লাফিফা জামাল: অনেক প্রতিষ্ঠানই আইওটি ডিভাইস তৈরির কাজ করছে। দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে জাপানে স্মার্ট হোম তৈরিতে বা সৌদি আরবে পানির সমস্যা নিরসনে আমাদের দেশ থেকে আইওটি ডিভাইস তৈরি হচ্ছে। আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা এই কাজগুলো করে। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে বের হয়নি যেসব শিক্ষার্থী, তারাও বাইরের কাজ করছে দেশে বসেই। এই সুযোগগুলো আছে। দেশের ভেতরে কর্মক্ষেত্র এখনো অতটা প্রসারিত হয়নি। এ ছাড়া রোবোটিকসের সঙ্গে মেকাট্রনিকসের একটা যোগ আছে। এ রকম কাজ অবশ্য ওয়ালটনসহ আরও দু–একটা প্রতিষ্ঠান করছে। এই খাতে আমাদের ছেলেমেয়েদের কাজ করার সুযোগ আছে। সামনে আরও সুযোগ বাড়বে। তবে রোবট ম্যানুফ্যাকচারিংেয়র কাজ এখানে এখনো শুরু হয়নি। সফটওয়্যার–বেজড কাজ অনেক হলেও হার্ডওয়্যার তৈরির ব্যাপারটা এখনো সেভাবে শুরু হয়নি।
বিজ্ঞানচিন্তা: রোবোটিকসের সঙ্গে মেকাট্রনিকসের সম্পর্কটা একটু বুঝিয়ে বলবেন কি?
লাফিফা জামাল: মেকাট্রনিকসকে আমরা আসলে বলি মেকানিক্যাল প্লাস ইলেকট্রনিকস। বিভিন্ন ম্যানুফ্যাকচারিং প্ল্যান্টগুলোয় জিও অটোমেশন হয়। এই কাজগুলো যেসব যন্ত্র করছে, সেগুলো পুরোপুরি রোবট নয়। যন্ত্রগুলোর একটা রোবোটিক হাত থাকে। প্যাকেজিংয়ে যেটা হয়, বেল্ট থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, প্যাকেজিং করে ফেলছি। সব জায়গায়ই মেকাট্রনিকস অ্যাপ্লিকেশনস নিয়ে ভাবা হচ্ছে। কোনো একটা কন্ট্রোল সিস্টেম যদি আমরা তৈরি করতে চাই, সেখানে পাচ্ছি।
বিজ্ঞানচিন্তা: রোবোটিকসে গবেষণার জন্য বা উচ্চশিক্ষার জন্য যাঁরা দেশের বাইরে যেতে চান, তাঁদের জন্য সুযোগটা কেমন? তাঁদের কী করা উচিত? আপনারা তাঁদের জন্য কী করেন?
লাফিফা জামাল: উচ্চশিক্ষার জন্য বাইরে যাওয়ার সুযোগ আছে। প্রযুক্তি বিষয়ে যারা পড়াশোনা করছে তাদের জন্য নর্থ যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপ, জাপান, কোরিয়ায় উচ্চশিক্ষার সুযোগ আছে। গবেষণার কাজগুলো করার জন্য এবং কর্মক্ষেত্রের জন্য অনেক সুযোগ আছে। উচ্চশিক্ষায় বাইরে পড়ার জন্য একদম ফুল ফান্ডের সুযোগ থাকে। মাস্টার্স বলেন বা পিএইচডি—দুই লেভেলেই।
বিজ্ঞানচিন্তা: মেয়েদের রোবোটিকসে বিশেষ আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। অন্য অলিম্পিয়াডে মেয়েদের অংশগ্রহণ কম। মেয়েরা কেন রোবোটিকসের দিকে বেশি ঝুঁকছেন? এর সুদূরপ্রসারী ফলাফল কেমন?
