবে কাজ করার কথা।
এবারে জানা যাক, ফুলে ওঠা ব্যাটারি কতটা বিপজ্জনক। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসের ব্যাটারি-গবেষক ও অধ্যাপক ডেভিড মিটলিন বলেন, ‘ব্যাটারির ফুলে ওঠা অবশ্যই ভালো লক্ষণ নয়। এটি ব্যাটারির কর্মক্ষমতা কমে যাওয়ার লক্ষণ। তবে এর মানে এই নয় যে ব্যাটারিটিতে সঙ্গে সঙ্গেই আগুন ধরে যাবে।’ অর্থাৎ ব্যাটারির ফুলে ওঠা কতটা বিপজ্জনক, তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। তবে এর ফলে ব্যাটারি বিভিন্নরকম সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। এ কারণে ডিভাইসের অন্যান্য অংশের ক্ষতি হতে পারে। এমনকি ফুলে যাওয়া ব্যাটারির অতিরিক্ত চাপে স্মার্টফোনের স্ক্রিনও ফেটে যেতে পারে।
বাড়িতে যদি কোনো ফোলা ব্যাটারি বা এমন ব্যাটারিসহ কোনো ডিভাইস খুঁজে পান, তবে কিছু বিষয় মনে রাখা জরুরি। প্রথমত, ব্যাটারি বা সেটি যে ডিভাইসের মধ্যে রয়েছে, তা ব্যবহার করা বন্ধ করতে হবে। ভুলেও এটি আবার চার্জ করা যাবে না। যদি সম্ভব হয়, বাটন ফোনের মতো যেসব ডিভাইস থেকে ব্যাটারি আলাদা করা যায়, সে ডিভাইস থেকে ব্যাটারিটি খুলে নিয়ে অগ্নি-প্রতিরোধী জায়গায় রাখতে হবে। যদি বাসায় বা আশপাশে এ ধরনের জায়গা না থাকে, তবে ব্যাটারিটি বালি ভর্তি বালতিতে চাপা দিয়ে রাখতে পারেন। এরপর আপনার ফোন কোম্পানির কাস্টমার কেয়ারে কল করে ব্যাটারিটি কী করবেন, তা জেনে নিতে পারবেন।
তবে যেসব ডিভাইসের ব্যাটারি নিজে খুলতে পারবেন না, ফোলা ব্যাটারিযুক্ত সেরকম ডিভাইসের ক্ষেত্রে নির্দেশনা মেনে প্রস্তুতকারকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। তারাই আপনাকে কীভাবে কী করতে হবে, তা জানিয়ে দেবে।
বর্তমানে সব সমস্যার কথা মাথায় রেখে মোবাইল তৈরির প্রতিষ্ঠানগুলো ফোনের ব্যাটারি ভালো আছে কি না, তা জানাতে অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেমে ‘ব্যাটারি হেলথ’ ফিচার যুক্ত করেছে। এতে ফোনের ব্যাটারির কার্যকারিতার হালনাগাদ তথ্য জানতে পারবেন ব্যবহারকারীরা।
এবারে চলুন জেনে নিই, কীভাবে ব্যাটারির ফোলা বন্ধ করবেন। উৎপাদনগত ত্রুটিযুক্ত ব্যাটারির ক্ষেত্রে বেশির ভাগ সময় কিছুই করার থাকে না। তবে নতুন মোবাইল বা অন্য রিচার্জেবল ডিভাইসে ব্যাটারি যাতে ফুলে না যায়, সে জন্য কয়েকটি দিক খেয়ালে রাখতে হবে। কখনোই ডিভাইসগুলোকে অতিরিক্ত গরম হতে দেওয়া যাবে না। উচ্চ তাপমাত্রা ব্যাটারির ইলেকট্রোলাইট নষ্টের গতি—অর্থাৎ ইলেকট্রোলাইটের সঙ্গে লিথিয়াম আয়নের বিক্রিয়ার গতি—বাড়িয়ে দিতে পারে, যা ব্যাটারির ভেতরে গ্যাস তৈরি করতে পারে। যদি সেই তাপে ব্যাটারি নাও ফোলে, তবু ভবিষ্যতে ব্যাটারির কার্যক্ষমতা তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যাবে। সেই সঙ্গে আরেকটি বিষয় খেয়াল রাখা প্রয়োজন। কখনোই মোবাইল চার্জে দিয়ে গেম খেলা বা অন্য কাজ করা যাবে না।
বর্তমানে সব সমস্যার কথা মাথায় রেখে মোবাইল তৈরির প্রতিষ্ঠানগুলো ফোনের ব্যাটারি ভালো আছে কি না, তা জানাতে অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেমে ‘ব্যাটারি হেলথ’ ফিচার যুক্ত করেছে। এতে ফোনের ব্যাটারির কার্যকারিতার হালনাগাদ তথ্য জানতে পারবেন ব্যবহারকারীরা। অনেক ডিভাইসেই দীর্ঘসময় ধরে উচ্চ তাপমাত্রায় মোবাইলে কাজ করা থেকে ব্যবহারকারীদের বিরত করতে সতর্কবার্তা দেওয়ার ব্যবস্থা থাকে। অর্থাৎ নোটিফিকেশন দেয়। এমনকি মোবাইল ঠান্ডা না হওয়া পর্যন্ত ফোন সম্পূর্ণরূপে বন্ধও হয়ে যায়। ল্যাপটপ বা কম্পিউটারে সাধারণত তাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য বিল্ট-ইন কুলিং সিস্টেম থাকে। তবে গ্রীষ্মকালে খেয়াল রাখা উচিৎ যেন কোনো রিচার্জেবল ব্যাটারিযুক্ত ডিভাইস দীর্ঘক্ষণ গরম গাড়িতে বা সরাসরি রোদে না থাকে।
মোবাইলের ব্যাটারি একবার পুরোপুরি চার্জ হয়ে গেলে সেটাকে চার্জিং থেকে খুলে রাখা উচিত। বর্তমানে এমন চার্জার ব্যবহার করা হয় যাতে ফোন সম্পূর্ণ চার্জ হয়ে গেলে ডিভাইস আর চার্জ না নেয়। যখন চার্জ ১০ থেকে ২০ শতাংশের মধ্যে নেমে আসে, তখন ব্যাটারি আবার চার্জ দেওয়া উচিৎ। ফুলে যাওয়া ব্যাটারির ক্ষেত্রে সব সময় মনে রাখতে হবে, এটাকে ময়লার ডাস্টবিনে ফেলা যাবে না। এরকম ব্যাটারি রিসাইকেলের জন্য পাঠাতে হবে।