১৮৭৪ সালের ঘটনা। নতুন এক ধরনের রাসায়নিক যৌগ আবিষ্কার করেছেন অস্ট্রিয়ান রসায়নবিদ অথমার জিডলার। সেটার নাম দিলেন ডাইক্লোরো-ডাইফিনাইল-ট্রাইক্লোরো-ইথিন। সংক্ষেপে ডিডিটি। দেখতে স্ফটিকের মতো। একেবারে স্বাদ-বর্ণ-গন্ধহীন। অল্প পানিতে দ্রবনীয়। কিন্তু একে ঠিক কী কাজে ব্যবহার করা যায়, সেটা বুঝতে পারলেন না জিডলার। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সেদিন নিজেও জানতে পারেননি, কী মারাত্মক এক বিষ আবিষ্কার করে বসেছেন তিনি।
এরপরের ঘটনা প্রায় ৬৫ বছর পরের। ১৯৩৯ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দোড়গোড়ায়। সুইজারল্যান্ডে সেবার ভয়ংকর খাদ্য ঘাটতি দেখা দিল। তার কারণ ফসলে ব্যাপক কীটপতঙ্গের আক্রমণ। এ সময় কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণের উপায় নিয়ে গবেষণা করছিলেন পল মুলার নামে এক সুইস রসায়নবিদ। তাঁর উদ্দেশ্য ফসলকে কীটপতঙ্গ থেকে রক্ষা করা। ওদিকে, রাশিয়ায় দেখা দিল টাইফাস মহামারী। প্রতিদিন মানুষ মারা যাচ্ছে। এর জন্যও দায়ী কীটপতঙ্গ। কিন্তু রোগটি প্রতিরোধে কেউ কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছে না। সেটা নিয়েও মাথা ঘামাচ্ছেন মুলার।
প্রায় ৫ বছর পর, ১৯৪৪ সালে কীটনাশক হিসেবে ডিডিটির ব্যবহার শুরু হয়। পরে ১৯৪৫ সালে বাণিজ্যিক ব্যবহারের পাশাপাশি ভেক্টর নিয়ন্ত্রণের জন্য জনবহুল এলাকায় শুরু হয় এর ব্যবহার।
ক্ষুদে কীটগুলোতে মারার জন্য গবেষণাগারে একজন মানুষ একের পর এক রাসায়নিক মেশাচ্ছেন। তারপর খাঁচায় রাখা ক্ষতিকর কীটপতঙ্গদের ওপর প্রয়োগ করে দেখছেন, সেগুলো কাজ করে কি না। এভাবে প্রায় চার বছর অক্লান্ত গবেষণা করে গেলেন। টানা ব্যর্থ হলেন ৩৪৯ বার। এরপর এলো তাঁর বৈজ্ঞানিক জীবনের ‘ইউরেকা মুহূর্ত’। একটা রাসায়নিক যৌগ পোকামাকড়ের ওপর ছিটাতেও সেগুলো সাথে সাথে মারা গেল। একেবারে অব্যর্থ লক্ষ্য। সেই রাসায়নিকটিই ছিল ডিডিটি। ঠিক এভাবেই রসায়নবিদ অথমার জিডলারের আবিষ্কৃত যৌগটির প্রয়োগিক ব্যবহার আবিষ্কার করলেন মুলার।
প্রায় ৫ বছর পর, ১৯৪৪ সালে কীটনাশক হিসেবে ডিডিটির ব্যবহার শুরু হয়। পরে ১৯৪৫ সালে বাণিজ্যিক ব্যবহারের পাশাপাশি ভেক্টর নিয়ন্ত্রণের জন্য জনবহুল এলাকায় শুরু হয় এর ব্যবহার। পাশাপাশি কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণের জন্য কৃষিতেও ডিডিটির ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিভিন্ন পোকামাকড় ছড়িয়ে পড়ে টাইফাস ও ম্যালেরিয়ায়। এসব রোগ থেকে সেনাসদস্য ও বেসামরিক নাগরিকদের বাঁচাতেও ব্যবহৃত হতো ডিডিটি। সবক্ষেত্রেই ব্যাপকভাবে সফল হতে থাকে রাসায়নিকটি। এরকম অব্যর্থ কীটনাশক আবিষ্কারের জন্য অচিরেই খ্যাতি, সম্মান, অর্থ পেতে থাকেন মুলার। ১৯৪৮ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞান ও শারীরতত্ত্বে নোবেল পুরষ্কার পান তিনি। কিন্তু কিছুদিন পরেই এই আবিষ্কারটাই যে মানবজাতির জন্য বুমেরাং হয়ে দাঁড়াবে, সে কথা কেউই ঘুর্ণাক্ষরে কল্পনা করতে পারেনি।
২.
