এক্সপোজার ট্রায়াঙ্গেল

এই তো, দুই দশক আগেও ছবি তোলা ছিল রীতিমতো ঝক্কির ব্যাপার। প্লাস্টিক বা কাঠের তৈরি ক্যামেরার খোলসের ভেতরে থাকত রাসায়নিক মেশানো প্লাস্টিকের ফিল্ম। বাইরের অংশে থাকত লেন্স। লেন্সের মধ্য দিয়ে আলো ঢোকার জন্য থাকত ছোট্ট একটি জানালা বা শাটার। বস্তু থেকে প্রতিফলিত আলোর ঝলক লেন্সের মধ্য দিয়ে গিয়ে পড়ত ওই ফিল্মের ওপর। ফিল্ম সেই আলোর ছাপ ধরে রাখত। তারপর দক্ষ হাতে সেই ফিল্মকে রাসায়নিক তরলে চুবিয়ে কাগজে ফুটিয়ে তোলা হতো ছবি। সেই কাগজ শুকাতে সময় দিতে হতো। কাগজ শুকানোর পরে দেখা যেত আসল ছবি। ক্লান্তিকর প্রক্রিয়া!

তারপর এল ডিজিটাল ক্যামেরার যুগ। ফিল্মের বদলে ছবি তৈরি হতে লাগল ইলেকট্রনিক চিপে, ডিজিটাল সিগন্যাল হিসেবে। ছবি তোলার সময়ই সরাসরি দেখা যায় ডিজিটাল ক্যামেরার ডিসপ্লেতে। কালের আবর্তে এখন সবার হাতে হাতে স্মার্টফোন। হাতে হাতে ক্যামেরা। আলতো করে স্ক্রিনে ছুঁয়ে দিলেই হয়, উঠে যায় দারুণ সব ছবি।

ছবি তোলার মাধ্যম পাল্টালেও ক্যামেরার মৌলিক বিষয়গুলো কিন্তু একই আছে। অর্থাৎ প্রতিফলিত আলো ধরে ছবি তৈরির ব্যাপারটিতে কোনো পরিবর্তন আসেনি। এখনও লেন্সের সেই জানালা বা শাটার আছে। তবে রাসায়নিক মেশানো ফিল্মের জায়গা নিয়েছে ইমেজ সেন্সর ও মেমরি চিপ।

ভালো ছবি তুলতে ক্যামেরার আলো নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। আলো নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিকে বলা হয় এক্সপোজার। আর এই আলো নিয়ন্ত্রণের জন্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয় এর তিনটি মৌলিক বিষয়। অ্যাপারচার, শাটার স্পিড এবং ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড অরগানাইজেশন বা আইএসও। এগুলোকে একসঙ্গে বলা হয় এক্সোপোজার ট্রায়াঙ্গেল। 

শুরুতে যে লেন্সের জানালা (চাইলে দরজাও বলতে পারেন) বা শাটারের কথা বললাম, তার পরিমাপকেই বলা হয় অ্যাপারচার। ইমেজ সেন্সরে কতটুকু আলো প্রবেশ করবে, তা নির্ভর করে অ্যাপারচারের ওপর। অ্যাপারচার যত বেশি, লেন্সের মধ্যে দিয়ে তত বেশি আলো প্রবেশ করবে সেন্সরে।

শাটার স্পিড হচ্ছে লেন্সের দরজাটি কত দ্রুত খুলবে ও বন্ধ হবে, তার পরিমাপ। অ্যাপার্চার যেখানে লেন্সে আলো প্রবেশ করার জায়গার পরিমাণ বোঝায়, শাটার স্পিড সেখানে বোঝায় আলো প্রবেশের সময়। শাটার স্পিড যত বেশি, তত কম সময় ধরে আলো প্রবেশ করবে সেন্সরে।

এবার আসা যাক আইএসও-র কথায়। ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড অরগানাইজেশন—এর সংক্ষিপ্ত রূপ আইএসও। ক্যামেরার আলোক-সংবেদনশীল সেন্সর আলোর প্রতি কতটা সংবেদনশীল, তার আদর্শ পরিমাপ এই আইএসও। আইএসও বেশি হওয়ার অর্থ, আলোর প্রতি সেন্সরটি বেশি সংবেদনশীল।