লাফিফা জামাল: গণিত অলিম্পিয়াডে দেখা যায়, প্রাইমারি লেভেলে প্রচুর মেয়ে থাকে। জুনিয়র থেকে সেকেন্ডারিতে একটু কমে যায়। সেকেন্ডারি থেকে যখন হায়ার সেকেন্ডারিতে যাচ্ছে, তখন আরও কমে যায়। মানে, ওরা কিন্তু শুরুটা করে। ধীরে ধীরে ঝরে পড়ে। এখানে অনেকগুলো কারণ থাকে। একধরনের সংস্কার আছে সমাজে—গণিত খুব কঠিন বিষয়, ওটা মেয়েদের জন্য নয়। এ ধরনের মনোভাব মেয়েদের ঝরে যাওয়ার বড় কারণ। ছেলেমেয়েরা সরাসরি মা–বাবার মাধ্যমে পরিচালিত হয়। কোনো একটা মেয়ে ম্যাথ অলিম্পিয়াডে হয়তো জেলা পর্যায়ে পুরস্কার পেল, পরে বিভাগীয় পর্যায়ে যেতে হবে, তারপর জাতীয় পর্যায়ে যাবে? অনেক দূর থেকে ঢাকায় আসতে হবে। মেয়েকে ঢাকায় নিয়ে আসা, কোথায় থাকবে, কোথায় কী করবে—মেয়েদের নিয়ে একধরনের দুশ্চিন্তা থাকে অভিভাবকদের মনে।
রোবট অলিম্পিয়াডে একটা সুবিধা আছে। আন্তর্জাতিক গণিত বা ফিজিকস অলিম্পিয়াডে বাচ্চারা যেতে পারে না। সুতরাং বাচ্চারা অনেকেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলে সেকেন্ডারি পর্যন্ত যাওয়ার আগে। মেয়েদের ক্ষেত্রে এটা বেশি। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক রোবট অলিম্পিয়াডে প্রাথমিক স্তরের বাচ্চারাও যেতে পারে। আমি মনে করি, এটা একটা পজিটিভ দিক। অন্যরা যখন দেখে, একটা আট বছরের বাচ্চা রোবট অলিম্পিয়াডের কল্যাণে থাইল্যান্ড-ফিলিপাইনে যাচ্ছে, তখন অভিভাবকেরা উৎসাহিত হন। অন্য বাচ্চারা অনুপ্রাণিত হয়। ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সুযোগ থাকে আন্তর্জাতিক রোবট অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ করার। তাই এক-দুবার ব্যর্থ হলেও হাল ছাড়ে না। তা ছাড়া দল হিসেবে অলিম্পিয়াডে অংশ নিতে পারে বলে অভিভাবকেরাও অনেকটা নিশ্চিন্ত বোধ করেন। মেয়েদের ঝরে পড়ার হার তাই অনেক কম।
এ বছর জুনিয়র গ্রুপে দুজন ও সিনিয়র গ্রুপে একজন মেয়ে শিক্ষার্থী স্বর্ণপদক জিতেছে। ওরাও কিন্তু রোল মডেল হিসেবে কাজ করছে। তা ছাড়া ওরা যখন রোবট অলিম্পিয়াডের নেতৃত্বের জায়গায় একজন নারীকে দেখে সেটাও ওদের উৎসাহ যোগায়। আমরা কিন্তু চেষ্টা করি মেয়েদের জন্য আলাদা ক্যাম্প করার। মেয়েদের মধ্যে আরেকটু আগ্রহ তৈরি করার জন্য।
বিজ্ঞানচিন্তা: রোবট অলিম্পিয়াড আপনারা শুরু করেছেন ২০১৮ সালে। এত কম সময়ের মধ্যেই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আপনাদের সাফল্য অনেক। এটা কীভাবে এল?
