এআই কি বেকারত্ব বাড়াবে
ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিক যদি শুনতে পছন্দ করেন, তাহলে গুগলে প্রায় এক বছর আগের একটা ডুডল আপনার চোখ এড়ানো মুশকিল। কারণ, সেই ডুডলে বিখ্যাত একজন মিউজিশিয়ান সেবাস্তিয়ান বাখের কার্টুন আঁকা ছিল। সেটাতে ক্লিক করতেই ব্যাখ্যা ভেসে উঠেছিল, ২১ মার্চ বাখের জন্মদিন উপলক্ষে গুগল তাদের একটা রিসার্চ + ফান প্রজেক্ট হিসেবে বাখের মতো মিউজিক বানানোর একটা ডুডল বানিয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, মিউজিকটা কিন্তু মানুষ বানাবে না, বানাবে একটা কম্পিউটার, যে কিনা অন/অফ বা ০/১ ছাড়া আর কিছুই বোঝে না! ব্যবহারকারীকে শুধু ৬-৭টি এলোমেলো নোট বা তাল সিলেক্ট করে দিতে হতো। বাকিটা কম্পিউটার নিজেই বুঝে নেবে, কীভাবে সেই সুরের সঙ্গে আরও অন্যান্য সুর জুড়ে অসাধারণ একটি মিউজিক বানানো যায়, যে সুরে সেবাস্তিয়ান বাখের একটা ধাঁচ থাকবে। কম্পিউটার এ কাজ করছে মেশিন লার্নিং পদ্ধতিতে। মেশিন লার্নিং হচ্ছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের (এআই) অন্যতম একটা মৌলিক ভিত্তি। বাখের প্রায় ৩০৬টি মিউজিক শিট একটা কম্পিউটার শিখে নিয়ে কৌশল রপ্ত করে প্রায় তাঁর মতোই পটু হয়ে ওঠে। (চাইলে এই লিংকে গিয়ে এআইয়ের বানানো ছোট একটা মিউজিক শুনে আসতে পারেন://g.co/doodle/zqll5)
এটা তো গেল মজার একটা ডুডল হিসেবে এআইয়ের ব্যবহার। মনেই হতে পারে, বাস্তবে এর ক্ষেত্র কী? আদৌ কোনো কাজে আসে এ জিনিস? উত্তর হচ্ছে, এর কাজের ক্ষেত্র বিশাল। চলুন সেটা নিয়েই কিছুক্ষণ কথা বলা যাক।
ফেসবুক ইউটিউব আমরা কমবেশি সবাই ব্যবহার করি। বিশেষ করে ফেসবুকের বিজ্ঞাপনের সঙ্গে আমরা সবাই মোটামুটি পরিচিত। এখানেও অনেকেরই মজার অভিজ্ঞতা আছে। হয়তো দেখা গেল, কেউ একবার গুগলে সার্চ দিয়েছিলেন কিছু ইলেকট্রনিক পার্টসের সন্ধান করে। এরপরের এক সপ্তাহ ফেসবুকে শুধু দেশি-বিদেশি লাখ লাখ ইলেকট্রনিক পার্টসের দোকানের বিজ্ঞাপন দেখে দেখে হয়তো তিনি অতিষ্ঠ হয়ে গেছেন। এই যে কাজটা ফেসবুক করছে বিজ্ঞাপন নিয়ে, একেই বলা হয় টার্গেটেড অ্যাডভার্টাইজমেন্ট।
বর্তমানে শেয়ারবাজারেও এআইয়ের ব্যবহার প্রচুর। শেয়ারের মূল্য আগাম আঁচ করাতে, ভবিষ্যতে কোন পণ্যের চাহিদা কেমন হবে, তা অনুমান করতে এআই প্রতিনিয়ত ব্যবহৃত হচ্ছে। কিছু সোজা উদাহরণ দেওয়া যাক।
একজন মানুষ কী কী সার্চ করছে বা কোন ধরনের জিনিস কত সময় ধরে দেখছে, কী ধরনের ওয়েবসাইটে কত সময় ধরে থাকছে, এসব তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণ করে সেই মানুষের রুচি বা প্রয়োজন আঁচ করে নেয় একটা এআই। সেই অনুযায়ীই তাকে পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন জিনিসের বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়, যেটা তার রুচি বা প্রয়োজনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। মানুষের রুচি বা প্রয়োজন বুঝে সে অনুযায়ী বিজ্ঞাপন দেওয়া অসম্ভব কঠিন ও সময়সাপেক্ষ একটা কাজ। আগে যে কাজ বিভিন্ন কোম্পানি মানুষের কাছে জিজ্ঞেস করে করে নিয়ে একটা মডেল দাঁড় করিয়ে পরিসংখ্যানবিদ, অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ে অভিজ্ঞ লোকজনের একটা টিমের সাহায্যে তৈরি করত, সে কাজ এখন একটা মোটামুটি ভালো মানের কম্পিউটারই করে দিতে পারে মানুষের স্মার্টফোন বা কম্পিউটারে সার্চ করা তথ্য বিশ্লেষণ করে, মানুষের তুলনায় আরও অনেক কম সময়ে। এতে বিভিন্ন কোম্পানি তাদের মুনাফা অনেক গুণ বাড়াতে পেরেছে।
