কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানবস্তরের কতটা কাছাকাছি

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপরিসীম ক্ষমতার প্রমাণ আমরা পাচ্ছি। এর কিছু ঝুঁকিও আছে। এই বিপদগুলো ধীরে ধীরে আমরা বুঝতে শুরু করেছি। নোম চমস্কি থেকে শুরু করে রজার পেনরোজের মতো চিন্তাবিদেরা বারবার এ ব্যাপারে আমাদের সতর্ক করছেন। কিন্তু এর ফলাফলটা কেমন হতে পারে। আমাদের করণীয় কী?

২০২৩ সাল। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআইয়ের গুরুতর সমস্যাগুলো প্রসারিত হওয়া শুরু করে। বেলজিয়ামের এক ব্যক্তি নিয়মিত ‘এলিজা’ নামের একটি এআই চ্যাটবটের সঙ্গে কথাবার্তা চালাতেন। ওই বছরের মার্চে তিনি আত্মহত্যা করেন। চ্যাটবটের হাতে ‘খুন হওয়া’ লোকটির স্ত্রী জোর দিয়ে বলছেন, ওই এআই প্রোগ্রামের সঙ্গে তাঁর স্বামীর যোগাযোগই তাঁকে নিজের জীবন শেষ করতে বাধ্য করেছে। বেলজিয়াম সরকার মনে করছে, ঘটনাটি অবশ্যই গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত’ এবং ‘এআই ব্যবহারের বিপদ যে এখন বাস্তবতা, তা বিবেচনা করা প্রয়োজন’।

বিজ্ঞানীরা বিংশ শতাব্দীজুড়ে বহির্জাগতিক প্রাণ অনুসন্ধান করে বেড়িয়েছেন। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, যে সিলিকনভিত্তিক প্রাণ মানুষ বহির্জগতে খুঁজে মরছে, সেই সিলিকননির্ভর বুদ্ধিবৃত্তি কৃত্রিমভাবে পৃথিবীতে প্রায় তৈরি করে ফেলেছে মানুষ। সেটা আমাদের নিয়ে যাচ্ছে টেকনোলজিক্যাল সিঙ্গুলারিটির দিকে। অর্থাৎ বহির্জগতে সেই অতি বুদ্ধিমান প্রাণের (যদি থেকেও থাকে) সঙ্গে সাক্ষাতের আগেই মানুষ দেখা পেয়ে যাবে নিজের সৃষ্ট সিলিকননির্ভর প্রাণের। কিন্তু খোদ কৃত্রিম বুদ্ধিবৃত্তিবিষয়ক গবেষকেরা দুশ্চিন্তায় আছেন। বাস্তবের সিলিকন সত্তা দেখার আগেই পরিসমাপ্তি ঘটতে পারে কার্বনভিত্তিক মানুষের, নিজের সৃষ্ট এই সিলিকনভিত্তিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার হাতে। এটাকে একধরনের পরিহাসও বলা যেতে পারে। এর কিছু আগাম সতর্কবার্তা আমরা পাচ্ছি।

টেকনোলজিক্যাল সিঙ্গুলারিটি বা প্রযুক্তিগত অনন্যতা আসলে এমন এক প্রাযুক্তিক বিশ্বব্যবস্থা, যেখান থেকে আর পেছনে ফেরার সুযোগ থাকবে না আমাদের। এআই মানুষের বুদ্ধিমত্তাকে ছাড়িয়ে আরও দ্রুত হারে স্ব–উন্নয়নের মাধ্যমে সুপার ইন্টেলিজেন্স তৈরি করবে, যাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে কি না, তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না। প্রযুক্তিগত সিঙ্গুলারিটি ধারণার প্রবর্তক রে কার্জ উইল তাঁর সিঙ্গুলারিটি ইজ নিয়ার গ্রন্থে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলাপ করেছেন। তিনি মানবতার ভবিষ্যৎ চিত্রিত করেছেন কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা ও জৈবিক বুদ্ধিমত্তার সম্মিলিত অস্তিত্বের একটি নতুন অধ্যায় হিসেবে। কার্জ উইল দীর্ঘকাল ধরে যুক্তি দিয়ে আসছিলেন, আর্টিফিশিয়াল জেনারেল ইনটেলিজেন্স বা এজিআই (সুপার ইনটেলিজেন্স) শুধু সম্ভব নয়; বরং অনিবার্য। ২০২৯ সালে তা আবির্ভূত হবে বলে তিনি পূর্বাভাস দিয়েছেন।

