স্মার্টফোন যেভাবে আপনার সব তথ্য হাতিয়ে নেয়
আপনার পকেটের ফোনটিই কি শার্লক হোমস বা ফেলুদার চেয়েও বড় গোয়েন্দা? ভাবছেন, ফোন বন্ধ থাকলেই আপনি নিরাপদ? জিপিএস, ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট, স্যাটেলাইট থেকে শুরু করে ব্লুটুথ কীভাবে আপনার প্রতিটি মুহূর্তের তথ্য হাতিয়ে নিচ্ছে?
আপনার পকেটে থাকা স্মার্টফোন একটি গুপ্তচর। সিআইএ বা অন্যান্য সংস্থার গোয়েন্দাদের একসময় যা করতে লাখ লাখ ডলার খরচ হতো, আপনার ফোন এখন তা–ই করছে মুহূর্তের মধ্যে। পাশাপাশি প্রত্যেককে রাখছে নজরদারিতে। কারণ, ওই ফোনের মধ্যেই লুকিয়ে আছে এক ধূর্ত গোয়েন্দা। শার্লক হোমস বা ফেলুদার মতো বড় বড় গোয়েন্দাকেও সে হার মানাবে! তথ্য পাচারের এ বিষয় আপনার জানা থাক বা না থাক, তথ্য পাচার হবেই। আপনি কতটা ধনী কিংবা গরিব, ক্ষমতাবান নাকি সাধারণ আমজনতা—তাতে কিছু আসে–যায় না।
চলুন, সহজে বুঝিয়ে বলি কীভাবে এই ছোট্ট যন্ত্র আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত দেখছে। ধরুন, আপনি ফোন বন্ধ করে রেখেছেন। ভাবছেন, এখন তো নিরাপদ; কিন্তু না। ফোনের ক্যামেরা আর মাইক্রোফোন তখনো আপনার কথা শুনতে পারে, এমনকি তুলতে পারে ছবিও। শুধু এখানেই শেষ নয়, আপনার সেই তথ্য অন্য কারও কাছে পাঠিয়ে দেবে মুহূর্তেই, আপনি টেরও পাবেন না।
গুগল অ্যাসিস্ট্যান্ট বা সিরি নামে যে জিনিসগুলো আছে, সেগুলো সব সময় কান পেতে থাকে। ভাবছেন, আপনি কি কিছু জিজ্ঞাসা করবেন যে তার উত্তর দেওয়ার জন্য কান পেতে আছে? মোটেও না। আপনার সব তথ্য হাতিয়ে নেওয়ার জন্য ওই কান পাতা।
এনক্রিপশন বা গোপন কোড দিয়ে বার্তার কথাগুলো লুকানো যায় ঠিকই; কিন্তু যে বার্তা পাঠানো হচ্ছে, তা কোনোভাবেই লুকানো যায় না
এই যে ফোন দিয়ে গোয়েন্দাগিরির কথা বলছি, এটা কিন্তু নতুন কিছু নয়। গল্পটা শুরু হয়েছিল আরও অনেক আগে, উনিশ শতকে। তখন টেলিগ্রাফ মেশিন দিয়ে বার্তা পাঠানো হতো; কিন্তু বুদ্ধিমান সৈনিক আর ব্যবসায়ীরা তখনই বুঝে গিয়েছিলেন, বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় সংকেত যেখানে যাচ্ছে, সেখানেই কান পাতা যায়। তাঁরা তারের মধ্যে লুকানো অন্যের বার্তা পড়ে ফেলতে পারতেন। এভাবে সেনাবাহিনীর গোপন পরিকল্পনা থেকে শুরু করে শেয়ারবাজারের খবরও আগে পাওয়া যেত।
বিশ শতকে এসে স্যাটেলাইট আর নানা রকম যন্ত্র বসানো হলো মহাকাশে। তার পর থেকে মাটিতে থাকা যেকোনো যন্ত্রের সিগন্যাল ধরা শুরু হলো আকাশে। এমনকি বাচ্চাদের বেবি মনিটরের সিগন্যালও ধরা পড়ত ওসব স্যাটেলাইটে। এর মধ্যে ১৯০০ সালের দিকে ঘটে এক মজার ঘটনা। মার্কোনিকে তো আপনারা চেনেন। যিনি জগদীশচন্দ্র বসুর আইডিয়া চুরি করে আগে রেডিও বানিয়েছিলেন বলে প্রচলিত আছে, সেই মার্কোনিই। যদিও আইডিয়া চুরির ব্যাপারটি এখনো বিতর্কিত। যাহোক, মার্কোনি একবার লন্ডন থেকে