বর্তমানে শেয়ারবাজারেও এআইয়ের ব্যবহার প্রচুর। শেয়ারের মূল্য আগাম আঁচ করাতে, ভবিষ্যতে কোন পণ্যের চাহিদা কেমন হবে, তা অনুমান করতে এআই প্রতিনিয়ত ব্যবহৃত হচ্ছে। কিছু সোজা উদাহরণ দেওয়া যাক। ধরা যাক, একটা কোম্পানি আছে, যারা সাবান বিক্রি করে। তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী আরেকটা কোম্পানিও সাবান বিক্রি করে। তারা তখন গত কয়েক বছরের ক্রয়-বিক্রয় ও মুনাফার তথ্য এআইয়ের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেবে কীভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এগিয়ে থাকা যায়। অনেক ক্ষেত্রে এআই নিজে থেকেই তাদের পরামর্শ দেয়, কখন কী করা উচিত। সে অনুযায়ী তারা তাদের ব্যবসার মডেল ঠিক করে নেয়। যে কাজ আগে করতে মাসের পর মাস লাগত বিশাল এক টিমের, সে কাজ এখন একটি কম্পিউটার কয়েক দিনের মধ্যেই করে দিতে সক্ষম! তাই যেসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এআইয়ের ক্ষমতা ব্যবহার করা শিখে নিয়েছে, তারা অত্যন্ত সফলও হয়েছে। আমাজন নামের প্রতিষ্ঠানটি এর একটি জ্বলন্ত উদাহরণ।
গুগল ট্রান্সলেট অ্যাপ্লিকেশনটি একটি মজার অ্যাপ, আপনারা চাইলেই আপনাদের স্মার্টফোনে অ্যাপটি ইনস্টল করতে পারেন। ধরা যাক, এই অ্যাপে ইংরেজি থেকে জার্মান অনুবাদ করার অপশন সিলেক্ট করলেন। এরপর একটা অ্যাপের ভেতরে ক্যামেরার আইকনে চাপ দিলেন। দেখবেন মুঠোফোনের ক্যামেরা চালু হয়ে গেছে। এরপর আপনি ক্যামেরাটি কোনো ইংরেজি লেখার দিকে তাক করলেই দেখবেন, আপনার মুঠোফোনের স্ক্রিনেই সঙ্গে সঙ্গে সেটার জার্মান অনুবাদ দেখাচ্ছে! এই ম্যাজিকের মতো কাজটা সম্ভব হয়েছে ইমেজ প্রসেসিংয়ের মাধ্যমে। প্রথমে আপনার ফোনের ক্যামেরা ইংরেজি লেখাটার ছবিটা দেখে এবং ছবি থেকে টেক্সট বা লেখা উদ্ধার করে। কাজটা করার জন্য অ্যাপ্লিকেশনটিকে লাখ লাখ ইংরেজি টেক্সট বা লেখা শেখানো হয়েছে, বিভিন্ন ফন্টে বা স্টাইলে, কম্পিউটার কম্পোজে লেখা বা হাতে লেখা। সফটওয়্যারটি সেই বিশাল তথ্যভান্ডার ও পূর্ব অভিজ্ঞতার সঙ্গে আপনার ক্যামেরা তাক করা লেখার তুলনা করে এবং অক্ষরগুলো শনাক্ত করে।
ধরুন, চিকিৎসকের কাছে একজন রোগী গেলেন। চিকিৎসক তাঁকে বললেন, তাঁর স্তন ক্যানসার আছে। তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়লেন। তবে তিন মাস পর চিকিৎসক তাঁকে বললেন, আসলে তাঁর ক্যানসার নেই, ফলস পজিটিভ (ভুলক্রমে পজিটিভ ডায়াগনোসিস) এসেছিল।
শনাক্ত করা হয়ে গেলে বাকি কাজ তো সোজা, শুধু অনুবাদ করা। লেখা শনাক্ত করার এই প্রক্রিয়াকে অপটিক্যাল ক্যারেক্টার রিকগনিশন (ওসিআর) বলা হয়। তবে সেটা খুব স্বল্প পরিসর ও স্বল্প কিছু ফন্ট স্টাইলের জন্যই কাজ করে। এর থেকে সর্বাধিক আউটপুট পাওয়ার জন্য এর সঙ্গে মেশিন লার্নিং সমন্বয় করা হয়। ইমেজ প্রসেসিংয়ের সঙ্গে যখন মেশিন লার্নিং যুক্ত হয়, তখন তা অসাধারণ শক্তিশালী একটা প্রযুক্তি হয়ে ওঠে। শুধু অনুবাদে না, অপরাধী শনাক্ত করতে, স্যাটেলাইটে তোলা ছবি থেকে শত্রুরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটির দুর্বলতা বের করতে, রাস্তার ট্রাফিক জ্যামের অবস্থা বের করতে, চেহারা শনাক্ত করতে ও আরও নানা কাজে ইমেজ প্রসেসিং ও এআই সমন্বয় করে ব্যবহার করা হয়। মানুষের চলাফেরা অনুকরণ করে সেই ডেটা সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণ করা হয়, যাতে হিউম্যানয়েড রোবট বানালে সেটা যতটা ভালো সম্ভব মানুষের অঙ্গভঙ্গি অনুকরণ করতে পারে।