স্যাম অল্টম্যান

মহাকাশ সংস্থা স্পেস এক্স এবং অটোমোটিভ ইন্ডাস্ট্রি টেসলার উদ্যোক্তা ইলন মাস্কও কার্জ উইলের মতো এমন এক ভবিষ্যৎ কল্পনা করেন, যেখানে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের সঙ্গে মিলে যায়—এমন সব রকম কাজ এআই–ব্যবস্থা সম্পাদন করতে পারে। তিনি বিশ্বাস করেন, এজিআই ২০৩০ সালের মধ্যে মানব বুদ্ধিমত্তাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে, কিন্তু এটি অনিয়ন্ত্রিত হলে মানবতাকে শেষ করে দিতে পারে।

চ্যাটজিপিটি–খ্যাত ওপেনএআইয়ের প্রতিষ্ঠাতা সিইও স্যাম অল্টম্যান। তিনিই প্রথম সাধারণের কাছে লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেলের (এলএলএম) অভাবিত কর্মক্ষমতা তুলে ধরেন, যাকে আমরা চ্যাটজিপিটি নামে চিনি। কৃত্রিম সাধারণ বুদ্ধিমত্তার (এজিআই) ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি শেয়ার করে তিনি বলেন, এআইয়ের বর্তমান সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও মানুষ উল্লেখযোগ্য উৎপাদনশীলতা লাভে চ্যাটজিপিটির মতো টুলগুলো ব্যবহারের উপায় খুঁজে পেয়েছেন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গবেষণা শেষ পর্যন্ত এজিআইয়ের দিকে নিয়ে যাবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন। তিনি বলেন, ওপেনএআই এমন এজিআই–পরবর্তী বিশ্বের কল্পনা করছে, যেখানে মানুষ ও এজিআইয়ের মধ্যে একটি সিম্বিওটিক সম্পর্ক থাকবে, যেখানে এজিআই মানবতার তৈরি সেরা হাতিয়ার হিসেবে বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসবে। অল্টম্যান এমন এক ভবিষ্যৎ কল্পনা করেন, যেখানে বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার হাতে বিকশিত হবে একাধিক এজিআই এবং সহাবস্থান করবে। এই বৈচিত্র্য বিভিন্ন দৃষ্টিকোণকে উৎসাহ দেওয়ার মাধ্যমে এর ব্যবহারিক ক্ষেত্রকে সমৃদ্ধ করে তুলবে।

ডেমিস হাসাবিস

ডিপমাইন্ডের সহপ্রতিষ্ঠাতা ডেমিস হাসাবিস আলফাফোল্ডের মাধ্যমে অ্যামিনো অ্যাসিড সিকুয়েন্সগুলো থেকে প্রোটিনের থ্রিডি কাঠামোর সঠিক পূর্বাভাস দিয়ে কাঠামোগত জীববিজ্ঞানে যুগান্তকারী প্রভাব রেখেছেন। এ জন্য হাসাবিস ও তাঁর দলকে ২০২৪ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। তিনি মানবিক মূল্যবোধের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, এমন এজিআইয়ের সম্ভাব্য বিপদগুলো স্বীকার করেন এবং সতর্ক করেন—এ ধরনের শক্তিশালী টুলগুলোর ব্যাপক অপব্যবহার অস্তিত্বগত ঝুঁকির কারণ হতে পারে। এজিআইয়ের সতর্কতামূলক বিকাশ, এর দায়িত্বশীল ব্যবহারের ওপর জোর দেওয়া এবং নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য তিনি সবাইকে অনুরোধ করেন। হাসাবিস এজিআই বিকাশে ক্রম অগ্রগতির একটি পরিমাপক পদ্ধতির কথা বলেন, যাতে বুদ্ধিমত্তা উচ্চ স্তরে পৌঁছানোর আগে প্রতিটি ধাপে নিয়ন্ত্রণ ও সুরক্ষার প্রক্রিয়াগুলো নিশ্চিত হয়। স্নায়ুবিজ্ঞান-অনুপ্রাণিত পদ্ধতির মাধ্যমে এজিআইয়ের সক্ষমতা অর্জন করা যেতে পারে বলে তিনি বিশ্বাস করেন।