কর্নওয়ালে বেতার তরঙ্গের সাহায্যে বার্তা পাঠাবেন বলে ঘোষণা দিলেন। দুই শহরের দূরত্ব প্রায় ৪১০ কিলোমিটার। সবাই অপেক্ষা করছিলেন তাঁর নতুন আবিষ্কার দেখার জন্য; কিন্তু হঠাৎ নেভিল মাস্কেলিন নামের একজন হ্যাকার সেই সিগন্যালের মধে৵ ঢুকে নিজের একটি মজার কবিতা পাঠিয়ে দিলেন। মার্কোনির পরীক্ষা ব্যর্থ হলো সবার সামনে। এ ঘটনা থেকেই মানুষ বুঝল, বেতার তরঙ্গ ধরা কঠিন কিছু নয়।
আর তখন থেকেই বোঝা গেল, এনক্রিপশন বা গোপন কোড দিয়ে বার্তার কথাগুলো লুকানো যায় ঠিকই; কিন্তু যে বার্তা পাঠানো হচ্ছে, তা কোনোভাবেই লুকানো যায় না।
শুধু টাওয়ার নয়, স্যাটেলাইটও আপনাকে ট্র্যাক করতে পারে। ১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় থেকে সামরিক বাহিনী স্যাটেলাইট দিয়ে তাদের নিজেদের সৈন্যদের অবস্থান ট্র্যাক করা শুরু করে
দুই
১৯৪৬ সালে প্রথম মোবাইল ফোন তৈরি হয়। তখন সেটি মূলত কারখানার কাজে ব্যবহৃত হতো। পরে ১৯৭০ দশকের শেষ দিকে শহরগুলোয় সেলুলার টাওয়ার বসানো শুরু হলো। এই টাওয়ারগুলো থেকেই ফোনের সিগন্যাল যেত।
মনে করুন আপনি হাঁটছেন রাস্তা দিয়ে, ফোন পকেটে। আপনার ফোন একটি টাওয়ারের সঙ্গে যুক্ত। একটু এগিয়ে গেলে আরেকটি টাওয়ার ধরছে। এভাবে তিনটি টাওয়ার মিলে ত্রিকোণমিতির সাহায্যে বের করে ফেলা যায় আপনি ঠিক কোথায় আছেন। টাওয়ারগুলোর প্রায় ৩০০ মিটারের মধ্যে থাকা অবস্থায় আপনার অবস্থান বলে দেওয়া সম্ভব।
শুধু টাওয়ার নয়, স্যাটেলাইটও আপনাকে ট্র্যাক করতে পারে। ১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় থেকে সামরিক বাহিনী স্যাটেলাইট দিয়ে তাদের নিজেদের সৈন্যদের অবস্থান ট্র্যাক করা শুরু করে; কিন্তু এখন এই প্রযুক্তি সাধারণ মানুষের ফোনেও আছে। সেটিই হলো জিপিএস।
জিপিএস দিয়ে আপনার ফোন ঠিক কোথায় আছে, সেটি স্যাটেলাইট জানে। আর সেই তথ্য যে শুধু আপনি পান, তা কিন্তু নয়; সামরিক বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা, এমনকি বড় বড় কোম্পানিও এই তথ্য পেতে পারে।
মজার ব্যাপার হলো, আপনি কোথায় কতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছেন, সেটি দেখেই বলে দেওয়া যায় আপনি কী করছেন। রাতে একই জায়গায় অনেকক্ষণ থাকলে বোঝা যায়, এটা আপনার বাড়ি। কত দ্রুত এক টাওয়ার থেকে আরেক টাওয়ারে যাচ্ছেন, তাতে বোঝা যায় আপনি গাড়িতে না হেঁটে যাচ্ছেন। আশপাশের দোকান থেকে আপনার কেনাকাটার অভ্যাসও জানা যাবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বেল ল্যাবসের একজন কর্মচারী খেয়াল করেন, টেলিটাইপরাইটার মেশিনে টাইপ করলে কাছাকাছি থাকা একটি অসিলোস্কোপ যন্ত্রে সংকেত ধরা পড়ে।
তিন
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি বা এনএসএ ইকোলন নামে একটি প্রোগ্রাম চালু করেছিল। এই প্রোগ্রাম লাখ লাখ টেলিফোনের কথা শোনে। একটি বিশেষ অভিধান দিয়ে খোঁজে শব্দ। কোনো নির্দিষ্ট শব্দ শুনলেই রেকর্ড করা শুরু হয়।
