প্রযুক্তি
রোবোটিকস ও বাংলাদেশ
রোবোটিকসের হাত ধরে নতুন শিল্পবিপ্লবের দিকে এগিয়ে চলেছে বিশ্ব। কারখানার কর্মী, নাবিক, সৈনিক, ওয়েটার, এমনকি বুদ্ধিবৃত্তিক কাজেও মানুষকে সরিয়ে জায়গা করে নিতে শুরু করেছে রোবট। এতে অনেক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। তবে রোবট–বিপ্লবের অন্য সম্ভাবনাও দেখেছেন বিশেষজ্ঞরা। সেই চ্যালেঞ্জ নিতে বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত?
রোবট শব্দটা একেবারেই শোনেনি, খুব সম্ভবত তেমন কাউকে পাওয়া যাবে না। বিশেষ করে সায়েন্স ফিকশনে আমরা দেখি, মানুষের মতো দেখতে-চলতে পারে এমন কিছু যন্ত্র মানুষের চেয়েও দ্রুত নানা কাজ করে ফেলছে, মানুষের সঙ্গে কোনো কোনো ক্ষেত্রে যুদ্ধ করে পৃথিবী দখল করে ফেলছে, আরও কত কী! অনেকের ধারণা হতে পারে, মানুষের মতো দেখতে এ রকম বিভিন্ন যন্ত্রকে রোবট বলা যায়।
কথাটা একদিকে সত্য, আবার একদিকে একটু ভুল। রোবট হতে হলে একটা যন্ত্র হতেই হবে, এটা সত্য। কিন্তু রোবটের নির্দিষ্ট সংজ্ঞা দেওয়া কঠিন। যেমন ব্রিটানিকা ডিকশনারিতে বলা আছে, কোনো একটি যন্ত্র যদি মানুষের সাহায্য ছাড়া নিজে নিজে একটি কাজ করে ফেলতে পারে এবং মানুষের কোনো পরিশ্রম বা কাজের পরিমাণ কমিয়ে ফেলতে পারে, তাহলে সেটাকেই রোবট বলা যাবে।
তাহলে কাপড় ধোয়ার মেশিন কি একটি রোবট? কারণ, মানুষের সাহায্য ছাড়াই তো ওয়াশিং মেশিন কাপড় ধুয়ে শুকিয়েও ফেলতে পারে! এর উত্তর বের করার দায়িত্ব থাকল পাঠকের ওপরই।
আবার আইইইই (ইনস্টিটিউট অব ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারস) বলে যেকোনো একটি ডিভাইস যদি তিনটি কাজ করতে পারে, তাহলেই তাকে রোবট বলা যাবে। এক. সেন্স (কোনো কিছু অনুভব করা), দুই. ডিসিশন (যা অনুভব করলাম, সেটা থেকে হিসাব-নিকাশ করে একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া), তিন. অ্যাকশন (যা সিদ্ধান্ত নিলাম, সে অনুযায়ী কোনো একটা কাজ করা)।
ক্যালকুলেটর কি তাহলে একটি রোবট? কারণ, ক্যালকুলেটরে কোনো সংখ্যা, কোনো চিহ্ন চাপলে সেটা ক্যালকুলেটর বুঝতে পারে। কিছু করতে বললে সেটা হিসাব-নিকাশ করে নিজে একটা সিদ্ধান্ত নেয় এবং সে অনুযায়ী ক্যালকুলেটরের ডিসপ্লেতে দেখিয়েও দেয় একটা ফলাফল। তাহলে ক্যালকুলেটরকে কি রোবট আদৌ বলা যায়?