লাফিফা জামাল: আমি মনে করি, সব খারাপেরই ভালো দিক আছে। আমাদের এখানে রোবোটিকস কিট খুব বেশি পাওয়া যায় না। যেগুলো বাজারে আছে, সেগুলোর দামও অনেক, মানে নাগালের বাইরে। এত টাকা দিয়ে বাচ্চাকে কে কিনে দেবে জিনিস? প্রথমবার আন্তর্জাতিক অলিম্পিয়াডে গিয়ে, বাচ্চাদের-আমাদের—সবার মন খারাপ হয়েছিল। অন্য দেশের বাচ্চারা কত ভালো ভালো কিট দিয়ে কাজ করছে। আমাদের বাচ্চাদের কিছুই নেই। সেটাই বরং শাপেবর হয়ে আসে আমাদের জন্য। ওরা একদম স্ক্র্যাচ থেকে কাজ করে, আরডুইনো দিয়ে প্রোগ্রামিং করছে। ওয়্যারিং-সোল্ডারিং করছে। ধোলাইখালে মা–বাবাকে নিয়ে গিয়ে একটা পার্টস বানিয়ে নিয়ে এসেছে। বিচারকদের কাছে বিষয়টা অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। যে বাচ্চা কিটস জোড়া দিয়ে শুধু প্রোগ্রামিংটা করেছে, তাদের চেয়ে যে বাচ্চা সবকিছু নিজে নিজে করছে, তাদের দক্ষতা অনেক বেশি বলে মনে করেন বিচারকেরা। সুতরাং অন্যদের টপকে আমাদের বাচ্চারা ঠিকই পুরস্কার পেয়ে যাচ্ছে।
এই সাফল্য অন্য দেশের কোচ-দলনেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তারা আমাদের কাছে আসে, জানতে চায় আমাদের সাফল্যের রহস্য। প্রথম দিকে আমরা ওদের জিজ্ঞেস করতাম ওরা কীভাবে কাজ করে? এখন ওরা আমাদের কাছে আসছে। এটা দারুণ ব্যাপার।
আমরা প্রচুর ওয়ার্কশপ ক্যাম্প করি সারা বছর—শুধু অলিম্পিয়াডের সময় নয়। এখন আমরা টিওটি করছি। ট্রেনার তৈরি করছি। তারপর ট্রেনিং শুরু করব।
বিজ্ঞানচিন্তা: একটা গুজব আছে যে ভবিষ্যতে শ্রমিকদের বিকল্প হিসেবে রোবট কাজ করবে। শুধু শ্রমিক নয়, অনেক জায়গায় কর্মকর্তাদের বিকল্প হয়ে উঠবে। এখানে মানুষের কর্মহীন হয়ে পড়ার কোনো আশঙ্কা আছে কি না?
লাফিফা জামাল: এটা খুব কমন প্রশ্ন। আমরা সব সময় এই প্রশ্নের মুখোমুখি হই। আমরা তো দেখি, আমাদের দেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি হলো আনস্কিলড লেবাররা। কয়জনই–বা হাই স্কিল কাজ করে? ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম–২০২১-এর রিপোর্ট বলছে, প্রচুর মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়বে ঠিক, তেমনি প্রচুর নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরি হবে। আমরা সবাই অনার্স-মাস্টার্স করার জন্য পাগল হয়ে যাই। আমাদের কতজন পলিটেকনিকে পড়তে চায়? পলিটেকনিকে যায় কোথাও চান্স না পেয়ে। কিন্তু ওখানে কাজ করলে আপনার সুযোগ আছে। কাজেই আমি যেটা বলি, দিনমজুরের কাজ বা পোশাকশ্রমিকের কাজ, এই জায়গাগুলোয় যত বেশি অটোমেশন হবে, তত আমাদের শ্রমিকের সংখ্যা কমে যাবে। এ জন্য সরকারিভাবে এই উদ্যোগ নেওয়া দরকার। ব্যক্তিগতভাবে বা বেসরকারি লেভেলে সম্ভব নয়। সেটা অটোমেশন শুরু