ক্যামেরার গল্প

আজকাল সবার হাতে হাতে ক্যামেরা। ক্যামেরা মানে স্মার্টফোন। ডিজিটাল ক্যামেরা ব্যবহার করেন এখন মূলত পেশাদার আলোকচিত্রীরা। এক সময়ের ঢাউস ক্যামেরা আজ কেমন করে ছোট্ট চিপ হয়ে মুঠোফোনে জায়গা করে নিল, সে এক দারুণ গল্প।

ক্যামেরা নিয়ে আমার যা জানাশোনা, আগ্রহ তারচেয়ে ঢের বেশি। সেই আগ্রহ থেকেই এই লেখা, আমার মতো নবীশদের জন্য। লেখার বিষয়বস্তু মূলত ক্যামেরা সায়েন্স বা ক্যামেরার বিজ্ঞান৷

ক্যামেরার বিজ্ঞান বললে কেউ কেউ ভাবতে পারেন অপটিক্যাল সায়েন্স৷ এই লেখার বিষয়বস্তু সেটা না। ক্যামেরা সায়েন্স বলতে শুধু ক্যামেরার পেছনের বিজ্ঞান (এবং সেই সঙ্গে এর পেছনের গল্পটুকু) নিয়ে বলার চেষ্টা করব আমি৷

প্রাচীন আরবীয় এক বিজ্ঞানী—আল হাজেন (হাসসান ইবনে হাইসাম নামে যিনি বেশি পরিচিত) প্রথম আমাদেরকে বলেন, কোনো কিছু থেকে আলো এসে আমাদের চোখে পড়লেই কেবল আমরা সেই জিনিসটি দেখি৷ ঠিক সেই মুহূর্ত থেকেই কিন্তু ক্যামেরা বিজ্ঞানের শুরু৷

আরবীয় বিজ্ঞানী আল হাজেন

প্রথম দিকে ক্যামেরা বলতে মানুষ বুঝত, একটা কিছুর ছবি আঁকতে হবে৷ সেজন্য সাহায্য নেওয়া হতো দুটো আয়নার৷ একটা প্রায় অন্ধকার ঘরে ছোট্ট একটা কাঁচ বসানো টেবিল৷ একটা ফুটো থাকবে ঘরের বাইরে৷ সেই ফুটো দিয়ে দিয়ে আলো এসে পড়বে টেবিলের নিচে রাখা একটা আয়নায়৷ পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণে রাখা সেই আয়নায় প্রতিফলিত হয়ে ছবিটি গিয়ে পড়বে টেবিলের কাঁচে৷ সেই কাঁচে আলো-ছায়ার খেলার মধ্যে যে জিনিসটির ছবি আঁকা লাগবে, তার প্রতিকৃতি ফুটে উঠবে৷ এই হলো ক্যামেরা৷ কিন্তু সেই ছবি দেখার উপায় কী? তখনো ফিল্ম ছিল না৷ তবে কাঁচের নিচ দিয়ে ভেসে আসা আলোয় যার ছবি আঁকা হবে, তার ছাপ বেশ স্পষ্টভাবেই ফুটত৷ কাজেই, চিত্রশিল্পী বা আর্টিস্টরা কাঁচের ওপরে কাগজ রেখে, ছাপ দেখে ছবি আঁকতেন৷ (আমরা অনেকেই জীববিজ্ঞান ব্যবহারিক খাতায় কাছাকাছি একটা পদ্ধতি ব্যবহার করে ছবি এঁকেছি৷) ব্যস!

এর পরে প্রক্রিয়াটাকে আরেকটু উন্নত করা হলো৷ প্রায় অন্ধকার ঘরে আলো আসবে মাথার ওপরে দিয়ে৷ ভেতরের কলকব্জা বলতে দুটো কাঁচ৷ প্রতি কাঁচে দুইবার পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি করে নব্বই ডিগ্রি বাঁকবে আলো৷ সমতলের সমান্তরাল আলো নিচে নামবে খাড়াভাবে৷ সেই আলো দেখে আবারো সেই ছবি আঁকা৷

উল্লেখযোগ্য দুটো বিপ্লব ঘটল তারপর ক্যামেরার জগতে৷ এক, ক্যামেরার পুরো প্রযুক্তিটাকে একটা বাক্সের ভেতরে পুরে ফেলল মানুষ৷ দুই, আবিষ্কৃত হলো রাসায়নিকভাবে তৈরি আলোকসংবেদী ফিল্ম৷ এই ফিল্মে আলো এসে পড়লেই সে আলোকে আটকে ফেলবে৷ ফলে যে বস্তুর ছবি তোলা প্রয়োজন, সেটার ছাপ পড়ে যাবে ফিল্মে৷ এই ফিল্মকে পরে সিলভার হ্যালাইডে ডুবিয়ে তৈরি করা যাবে ফটোগ্রাফ৷

পুরনো দিনের যেসব মুভি আমরা দেখি, যেমন শার্লক হোমস, সেখানে এ ধরনের ক্যামেরা দেখা যায়৷ তবে, এই ক্যামেরা আমরা যেমন দেখি, ঠিক সেরকম না৷ কোনো বাটন ছিল না এই ক্যামেরায়৷ তার ওপরে লেন্স ছিল দুটো৷ কিন্তু পুরো কাজটা-ই করতে হতো আসলে ম্যানুয়ালি৷

টিএলআর ক্যামেরা

দুটো লেন্সের একটা মূলত যে বস্তুটার ছবি তোলা হবে, সেটার অবস্থা এবং অবস্থান দেখার জন্য ব্যবহৃত হতো৷ আজকের দিনে আমরা যেটাকে ভিউফাইন্ডার বলি আরকি৷ আরেকটার কাজ ছবি তোলা৷ কিন্তু লেন্স দুটো কেন? আসলে, যে লেন্সে ছবি তোলা হবে, তার ভেতরের মাথায় লাগানো আছে সেই আলোক সংবেদী ফিল্ম৷ আর বাইরের মুখ ঢাকনা দিয়ে বন্ধ৷ সেটা দিয়ে দেখতে হলে ঢাকনা খুলতে হবে৷ কিন্তু ঢাকনা খুললেই ছবি উঠে যাবে ফিল্মে! সেজন্যই যার ছবি তোলা হবে, তাকে ঠিকঠাক করে বসিয়ে, ইংরেজি চলচ্চিত্রের ক্যামেরাম্যানকে বলতে শোনা যায়, স্মাইল!

আর, হাসার সঙ্গে সঙ্গেই সে হাত দিয়ে সরিয়ে দেয় লেন্সের ঢাকনা৷ ক্লিক!

এই দুই লেন্সের ক্যামেরা পরবর্তীতে আরেকটু উন্নত হলো৷ লেন্সের ঢাকনা আর হাত দিয়ে সরাতে হয় না৷ বোতামে চাপ দিলেই ছবি উঠে যায় ফিল্মে৷ সেখান থেকেই সত্যিকারের আধুনিক ক্যামেরার গল্পের শুরু৷ আর যে ক্যামেরা দিয়ে এই গল্পের সূচনা, তার নাম টিএলআর বা টু লেন্স রিফ্লেকস৷ আসুন, একটু উঁকি দেওয়া দেখা যাক সেই ক্যামেরার ভেতরে৷

ওপরের ছবিতে একটি টিএলআর ক্যামেরার ভেতরের গঠন দেখানো হয়েছে৷ এখানে, একেবারে ভেতরের দিকের সরু রেখাটি হলো সেন্সর বা ফিল্ম৷ ছবি ওঠে এই ফিল্মে৷ এর সামনে থাকে ঢাকনা বা শাটার৷ আর এদের ওপরে থাকে ভিউফাইন্ডার৷

এখানে একটা সমস্যা আছে কিন্তু৷ সেটা কি বোঝা যাচ্ছে? ভিউফাইন্ডার আছে ফিল্মের ওপরে৷ যেহেতু কোণের মান সমান না, কাজেই ভিউফাইন্ডারে যেটা চোখে দেখা যাচ্ছে, ক্যামেরা কিন্তু ঠিক সেটা দেখতে পাচ্ছে না৷ ওপরের ছবি থেকে কিছুটা বোঝা যাবে ব্যাপারটা৷ যার ছবি তোলা হচ্ছে, তার মাথা কাটা পড়বে৷ এজন্য ক্যামেরাম্যানকে বেশ দক্ষ হতে হতো৷ বুঝতে হতো, ক্যামেরা ঠিক কতটুকু ওপরে সরালে পুরো জিনিসটির ছবি ঠিকঠাক পাওয়া যাবে৷ তারপর বোতামে চাপ দিলে সরে যাবে শাটার৷ ছবি বসে যাবে ফিল্মে৷

ক্যামেরার লেন্স
সব ধরনের জটিলতা সারাতে এল সিঙ্গেল লেন্স রিফ্লেক্স ক্যামেরা৷
সিঙ্গেল লেন্স রিফ্লেক্স ক্যামেরা

সব ধরনের জটিলতা সারাতে এল এসএলআর বা সিঙ্গেল লেন্স রিফ্লেক্স ক্যামেরা৷ নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে, এখানে লেন্স থাকবে একটাই৷ আসলে, ফিল্ম আর শাটারের সামনে এখানে একটা মিরর বা আয়না রাখা আছে৷ লেন্স থেকে আলো এসে সেই আয়নায় পড়বে৷ তারপর ৪৫ ডিগ্রি কোণে বেঁকে যাবে, উঠে যাবে ওপরের দিকে৷ সেখানে রাখা আছে একটা প্রিজম৷ এই প্রিজম আমাদের পরিচিত না৷ সচরাচর আমরা তিন তল বিশিষ্ট প্রিজম দেখি৷ কিন্তু ক্যামেরার এই প্রিজমটি হলো পেন্টাপ্রিজম বা পাঁচতলের প্রিজম৷ এই প্রিজমে আলো ঢুকলে কী হবে, বলুন তো?

পূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রতিফলন। পুরো একপাক ঘুরে আলোটা ভিউফাইন্ডারের সমতল বরাবর ছুট দেবে৷ গিয়ে পড়বে আপনার চোখে৷ কিন্তু ছবিটা উঠবে কীভাবে? কেবল শাটার সরালেই তো হচ্ছে না, সেই সঙ্গে সরাতে হচ্ছে আয়নাটাও৷ আসলে, আয়নার মাথায় বসানো আছে একটা হিঞ্জ বা কব্জা৷ বোতামে চাপ দিলে আয়নাটা সেই কব্জায় ভর দিয়ে ওপরের দিকে উঠে যাবে৷ সেইসঙ্গে সরে যাবে শাটার৷ সব বাধা সরে গেলে লেন্সের আলো সোজা এসে পড়বে ফিল্মে৷ ব্যাস!

পূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রতিফলন

কিন্তু সেই ফিল্ম দিয়ে আর কতো? এভাবে তো চলে না৷ কতরকম ঝামেলা ফিল্মের৷ ছবি তোলো, ডেভেলপ করো, আবার সেজন্য সিলভার হ্যালাইডে ডুবিয়ে বসে থাক৷ এসব ঝামেলা সমাধান করতে এল ইলেকট্রনিক্যাল সেন্সর৷ আলো পেলেই সে এ ব্যাপারে সমস্ত তথ্য রিসিভ করে ইলেকট্রনিক সিগন্যালে রূপান্তরিত করে ফেলবে৷ আর বোতাম চাপলে রিসিভ করা তথ্য সেভ হয়ে যাবে মেমোরি কার্ডে৷ বোতাম না চাপলেও সমস্যা নেই৷ ভিউ ফাইন্ডারে দেখা যাবে সেই ছবি৷

যেহেতু এখন ক্যামেরা আর কেমিক্যালি চলছে না, সবকিছু সিগন্যাল নির্ভর হয়ে গেছে—কাজেই নামের আগে বসে গেল ডিজিটাল৷ সব মিলে নামটা দাঁড়াল ডিজিটাল সিঙ্গেল লেন্স রিফ্লেকশন বা ডিএসএলআর৷

ডিএসএলআর ক্যামেরার ভেতরে উঁকি দিলে দেখা যাবে, ওর মধ্যে ব্যাপার কিন্তু কেবল একটা নেই৷ ক্যামেরার ডিসপ্লেতেই কত বিচিত্র জিনিস৷ তার প্রত্যেকটার ব্যাপার আছে, ব্যাখ্যা আছে৷ সঙ্গে আছে একেকটা গল্প, ইতিহাস৷ তবে সে অন্য গল্প৷ পরে কখনো সে ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে৷