আসলে সব রোবটবিজ্ঞানী একই রকম সংজ্ঞা মেনে নিতে একমত নন, একেকজন একেকভাবে রোবটের সংজ্ঞা দেন। তবে একটা জিনিসে মোটামুটি সবাই একমত, রোবট হতে হলে মানুষের মতোই দেখতে হবে, মানুষের মতোই আচরণ করতে হবে এমন নয়। এ ছাড়া আরও অনেক যন্ত্রকে রোবট বলা যাবে।
তবে কোন যন্ত্রকে রোবট বলা যাবে, সেটির মাপকাঠি হিসেবে আইইইইর সংজ্ঞা অনুসরণ করাই উত্তম। অর্থাৎ কোনো যন্ত্র কোনো কিছু সম্পর্কে নিজে অনুভব করতে পারে, হিসাব-নিকাশ করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে ও সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নিজে একটা কাজ করতে পারলেই তাকে রোবট বলা যাবে।
রোবটের কর্মপরিধি
আজকাল বিভিন্ন রোবট দিয়ে বিভিন্ন ধরনের কাজ করানো যায়! কোনো রোবট হয়তো হেঁটে বেড়ায় তো কোনো রোবট আকাশে উড়ে বেড়ায়, আবার কোনো রোবট পানিতে বিচরণ করে! আবার কোনো রোবট হয়তো ডাক্তারকে সাহায্য করে অপারেশন করার সময়, কোনো রোবট হয়তো সকালে এক কাপ চা বানিয়ে দেয়! কোনো রোবট একটা কয়েনের চেয়েও ছোট! আবার কোনো রোবট একটি ট্রাকের চেয়েও বিশাল বড়!
বিশেষ করে মানুষের পক্ষে করা মুশকিল, এমন যেকোনো কাজে এখন রোবটকেই ব্যবহার করতে চেষ্টা করা হয়। কোথাও হয়তো আগুন লাগল, মানুষ ভেতরে ঢুকতে পারছে না, তখন সেখানে রোবট পাঠিয়ে দেওয়া হয় মানুষকে উদ্ধার করতে। আবার কোনো জায়গায় হয়তো মানুষ পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছে, সেখানেও চটজলদি রোবট গিয়ে হাজির! আবার এমনও রোবট আছে যে মানুষকে পড়ালেখা শিখতে সাহায্য করবে, আবার কোনো রোবট হয়তো দেশকে রক্ষা করতে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি কাজ করে! এমন কোটি কোটি আলাদা রকমের কাজ করার রোবট পৃথিবীতে আছে! তবে রোবট কোন পরিবেশে বা কীভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়, এসবের ভিত্তিতে রোবটকে বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করা হয়।
স্থির বনাম চলমান রোবট
সচরাচর কোনো রোবট চিন্তা করলেই আমাদের মাথায় আসে রোবট এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় উড়ে যাচ্ছে বা হেঁটে যাচ্ছে ইত্যাদি। এ ধরনের রোবটকে চলমান রোবট বা মোবাইল রোবট বলা হয়। রোবটে চাকা থাকতে পারে চলার জন্য, পা থাকতে পারে হাঁটার জন্য, পাখা থাকতে পারে আকাশে ওড়ার জন্য। বিভিন্ন উপকরণ রোবটকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে সাহায্য করবে। যেমন আমরা ছবিতে একটি চলমান রোবট কোবরাকে দেখতে পাচ্ছি (ছবি ১)। ভূমিকম্পে কোনো এলাকায় ভবন ধসে মানুষ কোনো ভবনের নিচে আটকে পড়লে, তখন সেসব মানুষকে উদ্ধারে কোবরাকে ব্যবহার করা যায়।
কিন্তু কিছু রোবট আছে, যারা এক জায়গাতেই সব সময় স্থির থাকে, অন্য জায়গায় কখনো যেতে পারে না। অর্থাৎ এসব রোবটে কোনো চাকা, পা, পাখা এসব জিনিস থাকে না। এসব রোবট এক জায়গায় স্থির থাকলেও অনুভূতি থাকে, এক জায়গায় স্থির থেকেই রোবোটিক আর্ম (কৃত্রিম হাত) বা অন্য কোনো একচুয়েটর দিয়ে নির্দিষ্ট কাজ করতে ব্যস্ত থাকে। যেমন ছবিতে (ছবি ২) আমরা দ্য ভিঞ্চি নামের একটি রোবট দেখতে পাচ্ছি। ওই রোবট কোথাও যেতে পারে না। কিন্তু রোবটটি তার রোবোটিক আর্ম দিয়ে সূক্ষ্ম অস্ত্রোপচার করতে পারে। ফলে চিকিৎসাক্ষেত্রে অনেক জটিল অস্ত্রোপচার এখন করা সম্ভব হচ্ছে। কাজেই এটা একটা স্থির (Stationary) রোবট।