হওয়ার পর নিলে হবে না। এখন নিতে হবে। এই মানুষদের দক্ষ করে তুলতে হবে। অটোমেশন হলো মানুষ আর রোবটের সমন্বয়ে কাজ। মানে কিন্তু পুরো কাজটাই রোবট করবে না; বরং রোবট ও মানুষের পারস্পরিক সহায়তায় কাজ হবে, যাকে আমরা বলি কোবট বা কলাবরেটিভ রোবট। রোবট কাজ করছে, সেগুলোকে অপারেট করতে মানুষ লাগবে—দক্ষ মানুষ। হয়তো ১০০ জনের জায়গায় ২০ জন লাগবে। ৮০ জনকে তাহলে কী করতে হবে? তাদের স্কিল ডেভেলপ করাতে হবে। সার্টিফিকেট, পরীক্ষায় পাস—এসব দেখে চাকরি পাওয়ার সময় কিন্তু শেষ। জিপিএ–৫ বা ফার্স্ট ক্লাস—এসব কাজ দেবে না। শিগগির দক্ষতাই হবে যোগ্যতার মাপকাঠি। তাই দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরির উদ্যোগ এখনই নিতে হবে।
বিজ্ঞানচিন্তা: এবার কিছু ব্যক্তিগত প্রশ্ন করি। আপনার ছোটবেলা সম্পর্কে বলুন। বড় হয়ে কী হতে চেয়েছিলেন?
লাফিফা জামাল: ছোটবেলায় পাইলট হওয়ার খুব শখ ছিল। প্লেন চালাব, আকাশে আকাশে ঘুরব। ওই ইচ্ছা সময়ের সঙ্গে বদলে গেছে। তারপর মনে হলো, শিক্ষক হব এবং শিক্ষক হলেও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিষয়েই শিক্ষক হবো।
বিজ্ঞানচিন্তা: আপনার শৈশব কেটেছে কোথায়? লেখাপড়া?
লাফিফা জামাল: জন্ম-বেড়ে ওঠা নারায়ণগঞ্জে। নারায়ণগঞ্জ প্রিপারেটরি স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা। তারপর নারায়ণগঞ্জ গভর্নমেন্ট গার্লস হাইস্কুল, এরপর ভিকারুননিসা নূন কলেজ। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর।
বিজ্ঞানচিন্তা: আপনার পরিবার সম্পর্কে একটু বলেন। আপনার মা–বাবা?
লাফিফা জামাল: ১১ মাস বয়সে বাবাকে হারিয়েছি। আমার ভাই-বোন নেই। মা এখনো আছেন সিঙ্গেল প্যারেন্ট হিসেবে। যৌথ পরিবারে বড় হয়েছি। চাচা-চাচি, চাচাতো ভাইবোনদের সঙ্গে। এমনকি আমার বাবার চাচাতো ভাইবোন, তাঁদের ছেলেমেয়ে—সবাইকে নিয়েই আমাদের বিশাল যৌথ পরিবার ছিল। তাই একাকিত্ব ব্যাপারটা অতটা অনুভব করিনি। তারপরও দিন শেষে ভাইবোন নেই, বাবা নেই। সেই একাকীত্বটা কিন্তু কোন কিছু দিয়েই মুছে ফেলা যায় না।
বিজ্ঞানচিন্তা: নারীদের ক্ষেত্রে সমস্যাটা এখনো রয়ে গেছে। উচ্চশিক্ষায় তাঁরা বাধাগ্রস্ত হন। আপনার অভিজ্ঞতা কেমন?
লাফিফা জামাল: এ ক্ষেত্রে আমার ভাগ্যটা ভালো ছিল। বিয়ের আগপর্যন্ত পরিবারের নিরঙ্কুশ সমর্থন পেয়েছি। পরে আমার শ্বশুর-শাশুড়ি, স্বামী—সবাই আমার লেখাপড়া, ক্যারিয়ারে সমর্থন দিয়েছেন। বেশির ভাগ নারীই এই সমর্থন পান না। বিয়ের পর আমার শাশুড়ি প্রথম দিনই বলেছিলেন, ‘খুব শখ ছিল আমার ছেলেমেয়েরা পিএইচডি করবে। ওরা কেউ সেটা করেনি। তুমি শখটা পূরণ কোরো। রান্নাঘরে তোমার কাজ করতে হবে না। সেটা আমি দেখব।’
বিজ্ঞানচিন্তা: আপনি পিএইচডি কোথায় করেছেন?
লাফিফা জামাল: পিএইচডি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ড. হাফিজ মুহাম্মদ হাসান বাবু স্যারের তত্ত্বাবধানে। বিদেশে যাইনি আমার পরিবারের কারণে, বিশেষ করে আমার মায়ের জন্য। আমার দেশের বাইরে না যাওয়ার মূল কারণ আমার মা।
বিজ্ঞানচিন্তা: আপনি যে পজিশনে আছেন, আমাদের দেশে পিএইচডি করেও এই পজিশনে আসা সম্ভব—এটাও একটা উদাহরণ। আমাদের কিন্তু এ রকম একটা ধারণা সমাজে প্রচলিত আছে যে দেশে পিএইচডি করে সফল হওয়া যায় না।
লাফিফা জামাল: আমার পিএইচডি সুপারভাইজারের অনেক বড় কৃতিত্ব এখানে। তিনি প্রথম দিনই আমাকে কিছু টার্গেট ধরিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘দুটো হাই ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর জার্নাল আর দুটো ইইইর স্টার লেভেলের কনফারেন্স—চারটা জিনিস যত দিন না দেবে, তত দিন তোমার ডিগ্রি হবে না।’ এতে আমার পাঁচ বছরের বেশি সময় লেগেছে। নরমালি বাংলাদেশে তিন বছরে পিএইচডি হয়ে যায়। কিন্তু কাজটা করেছি আমি ঠিকঠাকমতো।
বিজ্ঞানচিন্তা: আপনার বর্তমান পরিবার সম্পর্কে বলুন।
লাফিফা জামাল: আমার স্বামী ব্যবসা করেন। আমার ছেলে এখন ক্লাস টুয়েলভে, মেয়ে ক্লাস নাইনে। দুজনেরই প্রযুক্তির প্রতি ভালোবাসা আছে। আমার মেয়ে শুরু থেকেই রোবট অলিম্পিয়াডে অংশ নিচ্ছে। প্রথমবার আন্তর্জাতিক রোবট অলিম্পিয়াডে অনারেবল মেনশন পায়। ২০১৯–এ একটা রৌপ্যপদক পায়। ২০২০-এ একটা স্বর্ণপদক ও একটা রৌপ্যপদক পায়, ২০২১–এ একটা সোনা ও একটা ব্রোঞ্জ পেয়েছে। ছেলে ন্যাশনাল আইসিটি কুইজ কনটেস্টে এ বছরের চ্যাম্পিয়ন। প্রোগ্রামিংয়ে আগ্রহ আছে, ম্যাথ অলিম্পিয়াডেও বিভাগীয় পর্যায় পর্যন্ত গেছে।
বিজ্ঞানচিন্তা: বিজ্ঞান-প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে নারী হিসেবে কোনো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন কি না?
লাফিফা জামাল: আমাদের সামাজিক একটা দৃষ্টিভঙ্গি থাকে। ধরুন, আমি ভালো করছি। আমাকে তুলনা দেওয়ার জন্য বলে যে তিনি নারী হিসেবে ভালো করছেন। আমি নারী হিসেবে ভালো করছি না, আমি একজন আইসিটি প্রফেশনাল বা একজন ফ্যাকাল্টি হিসেবে ভালো করছি। অনেক পুরুষ সহকর্মীর চেয়ে ভালো করছি। কিন্তু তুলনা করার সময় বলে, আমি একজন নারী হিসেবে ভালো করছি। এটা নিয়ে একটা কষ্ট তো থাকেই।
আমি একাডেমিয়াতে আছি, এই জায়গায় নারী-পুরুষের বিভেদটা একটু কম। তা ছাড়া নতুন বিভাগে নেতৃত্বের জায়গায় থেকেছি বলে বৈষম্যের শিকার কম হয়েছি।
বিজ্ঞানচিন্তা: এত কাজের মধ্যে বই পড়ার অবসর পান?