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের রিপোর্ট বলছে, এই প্রোগ্রাম এখনো চলছে। সব ই–মেইল, ফোন কল, ফ্যাক্স, টেক্সট মেসেজসহ যা কিছু স্যাটেলাইটের সাহায্যে ব্যবহৃত হচ্ছে, সবকিছু শুনতে পারে যুক্তরাষ্ট্র।
২০০৯ সালে এনএসএ মিস্টিক নামে আরেকটি প্রোগ্রাম শুরু করা হয়। এটা পুরো একটি দেশের সব ফোন কল রেকর্ড করে রাখতে পারে। এতটা শুনে মনে হতে পারে, মার্কিনরা তো অনেক এগিয়ে আছে! কেউ কেউ তাদের খারাপও মনে করতে পারেন; কিন্তু এখানেই শেষ নয়। মার্কিনদের কাছে টেম্পেস্ট নামে একটি প্রযুক্তি আছে। এটা দিয়ে আপনার ফোনের পর্দায় কী দেখছেন, সেটি দূর থেকে বোঝা যায়।
কীভাবে? আসলে আপনার ফোনের পর্দায় যখন কিছু দেখা যায়, তখন একরকম তড়িৎ–চুম্বকীয় তরঙ্গ বের হয়। বিশেষ যন্ত্র দিয়ে সেই তরঙ্গ ধরে ছবি বানানো যায়। মানে আপনার ফোনে কী আছে, সেটি না দেখেও দূর থেকে বোঝা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই এই প্রযুক্তি মানুষের জানা ছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বেল ল্যাবসের একজন কর্মচারী খেয়াল করেন, টেলিটাইপরাইটার মেশিনে টাইপ করলে কাছাকাছি থাকা একটি অসিলোস্কোপ যন্ত্রে সংকেত ধরা পড়ে। সেই সংকেত দেখে তিনি টেলিটাইপরাইটারের লেখা বুঝতে পারতেন। ১৯৬০-এর দশকে সামরিক বাহিনী আবিষ্কার করে, কম্পিউটার স্ক্রিন থেকে নির্গত তড়িৎ–চুম্বকীয় সংকেত দেখে স্ক্রিনে কী আছে, তা বলে দেওয়া সম্ভব।
পেন্টাগনে ক্যামেরাওয়ালা ফোন নিয়ে ঢোকা নিষিদ্ধ। ল্যাপটপ নিতে চাইলে ওয়াই–ফাই, মাইক্রোফোন আর ওয়েবক্যাম বন্ধ করে নিতে হবে। কেন এত সতর্কতা?
চার
ব্লুটুথের সঙ্গে আপনারা কমবেশি সবাই পরিচিত। নামটা এসেছে দশম শতাব্দীর ডেনিশ ভাইকিং রাজা হ্যারল্ড ব্লুটুথের নাম থেকে। ১৯৯০–এর দশকে এরিকসন কোম্পানি এটা বানায়। এর সাহায্যে হেডফোন বা অন্য যন্ত্র তারবিহীনভাবে ফোনের সঙ্গে যুক্ত করা যায়। ব্লুটুথ সাধারণত ১০ থেকে ১০০ মিটার দূরত্বে কাজ করে। এর মধ্যে ‘মাস্টার’ ও ‘স্লেভ’ নামে দুটি যন্ত্র থাকে। এটা ১ সেকেন্ডে ১ হাজার ৬০০ বার তরঙ্গের চ্যানেল বদলায়। তাই ব্লুটুথের বার্তা সহজে ধরা পড়ে না; কিন্তু আমেরিকান এয়ারফোর্সের একটি গবেষণা বলছে, ব্লুটুথ যন্ত্রের বেশির ভাগের মধ্যে ছিদ্র আছে। হ্যাকাররা সেই ছিদ্র দিয়ে সহজে ডিভাইসে প্রবেশ করতে পারে। মজার ব্যাপার হলো, ব্লুফাইন্ডার নামের একটি টুল দিয়ে ৫০ থেকে ১০০০ মিটার দূর থেকেও ব্লুটুথ যন্ত্র খুঁজে বের করা যায়; এমনকি তা যদি লুকানোও থাকে।
যুক্তরাষ্ট্রের পেন্টাগনে ডার্পা নামে একটি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান আছে। সেখানে কড়া নিয়ম হলো, প্রথম তলার ওপরে কোনো ওয়াই–ফাই বা ব্লুটুথ চলবে না। কারণ, দোতলায় গোপন গবেষণা হয়।