স্বয়ংক্রিয় বনাম নিয়ন্ত্রিত রোবট
কিছু রোবট নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ করতে পারে, মানুষের কাছ থেকে কোনো নির্দেশ নিয়ে চলতে হয় না। এগুলোকে স্বয়ংক্রিয় (autonomous) রোবট বলা হয়। অনেক সময় এসব রোবটে নতুন পরিবেশ থেকে শিখে নেওয়ার প্রোগ্রাম করে দেওয়া যায়। ছবিতে (ছবি ৩) আমরা রুম্বা নামের একটি ভ্যাকুয়াম ক্লিনার রোবট দেখতে পাচ্ছি। ওই রোবট একটি বাড়ির ভেতরে প্রতিটি কক্ষে ঘুরে বেড়ায়, নিজেই বিভিন্ন স্থানে পড়ে থাকা ময়লা শনাক্ত করে তা পরিষ্কার করতে পারে।
আবার কিছু রোবট মানুষ নিজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এগুলোকে নিয়ন্ত্রিত (manually controlled) রোবট বলা হয়। ওপরে আমরা যে দ্য ভিঞ্চি রোবট সম্পর্কে জেনেছিলাম, সেটি একটি নিয়ন্ত্রিত রোবট। রোবটটি নিজেই সরাসরি অস্ত্রোপচার করতে পারে না, অভিজ্ঞ চিকিৎসকের নির্দেশ অনুসরণ করে এটি অস্ত্রোপচার করে থাকে। তবে কিছু রোবট আছে, যেখানে স্বয়ংক্রিয় ও নিয়ন্ত্রিত দুটি মোডই থাকে ও চাইলে নির্ধারণ করা যায়, কখন রোবট স্বয়ংক্রিয় চলবে, কখন মানুষ নিয়ন্ত্রণ করবে।
রোবট বানাতে প্রয়োজনীয় উপকরণ
যেকোনো রোবটে মোটামুটি ছয়টি প্রধান উপকরণ থাকে। নিচে এগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
১. রোবটের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ হলো পরিবেশ থেকে বিভিন্ন অনুভূতি ইনপুট হিসেবে গ্রহণ করা। আমরা যদি মানব শরীরের সঙ্গে তুলনা করি, আমাদের পঞ্চেন্দ্রিয় (নাক, কান, চোখ, জিব ও ত্বক) দিয়ে আমরা বিভিন্ন রকম অনুভূতি পাই। তেমনি রোবটে ইনপুট দেওয়ার জন্য বাটন বা সুইচ, বিভিন্ন সেন্সর, ক্যামেরাসহ অনেক ডিভাইস ব্যবহার করা যায়।
২. রোবট অনুভূতি গ্রহণ করার পর প্রাপ্ত তথ্য থেকে নির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে রোবটের সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য প্রয়োজন হয় প্রসেসর। প্রসেসর মানে যে প্রসেস করে বা প্রক্রিয়াজাত করে! আমাদের মস্তিষ্ক যেমন আমাদের যেকোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেয়, ঠিক তেমনি মাইক্রোপ্রসেসর, মাইক্রোকন্ট্রোলার ইত্যাদি রোবটে প্রসেসর হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মূলত এগুলো হচ্ছে একটা চিপ বা বিশেষ সার্কিট; যা রোবটের যাবতীয় সিদ্ধান্ত, অর্থাৎ রোবট কী করবে না করবে, সব সিদ্ধান্ত নেয়।
৩. সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর সেই অনুযায়ী রোবট একটি নির্দিষ্ট কাজ সম্পন্ন করে, তথা আউটপুট দেয়। যেমন মানুষ যখন মুখ দিয়ে কথা বলে, তখন মুখ থেকে নির্গত শব্দকে মানুষের আউটপুট হিসেবে চিন্তা করা যায়। তেমনি রোবটে আউটপুট দেওয়ার জন্য এলইডি, বাযার, ডিসপ্লে, বিভিন্ন অ্যাকচুয়েটর, মোটর, কৃত্রিম হাতসহ অনেক রকম আউটপুট ডিভাইস ব্যবহার করা যায়।
