সম্প্রতি গুগল একটি নতুন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মডেল বা এআই মডেল তৈরি করেছে। নাম ডলফিনগেমা। নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে, এই মডেলের সঙ্গে ডলফিনের একটা সম্পর্ক আছে। ঠিক তাই, এই এআই মডেল দিয়ে ডলফিনের ভাষা বোঝা যাবে। ভবিষ্যতে এর সাহায্যে মানুষ হয়তো ডলফিনের সঙ্গে কথাবার্তাও বলতে পারবে।
পৃথিবীতে কিছু প্রাণী আছে যাদের বুদ্ধি আর সামাজিক জীবন আমাদের চমকে দেয়। এদের মধ্যে অন্যতম ডলফিন। ডলফিনেরা নিজেদের মধ্যে নানা জটিল শব্দের সাহায্যে যোগাযোগ করে। কিন্তু এতদিন ধরে বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করেও সে ভাষা বুঝতে পারেনি। ওদের শব্দ বোঝার মতো প্রযুক্তি আগে আমাদের ছিল না। কিন্তু এখন নতুন এই এআই মডেল সেই সীমাবদ্ধতা ভেঙে দিতে পারে।
গবেষকেরা ডলফিনগেমার সঙ্গে একটা বিশেষ যন্ত্র ব্যবহার করবেন। এই যন্ত্রের নাম সিটাসিয়ান হিয়ারিং অগমেন্টেশন টেলিমেট্রি বা সংক্ষেপে চ্যাট (CHAT)। এই চ্যাট সিস্টেম এখন পরীক্ষা করে দেখবে, মানুষের তৈরি শব্দ বা শিস ডলফিনদের শেখানো যায় কি না এবং ওরা সেই শব্দ ব্যবহার করে আমাদের কিছু বোঝাতে পারে কি না। যদি সবকিছু ঠিকভাবে চলে, তাহলে গবেষকদের ৪০ বছরের শ্রম সার্থক হবে।
১৯৮৫ সাল থেকে ওয়াইল্ড ডলফিন প্রজেক্টের (WDP) আয়তায় বিজ্ঞানীরা ডলফিনের ভাষা বোঝার কাজ করছেন। টানা ৪ দশক ধরে এই বিজ্ঞানীরা যুক্তরাষ্ট্রের বাহামা দ্বীপপুঞ্জের আটলান্টিক স্পটেড ডলফিনদের নিয়ে গবেষণা করছেন। এই সময়ে বিজ্ঞানীরা ডলফিনের অনেক অডিও এবং ভিডিও সংগ্রহ করেছেন। সংগ্রহিত অডিও ও ভিডিওতে ডলফিনদের সব ধরণের শব্দ, আচরণ, খেলা, ঝগড়া এমনকি প্রেম নিবেদনের বিষয়ও রেকর্ড আছে। ডলফিনও অনেকটা মানুষের মতো নিজেদের নাম ধরে ডাকে, বন্ধুকে আলাদা করে চেনে, এবং পছন্দ-অপছন্দ প্রকাশ করতে পারে।
তবে এসব তথ্য থাকা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত মানুষ ডলফিনের ভাষা বুঝতে পারেনি। কারণ, আমাদের প্রযুক্তি এখনো ডলফিনের ভাষা বোঝার মতো পর্যায়ে পৌঁছায়নি। কিন্তু এখন আমাদের হাতে আছে লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল বা এলএলএম। চ্যাটজিপিটি বা জেমিনি যেমন মানুষের ভাষা বুঝে পরের শব্দ অনুমান করতে পারে, ডলফিনের ক্ষেত্রেও এলএলএম তা করতে পারবে কি না, তা বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করছেন।
এই সম্ভাবনা পরীক্ষা করার জন্য ডব্লিউডিপি সম্প্রতি গুগল এবং যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। তারা ইঞ্জিনিয়ারদের ডলফিনের বিভিন্ন শিস, ক্লিক আর দ্রুতগতির আওয়াজের বিশাল ডেটা দিয়েছে। এসব ডেটা দিয়ে এলএলএমকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। আর সেই চেষ্টার ফলই হলো ডলফিনগেমা। প্রায় ৪০ কোটি প্যারামিটার বা প্রোগ্রামিং বৈশিষ্ট্য দিয়ে তৈরি ডলফিনগেমা অনেকটা চ্যাটজিপিটির মতোই কাজ করবে। তবে সেটা মানুষের জন্য নয়, ডলফিনদের জন্য!
কিন্তু এআই মডেল এই কাজটা কীভাবে করবে? ডলফিনগেমা প্রথমে ডলফিনের ডাকের অডিও ইনপুট নেবে এবং সেটা বুঝবে। তারপর সেই ইনপুট অনুযায়ী সম্ভাব্য পরবর্তী আওয়াজ তৈরি করবে। এরপর এ মডেলটি চ্যাট (CHAT) সিস্টেমের সঙ্গে যুক্ত করা হবে। চ্যাট সিস্টেমটি লাগানো থাকবে মডিফাইড গুগল পিক্সেল স্মার্টফোনে। চ্যাট সিস্টেম ডলফিনের পুরো ভাষা বুঝিয়ে দিতে পারবে না, তবে মানুষকে ডলফিনদের সঙ্গে যোগাযোগের একটা সহজ ও সাধারণ শব্দভাণ্ডার তৈরি করতে সাহায্য করবে।
সংশ্লিষ্ট গবেষকদের পরিকল্পনা, ডব্লিউডিপির আটলান্টিক স্পটেড ডলফিনদের কিছু কৃত্রিম শিস শেখানো। যেমন সী-গ্রাস (সামুদ্রিক ঘাস) বা সারগ্যাসাম (এক ধরনের সামুদ্রিক শৈবাল)। এগুলো প্রথমে ডলফিনকে শেখানো হবে। ডলফিন একবার এই শিস শিখে নিলে দেখা হবে, ডলফিন ওদের পছন্দ মতো সী-গ্রাস বা সারগ্যাসাম চাইতে পারে কি না। যদি ডলফিন নিজ থেকে কখনো শিষ দিয়ে এসব জিনিস চায়, তাহলে বুঝতে হবে ওরা শিষের অর্থ বুঝতে পেরেছে।
এই সবকিছু এখনো পরীক্ষামূলক পর্যায়ে আছে। পুরোপুরি ডলফিন ভাষা শেখা কিংবা তাদের সঙ্গে সাবলীলভাবে কথা বলা এখনো অনেক দূরের স্বপ্ন। কিন্তু ডলফিনেগেমা এবং চ্যাট সেই স্বপ্নের দিকেই আমাদের আরও একধাপ এগিয়ে দিতে পারে।
একদিন হয়তো সত্যিই সমুদ্রে নেমে আমরা ডলফিনের সঙ্গে কথা বলতে পারব। ডলফিনও হয়তো নিজের সুখ-দুঃখের কথা আমাদের বলতে পারবে। একটা ডলফিন আমাদের সঙ্গে কথা বলবে, ভাবা যায়!