ধরুন, চিকিৎসকের কাছে একজন রোগী গেলেন। চিকিৎসক তাঁকে বললেন, তাঁর স্তন ক্যানসার আছে। তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়লেন। তবে তিন মাস পর চিকিৎসক তাঁকে বললেন, আসলে তাঁর ক্যানসার নেই, ফলস পজিটিভ (ভুলক্রমে পজিটিভ ডায়াগনোসিস) এসেছিল। আবার এমনও হয়েছে, যে রোগীকে চিকিৎসক বলেছেন স্তনে টিউমার আছে, তবে তা ক্ষতিকর নয় এবং বেশ কিছুদিন পর তাঁরা আবার মত পাল্টে বলেছেন, তা টিউমার নয়, ক্যানসার (একে ফলস নেগেটিভ বলে)। এমন ঘটনা কিন্তু একটা নয়, হাজারবার ঘটেছে। তবে এখন আমাদের হাতে এমন প্রযুক্তি এসেছে যে আমরা ফলস পজিটিভ বা নেগেটিভের সংখ্যা অনেক কমিয়ে আনতে পেরেছি। এআই এখন অত্যন্ত নিপুণ ও দক্ষভাবে স্তন ক্যানসার নির্ণয় করতে পারে। সাধারণত ম্যামোগ্রাফির রিপোর্ট তিনজন রেডিওলজিস্ট দেখে সমন্বিতভাবে সিদ্ধান্ত দেন ক্যানসার আছে কি নেই। তবে এখন একটা এআই–সমৃদ্ধ সফটওয়্যার আরও নিখুঁতভাবে বলে দিতে সক্ষম তিনজন দক্ষ ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন রেডিওলজিস্টের টিমের চেয়ে। এমনকি এআইয়ের ভুলের হার মানুষের চেয়ে কম, ফলস পজিটিভে প্রায় ১.২ শতাংশ কম ও ফলস নেগেটিভে প্রায় ২.৭ শতাংশ কম। শতকরা সংখ্যাটা কম মনে হলেও হাজারজনের ক্ষেত্রে চিন্তা করলে তা কিন্তু অনেক! এক হাজারে প্রায় ২৭টা ফলস নেগেটিভ কমে এসেছে, যেটা অসাধারণ অগ্রগতি।
এআই দেখভাল করতে হলেও মানুষ লাগবে। এটা ঠিক, এআই ও অটোমেশনের কারণে লাখ লাখ লোক চাকরি হারাবেন, বিশেষ করে যাঁরা ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন বা গাড়ি চালনা করেন।
এআইয়ের এত সব প্রয়োগ বাস্তব জীবনে, তাহলে কি এআই আমাদের ছাড়িয়ে যাবে? আমাদের সব চাকরি কি এআই নিয়ে নেবে? অনেক মুভি বা টিভি সিরিজ দেখে হয়তো আমাদের মনে হতেই পারে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, এআই এখনো একটা চলমান গবেষণা। এর অনেক কিছুই এখনো অনেক উন্নত করা বাকি। আর মানুষের প্রয়োজন কখনোই শেষ হবে না। কারণ, এআই দেখভাল করতে হলেও মানুষ লাগবে। এটা ঠিক, এআই ও অটোমেশনের কারণে লাখ লাখ লোক চাকরি হারাবেন, বিশেষ করে যাঁরা ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন বা গাড়ি চালনা করেন। তবে তাঁদের দক্ষ করে গড়ে তোলা হলে তাঁরা আরও নতুন ও ভালো চাকরি পাবেন। এ ক্ষেত্রে অবশ্য বড় করপোরেশনগুলোর সহায়তা ও ভালো উদ্দেশ্য থাকা অত্যাবশ্যক। এআই মানবসভ্যতার জন্য একটা নতুন মোড়, যা আমাদের ইতিহাসের গতিপথ পাল্টে দেবে। মানব ইতিহাসে খুব কম ঘটনাই কিন্তু ইতিহাসকে পাল্টেছে, যেমন ইউরোপের বিউবেনিক প্লেগ, নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র আবিষ্কার, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ইত্যাদি। আমরা যে আমাদের জীবদ্দশায় ইতিহাসকে মোড় নেওয়ানো এ রকম একটা ঘটনার সাক্ষী হতে যাচ্ছি, তা–ই তো অনেক! বুদ্ধিমানের কাজ হবে শুধু দর্শকের ভূমিকায় না থেকে প্রযুক্তিজ্ঞানে দক্ষ হয়ে ইতিহাস পরিবর্তনে সরাসরি অংশ নেওয়া।