৪. রোবট নির্দিষ্ট কাজ সম্পন্ন করার পর সেই কাজের বিভিন্ন তথ্য সংরক্ষণ করতে চায়। আবার অনেক সময় রোবট তৈরি করার সময় বিভিন্ন কাজ কীভাবে করতে হবে, তা শিখিয়ে দেওয়া হয়। এই শেখানোর জন্য দরকার স্মৃতিশক্তি বা মেমোরি। রোবটে মেমোরি হিসেবে মুঠোফোনের মেমোরি কার্ড থেকে শুরু করে বিশাল হার্ডডিস্ক পর্যন্ত বিভিন্ন মেমোরি ডিভাইস ব্যবহার করা সম্ভব।
৫. যতক্ষণ পর্যন্ত রোবটে কোনো শক্তির উৎস দেওয়া হবে না, রোবট সচল হতে পারবে না। কোনো কাজ করতে গেলে মানুষের যেমন শক্তি লাগে ও মানুষ বিভিন্ন খাবার খেয়ে শক্তি সঞ্চয় করে শরীরে, ঠিক তেমনি রোবটেরও কাজ করার জন্য শক্তি লাগে। বিভিন্ন ধরনের ব্যাটারি, সোলার প্যানেলসহ নানা রকম শক্তির উৎস দিয়ে রোবটে শক্তি দেওয়া যায়।
৬. রোবট নিজে নিজে কিছু করতে পারে না, তাকে শিখিয়ে দিতে হয় কোন পরিস্থিতিতে সে কী কাজ করবে। এই কাজ করার জন্য রোবটকে বিশেষ নির্দেশনার সেট বা প্রোগ্রামিং লিখে দিতে হয়, অর্থাৎ ওপরে উল্লিখিত পাঁচটি হার্ডওয়্যার উপকরণের পাশাপাশি রোবটে সফটওয়্যার তথা নির্দিষ্ট প্রোগ্রামও থাকে।
কাজের ভিন্নতার ভিত্তিতে বিভিন্ন রকম রোবট এখন ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছে। এ রকম কিছু রোবটের কাজ সম্পর্কে আমরা জেনে নিই।
আকাশে ওড়ার রোবট
কিছু রোবট আকাশে উড়তে পারে অথবা মহাকাশে ঘুরে বেড়াতে পারে। যেমন কিউরিওসিটি একটি রোবট, যেটি ২০১২ সালে মঙ্গল গ্রহে গিয়ে সেখানে প্রাণের অস্তিত্ব নিয়ে নানা রকম গবেষণা করেছে।
গ্রাহক রোবট
কিছু রোবট বানানোই হয় যেন রোবটটি মানুষ নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারে। যেমন আমরা রুম্বা রোবট নিয়ে ওপরে আলোচনা করেছিলাম। এটিকে একটি গ্রাহক রোবট বলা যায়। এই রোবট খুব জনপ্রিয় ময়লা পরিষ্কারের জন্য।
দুর্যোগ মোকাবিলায় রোবট
কিছু রোবট বিভিন্ন রকম দুর্যোগে ব্যবহার করা যায়, যেখানে মানুষকে পাঠানো বিপজ্জনক।
২০১১ সালে জাপানে ভয়ংকর ভূমিকম্প ও সুনামি হয়। তখন আটকে পড়া মানুষকে উদ্ধার করতে প্যাকবট নামে একটি রোবট ব্যবহার করা হয়। ওই রোবট সিঁড়ি বেয়ে উঠতে ও মানুষকে উদ্ধারে সাহায্য করতে পারে।
ড্রোন
ড্রোনের সঙ্গে হয়তো অনেকেই পরিচিত! মানুষবিহীন রোবট, যেটা আকাশে ওড়ানো যায়, তাকে সচরাচর ড্রোন বলা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে, বিশেষ করে ফটোগ্রাফির কাজে অনেকেই ড্রোন ব্যবহার করছে। তবে ড্রোন দিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলের ও পরিবেশের নানা রকম তথ্য–উপাত্ত সংগ্রহ করা, দেশ প্রতিরক্ষার কাজে ব্যবহার করাসহ বিভিন্ন প্রয়োজনে ব্যবহার করা যায়।
শিক্ষাক্ষেত্রের রোবট
কিছু রোবট শিক্ষক হিসেবে ক্লাস নিতে পারে বা এমনভাবে ডিজাইন করা হয়, যেন কঠিন কোনো টেকনিক্যাল বিষয় ওই রোবট ব্যবহার করেই শিখে ফেলা যায়!
যেমন Cubelets নামের একটি রোবটে একগুচ্ছ কিউবের মতো ব্লক থাকে। এই ব্লকগুলোর ভেতরে বিশেষ চুম্বক থাকে। ছোট বাচ্চাদের এই রোবট দেওয়া হয়, যেন ওরা ব্লকগুলোকে একসঙ্গে জোড়া লাগিয়ে কোনো প্রোগ্রামিং না জেনেও বা তার জোড়া না লাগিয়েও নানা রকম কাজ করার রোবট বানিয়ে ফেলতে পারে! বাচ্চাদের রোবোটিকসের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেই অনেক জায়গায় এই রোবট ব্যবহার করা হয়। এই রোবটগুলো দিয়ে তাপমাত্রা, আলো, শব্দ ইত্যাদি অনুভব করিয়ে নানা রকম মজার কাজ করা যায়।
বিনোদনমূলক রোবট
এই রোবটগুলো ব্যবহার করা হয় মানুষকে বিভিন্নভাবে আনন্দ বা বিনোদন দেওয়ার জন্য। যেমন RoboThespian নামের একটি রোবট অভিনয় করতে পারে, কৌতুক বলতে পারে, ৩০টি ভাষায় কথা বলতে পারে! (ছবি ৫)
হিউমানয়েড রোবট
মানুষের মতো দেখতে ও মানুষের মতো নানা রকম কাজ করতে পারে, এমন রোবটকে হিউমানয়েড রোবট বলা হয়। যেমন সোফিয়া নামের একটি রোবট মানুষের মতো কথা বলতে পারে, নানা রকম আবেগ প্রকাশ করতে পারে বিভিন্ন মুখভঙ্গি দিয়ে এবং বুদ্ধিমান মানুষের মতো নানা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশে সোফিয়া এসেছিল। বাংলাদেশেও বেশ কিছু শিক্ষার্থী বিভিন্ন সময়ে কিছু হিউমানয়েড রোবট বানিয়েছেন।
ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবট
এই রোবটগুলো কলকারখানা ও শিল্পক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন নির্দিষ্ট কাজ করার জন্য। যেমন অটো (OTTO) নামের একটি রোবট গুদামঘরে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় মালামাল সরিয়ে নিয়ে রাখতে ব্যবহার করা হয়।
চিকিৎসাক্ষেত্রে রোবট
আজকাল খুব জটিল অস্ত্রোপচার করতেও অনেক সময় রোবটের সাহায্য নেওয়া হয়। আমরা ওপরে দ্য ভিঞ্চি নামের একটি রোবটের কথা জেনেছিলাম। এটি চিকিৎসাক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হয়।
গবেষণায় যুক্ত রোবট
বিভিন্ন রকম গবেষণায়ও রোবট ব্যবহার করা হয়। ওয়াল-ই (Wall-E) নামের একটি সাইফাই সিনেমায় ইভ (EVE) নামে একটি বিশেষ গবেষণা রোবটকে পৃথিবীতে পাঠানো হয় এই মুহূর্তে পৃথিবীতে গাছ বেঁচে থাকতে পারছে কি না, সেটা নিয়ে গবেষণা করতে।
স্বয়ংক্রিয় গাড়ি রোবট
আজকাল এ ধরনের রোবট নিয়ে প্রচুর গবেষণা হচ্ছে, যেখানে রোবট একটি গাড়ি হিসেবে নিজে নিজে সব সিদ্ধান্ত নিয়ে রাস্তায় চলতে পারে। বিশ্ববিখ্যাত প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান টেসলা এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে।
পানির নিচের রোবট
কিছু রোবট পানির নিচে চলতে পারে। যেমন অ্যাকুয়া২ (Aqua2) নামে একটি উভচর রোবট আছে, যেটি পানির নিচের পরিবেশের অবস্থা বুঝতে সাহায্য করে ও ছয়টি পা দিয়ে পানির নিচে, স্থলভূমিতে—দুই জায়গাতেই চলাচল করতে পারে (ছবি ৪)। এ ছাড়া নানা রকম কাজে রোবট ব্যবহার করা যায়। এখানে শুধু উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কাজে রোবটের ব্যবহার আলোচনা করা হয়েছে।
বাংলাদেশে রোবোটিকস
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে বাংলাদেশও কিন্তু রোবোটিকসের জগতে প্রবেশ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে চালু হয়েছে রোবোটিকস নিয়ে নতুন বিভাগ ও পড়াশোনার সুযোগ। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রোবোটিকস অ্যান্ড মেকাট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের সুযোগ আছে। এ ছাড়া মেকাট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ চালু আছে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ ইত্যাদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এ ছাড়া স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিভিন্ন রোবোটিকস ক্লাব গড়ে উঠেছে। অন্যদিকে শিল্পক্ষেত্রে রোবোটিকস ও অটোমেশনের ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে। পাশাপাশি ক্যারিয়ার বিবেচনায়ও দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেই এখন রোবোটিকস, অটোমেশন এবং ইন্টারনেট অব থিংসে দক্ষ জনবলের চাহিদা বাড়ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন আন্তর্জাতিক রোবট–সম্পর্কিত প্রতিযোগিতায় বাড়ছে বাংলাদেশিদের অংশগ্রহণ।
প্রতিবছরই আন্তর্জাতিক রোবট অলিম্পিয়াড, ওয়ার্ল্ড রোবট অলিম্পিয়াড, নাসা স্পেস অ্যাপ চ্যালেঞ্জ, ইউনিভার্সিটি রোভার চ্যালেঞ্জ, আন্তর্জাতিক রোভার চ্যালেঞ্জ, সিঙ্গাপুর অটোনমাস আন্ডারওয়াটার ভেহিকেল চ্যালেঞ্জসহ বিভিন্ন জনপ্রিয় আন্তর্জাতিক রোবোটিকস সম্পর্কিত প্রতিযোগিতায় সাফল্যের পদচিহ্ন রাখছেন বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা। বাংলাদেশে রোবোটিকস–সম্পর্কিত বিভিন্ন উপকরণ কেনার সবচেয়ে বড় পাইকারি মার্কেট ঢাকার সদরঘাটের কাছে পাটুয়াটুলী এলাকায়। সারা দেশের রোবোটিকস উপকরণের প্রধান অংশ এখান থেকেই সরবরাহ করা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন অনলাইন শপে এখন রোবোটিকস উপকরণ সহজলভ্য হয়েছে। মূলত চীন থেকে আমদানি করা হয় এসব উপকরণ। তবে উপকরণের পাশাপাশি মাতৃভাষা বাংলায় রোবোটিকস সম্পর্কিত বিভিন্ন বইও বর্তমানে সহজলভ্য। ফলে আগের তুলনায় রোবোটিকস ও রোবট নিয়ে কাজ করা আরও সহজ। রোবোটিকসে বাংলাদেশ এগিয়ে যাক আরও বহুদূর।
লেখক: সমন্বয়ক, বাংলাদেশ রোবট অলিম্পিয়াড
*লেখাটি বিজ্ঞানচিন্তা ২০২২ সালের মার্চ সংখ্যায় প্রকাশিত