লাফিফা জামাল: সত্যিই এখন পাই না। ছোটবেলায় প্রচুর বই পড়তাম। বাসায় প্রচুর বই ছিল। আমার লাইব্রেরি আছে। আমার খাটের ডিজাইনটা এমনভাবে করা, এর সঙ্গে একটা বইয়ের তাক যুক্ত করা আছে। যেসব বই পড়ি, সেগুলো এই তাকে রেখে দিই। কিন্তু খুব বেশি পড়া হয় না। বই নিয়ে কয়েক পৃষ্ঠা পড়ার পরই ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে যাই। তবে আবার শুরু করেছি। কোভিডের সময় বহুদিন ঘরবন্দী ছিলাম। প্রচুর বই পড়েছি ওই সময়। তখন আমার মনে হয়েছে, একটা সময় নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম, সেটা আবার ফিরে পেয়েছি। আমি গান শুনতেও পছন্দ করি।
বিজ্ঞানচিন্তা: এমন একটা বইয়ের নাম বলুন, যেটা তরুণ প্রজন্মের সবারই পড়া উচিত।
লাফিফা জামাল: তরুণ প্রজন্মকে বলব, একটা হচ্ছে সাহিত্যচর্চা বা সাহিত্যের বই পড়া উচিত সবার। আরেকটা হচ্ছে, আমাদের নিজেদের ইতিহাসকে জানা। কারও বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ থাকবে, কারও আগ্রহ থাকবে না। কিন্তু বই পড়ার অভ্যাস সবারই থাকা উচিত। এর পাশাপাশি দেশের ইতিহাসটা জানো। আমাদের বঙ্গবন্ধুকে জানা উচিত। তিতিনি দলমত নির্বিশেষে আমাদের দেশের সবার নেতা। যে রাজনৈতিক বিশ্বাসেই থাকি না কেন, বঙ্গবন্ধুর লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইটা প্রত্যেকের পড়া উচিত।
বিজ্ঞানচিন্তা: আপনার প্রিয় বই কোনটি?
লাফিফা জামাল: আমার খুব পছন্দের বই হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষের কবিতা। আগে খুব সুন্দর একটা অডিও ছিল এটার। ওই অডিওটা ক্যাসেটে শুনতাম। অডিওটা কিন্তু পুরো নয়, বইয়ের কিছু খণ্ডিত অংশ। সত্যি বলতে কি, শেষের কবিতা আমার মুখস্থ।
বিজ্ঞানচিন্তা: বিজ্ঞানচিন্তার কিশোর-তরুণ পাঠকদের জন্য কিছু বলুন।
লাফিফা জামাল: কিশোর-তরুণদের জন্য আমার পরামর্শ হলো—পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করা বা জিপিএ–৫ পাওয়া জীবনের মূল উদ্দেশ্য নয়। এখান থেকে বের হয়ে আসতে হবে। আমাদের সার্টিফিকেটনির্ভর পড়াশোনাটা এখনো আছে। সে ক্ষেত্রে আমাদের একটা রেজাল্ট দরকার হয়। তাই বলে এটাই জীবনের সবকিছু নয়। এটা অনেক কিছুর মধ্যে একটা। আরেকটা পরামর্শ হলো, কোনো না কোনো স্কিল ডেভেলপ করতেই হবে। সর্বোপরি ভালো মানুষ হওয়াটা জরুরি। সবকিছু ভেস্তে যাবে, যদি মানুষ হিসেবে ভালো না হই।
বিজ্ঞানচিন্তা: ধন্যবাদ আপনাকে।
লাফিফা জামাল: বিজ্ঞানচিন্তাকেও ধন্যবাদ।
অনুলিখন: আহমাদ মুদ্দাসসের