নোম চমস্কি

তবে নোম চমস্কি ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের জায়গা থেকে রজার পেনরোজ এআই–সংক্রান্ত গবেষণাপদ্ধতির বিরোধিতা করেছেন। চমস্কি বলছেন, শুধু অসংখ্য উপাত্তের ভিত্তিতে আরোহী বা ডিডাকটিভ পদ্ধতিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চেতনার জায়গায় পৌঁছাতে পারবে না। এটা একটা বিপজ্জনক বাণিজ্যিক প্রবণতার প্রকৌশলজাত অভিঘাত। পদার্থবিজ্ঞানের জায়গা থেকে তিনি বলছেন, ‘যদি সাফল্য বলতে বিপুল পরিমাণ অবিশ্লেষিত উপাত্ত বিশ্লেষণ করে মোটামুটি সঠিক একটা অনুমানে আসতে পারাকে বোঝানো হয়, তাহলে চিরকাল বিজ্ঞান সবকিছুকে যেভাবে উপলব্ধি করতে চেয়েছে, সেই ধরনের উপলব্ধি অর্জন সম্ভব নয়। আমরা যা পাব তা হচ্ছে, বিভিন্ন ঘটনার একটা ভাসা ভাসা অনুমান।’

রজার পেনরোজ, মানবস্তরের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) সম্ভাবনা নিয়ে দীর্ঘকাল ধরে সন্দেহ পোষণ করে আসছেন। তিনি বিশ্বাস করেন যে গাণিতিক কিংবা অ্যালগরিদমিক উপায়ে মানুষের চেতনা এবং উপলব্ধি সম্পূর্ণরূপে প্রতিলিপি করা যায় না। এটা পদার্থবিজ্ঞানের সেই মৌলিক নীতি, কোয়ান্টাম কম্পিউটার বানাতে গেলেও যা মেনে চলতে হবে—অনিশ্চয়তার নীতি, ১৯২৭ সালে ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ এ নীতি আবিষ্কার করেন, এটি ২০২০ সালেও সত্যি। অনিশ্চয়তার নীতি হলো কোয়ান্টাম বলবিদ্যার দীর্ঘ ছায়া—আপনি নিজের ছায়া থেকে পালাতে পারবেন না।