১৯৬০ দশকের শেষ পর্যন্ত ডিডিটি ব্যবহার অব্যহত ছিল। এটি ম্যালেরিয়ার মতো রোগের ভেক্টর বা বাহকের বিরুদ্ধে সাফল্যের সঙ্গে ব্যবহার করা হয়। কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণে বিশ্বজুড়ে কৃষিতে ছিল এর দারুণ প্রভাব। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ডিডিটি স্প্রে করা হতো তুলোয়।
এ সময়ে ডিডিটি উচ্চমাত্রায় প্রয়োগের ফলে প্রায় ১০-১৫ বছর পর্যন্ত মাটিতে এর ৫০ শতাংশের মতো রয়ে যায়। এ সময় ডিডিটির অতিরিক্ত ব্যাবহারের ফলাফল টের পেতে শুরু করে মানুষ। প্রকৃতির ওপর দেখা যায় এর প্রভাব। ফসলী উদ্ভিদ থেকে শুরু করে নানারকম প্রাণী মারা যেতে থাকে এর ফলে। তখন পরিবেশবাদীরা এর বিরুদ্ধে সমাবেশ করেন। সচেতন করার চেষ্টা করেন সবাইকে।
১৯৭২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশ সুরক্ষা সংস্থা ডিডিটি নিষিদ্ধ করে। কারণ হিসেবে তারা বলে, লিপোফিলিক (লিপিডের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে, এমন যৌগ) বৈশিষ্ট্যের কারণে শিকারী পাখিদের দেহে ডিডিটি জমতে শুরু করে। সামুদ্রিক চিংড়ি, ক্রেফিশ, ড্যাফনিড ও বিভিন্ন প্রজাতির মাছের মতো সামুদ্রিক প্রাণীসহ জীবন্ত প্রাণীর জন্য এটি অত্যন্ত বিপদজনক। বেশিরভাগ সময় মাছ, মাংস ও দুগ্ধজাত খাবার থেকে মানবদেহে প্রবেশ করে ডিডিটি।
সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন-এর তথ্যমতে, ডিডিটি গর্ভবতী মহিলাদের বুকের দুধের মাধ্যমে শিশুদের আক্রান্ত করতে পারে। মানবদেহে এর প্রভাব অনেক বেড়ে গেলে বমি, কাঁপনি বা ঝাঁকিসহ বিভিন্ন ধরনের উপসর্গ দেখা যায়।
অনেক বছর ধরে ডিডিটি নিষিদ্ধ থাকার পরে ২০০৬ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডিডিটি নিয়ে তাদের মত পরিবর্তন করে। তারা স্বীকার করে নেয়, এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ম্যালেরিয়া প্রতিরোধের জন্য সেরা কীটনাশক ছিল। কালের আবর্তে মানুষ বুঝতে পারে, এর খারাপ ও ভালো, দুদিকই আছে। তবে এর অতিরিক্ত ব্যবহার অবশ্যই পরিবেশের ক্ষতি করে।
ম্যালেরিয়া রোগের জন্য দায়ী মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য এটি এখনো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। আমাদের দেশে প্রায় চার দশক আগে ম্যালেরিয়া মশা নিধনের জন্য ডিডিটি আনা হয়েছিল। পরে ১৯৮৯ সালে বিশ্বের আরও কয়েকটি দেশের মতো আমাদের দেশেও নিষিদ্ধ করা হয় এই ডিডিটি।
সব রাসায়নিকেরই ভালো-খারাপ দিক আছে। তবে যত ভালোই হোক, কোনো রাসায়নিকেরই মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার ভালো নয়। ডিডিটির গল্প আমাদের এ কথাই বলে। সঙ্গে আরও বলে, ভালো-খারাপ থেকে আমাদের ভালোটা বেছে নিতে হবে। এই ক্ষমতা, এই বেছে নেওয়ার কাজটি আমাদের। মানুষের।
লেখা: শিক্ষার্থী, কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র: সেন্টার ফর ডিজেস কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন,উইকিপিডিয়া