এক্সপোজার ট্রায়াঙ্গেল
আপনি যদি উজ্জ্বল আলোয় গতিশীল কোনো কিছুর স্থির ছবি তুলতে চান, তাহলে আপনার শাটার স্পিড হতে হবে দ্রুত।

উদাহরণ দিলে বিষয়গুলো পরিষ্কার হবে। ক্যামেরাকে যদি আমরা মানুষের ব্রেনের সঙ্গে তুলনা করি, তাহলে অ্যাপারচার কাজ করে চোখের পাতার মতো। চোখের পাতা যত বেশি খুলে রাখবেন, তত বিস্তৃত পরিসরে আলো এসে পড়বে চোখে। চোখের পলক ফেলার ব্যাপারটিকে তুলনা করা যায় শাটার স্পিডের সঙ্গে। আর আইএসও হলো সানগ্লাসের মতো। সানগ্লাস গাঢ় হলে আলোর প্রতি চোখের সংবেদনশীলতা কমে যায়। 

এই তিনটি বিষয় নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ভালো এক্সপোজার তৈরি করা যায়। এগুলোর কোনো একটি পরিবর্তন করলে পুরো ছবিতেই আসে তার প্রভাব। ছবির বিষয়বস্তু, পরিবেশে আলোর পরিমাণ, ছবি তোলার উদ্দেশ্য— এগুলোর ওপরে নির্ভর করে কোন বিষয়টি কতখানি পরিবর্তন করতে হবে বা কীরকম রাখতে হবে।

যেমন আপনি যদি উজ্জ্বল আলোয় গতিশীল কোনো কিছুর স্থির ছবি তুলতে চান, তাহলে আপনার শাটার স্পিড হতে হবে দ্রুত। শাটার স্পিড যত দ্রুত হবে, তত কম সময়ের ছবি পাবেন আপনি। অতিদ্রুত শাটার স্পিড হলে, অল্প সময়ের জন্য বস্তুটির প্রায় স্থির ছবি পাবে ক্যামেরা। শাটার স্পিড কম হলে আসবে ঝাপসা ছবি।

আইএসও বেশি হওয়ার অর্থ, আলোর প্রতি সেন্সরটি বেশি সংবেদনশীল

একইসঙ্গে অ্যাপারচারের কথা ভুললে কিন্তু চলবে না। অ্যাপারচার মানে আপনার লেন্সের জানালা কতখানি খুলছে, তার পরিমাপ। অ্যাপারচার যদি কম হয়, অর্থাৎ জানালা যদি অল্প একটু খোলে, তাহলে শাটার স্পিড অনেক বেশি হলেও আপনি পাবেন কম আলোর ছবি। বড় অ্যাপাচার অনেক বড় এলাকার আলো আসার সুযোগ করে দেয় সেন্সরে। তাই ওয়াইড অ্যাঙ্গেল ছবি তোলার জন্য অ্যাপারচার বেশি হওয়া প্রধান শর্ত। আবার আপনি যদি খুব কাছের কোনকিছুকে ফোকাস করে পেছনে অস্পষ্ট বা ব্লার করে দিতে চান, তাহলে অ্যাপারচার কম হওয়া দরকার।

আবার কম আলোতে ছবি তোলার জন্য আইএসও বেশি হওয়া ভালো।

এক্সোপোজার ট্রায়াঙ্গেল এসব কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। মানেটা বুঝতেই পারছেন। ভালো ছবি তুলতে হলে আপনার পরিচয় থাকতে হবে এগুলোর সঙ্গে। বর্তমানে প্রায় সব ডিজিটাল ক্যামেরা এবং স্মার্টফোনে এক্সোপোজারের এই বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ থাকে। স্মার্টফোনের ক্যামেরার সেটিংস থেকে এগুলো ঠিক করে নিতে পারবেন।

ফোন বা ক্যামেরার স্পেসিফিকেশনও এই ব্যাপারগুলো দেওয়া থাকে। অ্যাপারচার কত, শাটার স্পিড কেমন, আইএসও কেমন- এগুলো দেখে নিতে পারেন ফোন বা ক্যামেরা কেনার আগেই।

লেখক : শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা

সূত্র : ওয়ান্ডারোপোলিস