নিউ মেক্সিকোর পারমাণবিক অস্ত্র জাদুঘরে ঢুকতে চাইলে আপনাকে গাড়ির চাবিও রেখে যেতে হবে। কারণ, চাবিতেও এখন রেডিও সিগন্যাল থাকে। ৯০০ ডলারের সরঞ্জাম দিয়ে গাড়ির চাবি ট্র্যাক করা যায়। ফলে গাড়ি আর চালককে চিহ্নিত করা যায় সহজেই।
পেন্টাগনে ক্যামেরাওয়ালা ফোন নিয়ে ঢোকা নিষিদ্ধ। ল্যাপটপ নিতে চাইলে ওয়াই–ফাই, মাইক্রোফোন আর ওয়েবক্যাম বন্ধ করে নিতে হবে। কেন এত সতর্কতা? কারণ, তারা জানে, বেতার সিগন্যাল ধরা কত সহজ।
মার্কিন সামরিক বাহিনী ‘ফুল স্পেকট্রাম ডমিন্যান্স’ নামে একটি নীতি মানে। এর মানে হলো, সব জায়গায়, সব ধরনের তথ্যে তাদের নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। এই নিয়ন্ত্রণের জন্য তারা একটি বিশাল তথ্যজালিকা তৈরি করেছে। তার নাম ‘গ্লোবাল ইনফরমেশন গ্রিড’। এখন পৃথিবীতে সাড়ে সাত বিলিয়ন স্মার্টফোন আছে। কম্পিউটার আছে দুই বিলিয়ন। আর এক বিলিয়ন বাড়িতে আছে স্মার্ট মিটার। প্রায় ১০০ কোটি মানুষ স্মার্ট ঘড়ি ব্যবহার করেন। এক–দশমাংশ মানুষের ঘরে আছে স্মার্ট যন্ত্রপাতি। এসব যন্ত্র মিলে তৈরি হয়েছে ‘ইন্টারনেট অব থিংস’। আর এখন লক্ষ্য হলো ‘ইন্টারনেট অব বডিজ’ বানানো। অর্থাৎ এখন মানুষের শরীরের সঙ্গেও সারাক্ষণ থাকবে যন্ত্র।
কথাটা বিশ্বাস না হলে একটু নিজের দিকেই তাকিয়ে দেখুন। হাতে স্মার্টফোন, স্মার্ট ঘড়ি, আঙুলে স্মার্ট রিং, এমনকি চোখে থাকতে পারে স্মার্ট চশমা। এগুলোই ইন্টারনেট অব বডিজ।
গোপনীয়তা আর ব্যক্তিস্বাধীনতা হাজার বছরের পুরোনো ধারণা; কিন্তু স্মার্ট যন্ত্রের যুগে এসে সেগুলো ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে।
পাঁচ
এসবের আরও একটি সহজ উদাহরণ হলো কোভিড-১৯। এই মহামারির সময় দেখা গেল, উন্নত দেশগুলোর সরকার কত সহজে মানুষকে ট্র্যাক করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে সেফগ্রাফ নামে একটি কোম্পানি লাখ লাখ মানুষের ফোন ট্র্যাক করে তাদের গতিবিধি বিশ্লেষণ করেছে। কানাডায় সরকার টেলাস নামে টেলিকম কোম্পানি দিয়ে প্রায় পুরো জনসংখ্যাকে ট্র্যাক করেছে। সবকিছুর অজুহাত ছিল জনস্বাস্থ্য; কিন্তু আসলে এটা দেখিয়ে দিল নজরদারির ব্যবস্থা কতটা শক্তিশালী হয়ে গেছে।
অর্থাৎ আপনার পকেটের ফোনটা একই সঙ্গে অনেক কিছু করছে। এটা যেমন আপনার সহায়ক বা বিনোদনের মাধ্যম, তেমনি একটি ট্র্যাকারও। আসলে কোনো প্রযুক্তিই খারাপ নয়; কিন্তু কে কীভাবে ব্যবহার করছে, সেটিই আসল প্রশ্ন। আপনার তথ্য কোথায় যাচ্ছে, কে দেখছে, কেন দেখছে—এই প্রশ্নগুলো করা জরুরি।
গোপনীয়তা আর ব্যক্তিস্বাধীনতা হাজার বছরের পুরোনো ধারণা; কিন্তু স্মার্ট যন্ত্রের যুগে এসে সেগুলো ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা সুবিধা পাচ্ছি; কিন্তু সে জন্য দামও দিচ্ছি। আর সেই দাম হলো আমাদের গোপনীয়তা, আমাদের স্বাধীনতা।