রজার পেনরোজ

বিজ্ঞানের মৌলিক নীতিমালা বোঝা ছাড়া, শুধু পরিসংখ্যানগত অবিশ্লেষিত তথ্য দিয়ে সম্ভাবনার তত্ত্ব ব্যবহার করা, ইঞ্জিনিয়ারিং ট্রেডের ভিত্তিতে বিকশিত এআইসম্পন্ন স্মার্ট ডিভাইসগুলো মানবসমাজে খুব একটা ভালো ভূমিকা নেবে বলে মনে হয় না। একধরনের ভারসাম্যহীনতা তৈরি হচ্ছে এর ফলে। বিজ্ঞানের মৌলিক নীতিগুলো সম্পৃক্ত না হওয়ায় সেগুলোর নিয়ন্ত্রণ খুব অস্পষ্ট হয়ে পড়েছে। ফলে আমরা বুঝতে পারছি না স্মার্টফোনসহ এআই–সম্পর্কিত সব ডিভাইসের স্বরূপ। তবে এটা খুব স্পষ্ট, উল্কাপিণ্ডের অভিঘাতে গ্রহ-উপগ্রহগুলো ক্ষতবিক্ষত হওয়ার মতোই প্রযুক্তির কারণে সমাজ–সভ্যতা ও পারিবারিক বন্ধনগুলো নড়বড়ে হয়ে পড়াটা ক্রমে দৃশ্যমান হচ্ছে। ছোটরা বড়দের অভিজ্ঞতা নিতে চাইছে না। শুধু তা-ই নয়, অবজ্ঞা করছে; কিছু ক্ষেত্রে অসম্মানের পর্যায়ে পৌঁছেছে মা–বাবার সঙ্গে সন্তানদের সম্পর্ক; শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক বেসামাল হয়ে পড়েছে। শুধু ছয় ইঞ্চি বাই আড়াই ইঞ্চি প্রস্থের একটি স্মার্ট যন্ত্রই তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ

হয়ে উঠছে।

এআই বিতর্কের অন্যতম কণ্ঠস্বর গ্যারি মার্কাস লিখেছেন, ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা জগতে কিছু অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটছে এবং তার সবটাই সুখবর নয়।’ ২০২২ সালে চ্যাটজিপিটি চালু হওয়ার ঘটনাকে কম্পিউটার মেশিনের ‘জুরাসিক পার্ক মুহূর্ত’ বলে তিনি বর্ণনা করেন। গ্যারি মার্কাস সতর্ক করেন, হলিউডের পরিচালক স্টিভেন স্পিলবার্গের জুরাসিক পার্ক-এর ঘটনার মতোই পরিস্থিতি মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।

নিক বোস্ট্রম এ সময়ের একজন দার্শনিক। তিনি নৈতিক মূল্যবোধ সৃষ্ট প্রতিবন্ধকতার প্রভাব নিয়ে অনুসন্ধান করেন। অ্যান্থ্রোপোলজিক্যাল এথিকস বা নৃতাত্ত্বিক নীতির ওপর তাঁর কাজ বিজ্ঞান ও দর্শনে নির্বাচন প্রভাবের পর্যবেক্ষণের ভূমিকাকে সম্পর্কযুক্ত করে। সুপার–ইন্টেলিজেন্স পাথ ডেঞ্জার, স্ট্র্যাটেজি শিরোনামের একটি বই লেখেন তিনি ২০১৪ সালে। এতে তিনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অগ্রগতির সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে আলোচনা করেছেন, যা সুপার–ইন্টেলিজেন্সের দিকে পরিচালিত করে। তিনি সুপার–ইন্টেলিজেন্সকে সংজ্ঞায়িত করেন, এমন বুদ্ধি, যেটি কার্যত সব আগ্রহের ক্ষেত্রে মানুষের জ্ঞানগত কর্মক্ষমতাকে ছাড়িয়ে যায়। বোস্ট্রম সুপার–ইন্টেলিজেন্সকে একটি সুযোগ এবং একই সঙ্গে এটিকে অস্তিত্বের ঝুঁকি হিসেবে দেখেন। তিনি এআই বিকাশের সঙ্গে যুক্ত ঝুঁকি কমাতে সতর্ক কৌশলের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। এজিআইয়ের ভবিষ্যৎ অন্বেষণে নিক বোস্ট্রম আমাদের সতর্কতার সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য অনুরোধ করেন। কারণ, আমরা এমন এক সময়কে নির্দেশ করছি, যেখানে বুদ্ধিমত্তা আমাদের অতিক্রম করে যেতে পারে ২০৩০-এর মধ্যে।

তাই স্মার্টফোনসহ এআই–সংক্রান্ত ব্যাপারে আমাদের সচেতনতা বৃদ্ধি জরুরি।

লেখক: বিজ্ঞানবক্তা; সম্পাদক, মহাবৃত্ত

*লেখাটি ২০২৫ সালে বিজ্ঞানচিন্তার এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত