দুর্যোগের সময় যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু রাখতে বাংলাদেশি গবেষকের ড্রোন প্রযুক্তি উদ্ভাবন

তুরস্কের ইলদিজ টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক শাহেন শাহ এবং তাঁর শিক্ষার্থীরা ড্রোন-ভিত্তিক জরুরি যোগাযোগ ব্যবস্থা পরীক্ষা করছেনডেইলি সাবাহ

প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হওয়া বেশ সাধারণ ঘটনা। ভূমিকম্প, বন্যা বা সুনামির মতো ঘটনায় মোবাইল নেটওয়ার্ক অকার্যকর হয়ে পড়ে। ফলে প্রান্তিক অঞ্চলে উদ্ধারকাজ ও জরুরী সাহায্য পাঠানো খুবই কঠিন হয়ে যায়। এই সমস্যার সমাধান কীভাবে করা যায়, তা নিয়ে গবেষণা করছেন তুরস্কের ইলদিজ টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক ও প্রবাসী বাংলাদেশি গবেষক এ. এফ. এম শাহেন শাহ। উদ্ভাবন করেছেন ড্রোন-ভিত্তিক জরুরি যোগাযোগব্যবস্থা। দুর্যোগকালীন সময়ে এই প্রযুক্তির সাহায্যে নেটওয়ার্ক সুবিধা দেওয়া সম্ভব হবে।

২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে তুরস্কে ভয়াবহ ভূমিকম্পের সময় যোগাযোগব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। একই সমস্যা দেখা দেয় বাংলাদেশে গত বছরের বন্যায়। ফেনীসহ বিভিন্ন অঞ্চলে যোগাযোগ সমস্যার কারণে উদ্ধারকাজ কঠিন হয়ে পড়েছিল। এ অবস্থায় শাহেন শাহ তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষককে সঙ্গে নিয়ে সমস্যাটি সমাধানে এগিয়ে আসেন।
শাহেন শাহের উদ্ভাবিত প্রযুক্তিতে একাধিক ড্রোন নির্দিষ্ট দূরত্বে থেকে নির্দিষ্ট এলাকায় নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা সচল রাখে। ড্রোনগুলো পরিচালনা ও চার্জের জন্য বেস স্টেশন প্রয়োজন। বিষয়টি সহজে বোঝাতে তিনি বলেন, ‘ধরা যাক, একটি বেস স্টেশন আশপাশের দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে কাজ করে। আমাদের মডেল অনুযায়ী, পাঁচটি ড্রোন এই একটি বেস স্টেশনের কাজ করবে।’

গবেষক শাহেন শাহ

এই সিস্টেমে ড্রোনগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে একটি নেটওয়ার্ক বলয় তৈরি করে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার মানুষ সেই নেটওয়ার্কে যুক্ত হতে পারেন। শাহেন শাহর মতে, এটি একটি ওয়াইফাই সিস্টেমের মতো কাজ করবে। দুর্যোগ কবলিত এলাকায় অবিচ্ছিন্ন যোগাযোগ নিশ্চিত করবে।

মজার বিষয় হলো, ড্রোনগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে ব্যাটারি ম্যানেজমেন্টও করতে পারে। কোনো ড্রোনের ব্যাটারি ২০ শতাংশের নিচে নেমে এলে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে চার্জিং স্টেশনে ফিরে যায়। আর ওই ড্রোনের স্থানে অন্য একটি ড্রোন সয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করে। ফলে যোগাযোগব্যবস্থা কখনো বিচ্ছিন্ন হয় না।

শাহেন শাহর এই উদ্ভাবন ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে তাঁর গবেষণা বিখ্যাত ড্রোনস জার্নালে প্রকাশিত হয়। তুরস্কের বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত গবেষণা পরিষদ TÜBİTAK এবং ইলদিজ টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি এই প্রকল্পে অর্থায়ন করছে।

২০২১ সালে মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল ইনভেনশন, ইনোভেশন অ্যান্ড টেকনোলজি এক্সিবিশন (ITEX) তাঁর গবেষণার জন্য স্বর্ণপদক পুরস্কার দেয়। এছাড়া ২০২৩ সালে বিশ্বের শীর্ষ ২ শতাংশ গবেষকের তালিকায় উঠে আসে তাঁর নাম।

শাহেন শাহের জন্ম ও বেড়ে ওঠা বাংলাদেশে। চট্টগ্রাম কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর তিনি ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে ইলেকট্রনিকস অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হন। স্নাতক শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েট থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন।

২০১৫ সালে তুরস্কের সরকারি বৃত্তি নিয়ে পিএইচডি করতে যান ইস্তাম্বুলের ইলদিজ টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে। সেখানে চালকবিহীন গাড়ির যোগাযোগব্যবস্থা নিয়ে গবেষণা করেন। চালকবিহীন গাড়ির জন্য যোগাযোগের বিলম্ব (লেটেন্সি) মাত্র ১০০ মিলিসেকেন্ডে নামিয়ে আনতে পেরেছিলেন তিনি।

বর্তমানে তিনি ইলদিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এআই অ্যান্ড নেক্সট জেনারেশন ওয়্যারলেস কমিউনিকেশন ল্যাব ANWCL-এর পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর তত্ত্বাবধানে ১২ জন স্নাতকোত্তর ও বেশ কয়েকজন স্নাতক শিক্ষার্থী গবেষণা করছে।

আমার আবিষ্কৃত এই জরুরী যোগাযোগ ব্যবস্থা বাস্তবায়ন হলে, যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন এক বিপ্লব সাধন হবে। দূর্যোগকালীন সময়ে উদ্বার কাজ এবং স্বাভাবিক যোগাযোগ সহজ হবে, ক্ষয়ক্ষতির পরিমান কমে আসবে। বাঁচানো সম্ভব হবে হাজারো মানুষের প্রাণ।
এ. এফ. এম. শাহেন শাহ, সহযোগী অধ্যাপক, ইলদিজ টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি, তুরস্ক

এই মুহূর্তে শাহেন শাহের ড্রোন সিস্টেমটি ইলদিজ ক্যাম্পাসে পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমরা এখনো হিসাব করছি যে একটি নির্দিষ্ট এলাকার জন্য কতগুলো ড্রোন প্রয়োজন।’ 

ড্রোন পরিচালনার সফটওয়্যারটি আরও উন্নত করতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করেছেন তাঁরা। ফলে সহজ ও কার্যকরভাবে এগুলো পরিচালনা করা যাবে। তিনি আশা করেন, এই প্রযুক্তি শুধু তুরস্কেই নয়, বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশেও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বিপ্লব আনবে। 

বাংলাদেশি এ গবেষক মনে করেন, মানুষ তাঁর আগ্রহের বিষয়ের দিকে মনোযোগী হলেই সফলতা পান। তাই নতুন প্রজন্মের গবেষক ও শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে শাহেন শাহর পরামর্শ খুবই সরল— ‘তোমরা যা করতে ভালোবাসো, যেখানে তোমাদের আগ্রহ, সেটা নিয়েই এগিয়ে যাও। সাফল্য নিজেই ধরা দেবে।’

তাঁর এই উদ্ভাবন প্রমাণ করে, প্রযুক্তি ও গবেষণার মাধ্যমে মানবকল্যাণমূলক সমাধান সম্ভব। ভবিষ্যতে এই ড্রোন সিস্টেমটি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় একটি মাইলফলক হয়ে উঠতে পারে। বাঁচাতে পারে হাজারো প্রাণ!


সূত্র: ডেইলি সাবাহ ও প্রথম আলো