কংক্রিট কি রিসাইকেল করা যায়

১ টন কংক্রিট রিসাইকেল করলে প্রায় ৬ হাজার ১৮২ লিটার পানির খরচ বাঁচানো যায়।ছবি: সংগৃহীত

প্রকৃতি সব সময় শান্ত থাকে না। লেগে থাকে নানা দুর্যোগ। তা ছাড়া শারীরিকভাবে বেশির ভাগ বন্য প্রাণীর তুলনায় মানুষ বেশ দুর্বল। তাই নিরাপত্তার জন্য পাহাড়ের গুহা বা ঘর-বাড়ির আশ্রয় নিচ্ছে যুগ যুগ ধরে। খড়, কাঠ, পাতার পাশাপাশি মাটি বা টিনের মতো উপকরণ দিয়ে ঘর তৈরি করে মানুষ। গ্রামাঞ্চলে এখনও এ ধরনের ঘর চোখে পড়ে।

সময়ের সঙ্গে মানুষ উন্নত হয়েছে। আবিষ্কার করেছে ঘর। পাশাপাশি যেকোনো স্থাপনা আরও শক্ত ও নিরাপদ করে নির্মাণের নানা উপায় বের করেছে। এগিয়েছে প্রযুক্তি। এর মধ্যে সবচেয়ে কার্যকর ও সাশ্রয়ী উপায় হলো কংক্রিটের ব্যবহার। বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় সব উন্নত অঞ্চলের স্থাপনা তৈরি করা হয় কংক্রিট দিয়ে। তবে কংক্রিট একেবারে দুর্ভেদ্য কিছু নয়। কালের পরিক্রমায় নিজে থেকে ভেঙে পড়ে। ভেঙে যায় যুদ্ধে গোলা-বারুদের আঘাতে। প্রয়োজনে পুরাতন কংক্রিটের স্থাপনা ভেঙে নতুন স্থাপনা তৈরি হচ্ছে নিয়মিত। প্রশ্ন হলো, পরিত্যক্ত কংক্রিট কি রিসাইকেল, অর্থাৎ ফের ব্যবহারোপযোগী করা যায়?

শুরুতে কংক্রিট জিনিসটা কী, তা বলা যাক। অনেকেরই হয়তো একটা ভুল ধারণা আছে—কংক্রিট ও সিমেন্ট একই জিনিস। এ ধারণা ঠিক নয়। সিমেন্ট কংক্রিটের একটি উপাদান। সিমেন্টের সঙ্গে বালি, পাথর বা ইটের টুকরো, লোহা বা রড, পানি, বাতাস ইত্যাদি মিলিয়ে যে মিশ্রণ তৈরি করা হয়, তা-ই কংক্রিট। অর্থাৎ সাধারণত ঢালাই বলতে আমরা যে বিষয়টা বুঝি, ইংরেজিতে সেটাকেই কংক্রিট বলা হয়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, একবার ব্যবহারের পর চাইলে কংক্রিট আবার ব্যবহার করা যায়। এ জন্য কংক্রিটের টুকরোগুলো পেষণ মেশিনে গুঁড়ো করে বিভিন্ন উপাদানের ছোট-বড় কণা আলাদা করতে হয়। চুম্বকের সাহায্যে সরিয়ে নিতে হয় কংক্রিটে থাকা লোহার টুকরো। এরপর পানির প্রবাহ কাজে লাগিয়ে অদরকারি উপাদান আলাদা করলেই কেবল তা নানা কাজে ব্যবহার করা সম্ভব। যেমন নতুন স্থাপনার নিচে সাব-বেস তৈরি, হাঁটার রাস্তা নির্মাণ। এমনকি নতুন ঢালাইয়ের জন্য অ্যাগ্রিগেট বা সহযোগী উপাদান হিসেবেও রিসাইকেল করা কংক্রিট ব্যবহার করা যায়।

কংক্রিটের ধ্বংসস্তূপ
ছবি: সংগৃহীত

কংক্রিটে প্রচুর দূষক উপাদান থাকলে রিসাইকেল করা কঠিন হয়ে পড়ে। তবে কংক্রিট রিসাইকেল করা আসলে জরুরি। এতে পরিত্যক্ত কংক্রিটের নিচে যেমন উর্বর মাটি ঢাকা পড়ে না, তেমনি নতুন ঢালাইয়ের জন্য অনেক কম বালু বা অন্য উপাদান হলেই হয়ে যায়। পরিবেশও বাঁচে। হিসাব করে দেখা গেছে, ১ টন কংক্রিট রিসাইকেল করলে প্রায় ৬ হাজার ১৮২ লিটার পানির খরচ বাঁচানো যায়। কমানো যায় প্রায় ৯০০ কেজি কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ। অনেক সময় নতুন ঢালাইয়ে মাত্র ৩০ শতাংশ রিসাইকেল কংক্রিট থেকে নেওয়া হয়। এর বেশি হলে দুর্বল হতে পারে নতুন কংক্রিটের গাঁথুনি।

প্রবালের মতো অনেক সামুদ্রিক জীব যেমন নিজের চারপাশে ধীরে ধীরে শক্ত আবরণ গড়ে তোলে, এগুলো অনেকটা সেভাবে কাজ করে।

নতুন এক পদ্ধতিতে রাসায়নিক উপাদানের সাহায্যে কংক্রিট ভেঙে বালু, নুড়ি, চুনাপাথরসহ প্রতি টন কংক্রিট থেকে ৬০ কেজি পর্যন্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড আলাদা করা সম্ভব। এ থেকে তৈরি নতুন কংক্রিট হয় মানসম্পন্ন ও শক্তপোক্ত।

সম্প্রতি জাপানের টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক ভিন্ন ধরনের কংক্রিট তৈরি করেছেন পরীক্ষামূলকভাবে। প্রবালের মতো অনেক সামুদ্রিক জীব যেমন নিজের চারপাশে ধীরে ধীরে শক্ত আবরণ গড়ে তোলে, এগুলো অনেকটা সেভাবে কাজ করে। এ জন্য গবেষকেরা প্রথমে পরিত্যক্ত কংক্রিট থেকে ক্যালসিয়াম আলাদা করেন। এরপর সঙ্গে মেশান কারখানা থেকে নির্গত কার্বন ডাই-অক্সাইড। এই কার্বন ডাই-অক্সাইড বায়ুমণ্ডল থেকে সংগ্রহ করা হয়। নতুন ধরনের এ কংক্রিটকে বলা হয় ক্যালসিয়াম কার্বোনেট কংক্রিট। গবেষকদের দাবি, এটা একই সঙ্গে কংক্রিট বর্জ্যের পরিমাণ যেমন কমাবে, তেমনি স্থাপনাকে করবে আরও শক্তিশালী। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে অন্যতম সমাধান হতে পারে নতুন এ কংক্রিট।

লেখক: প্রদায়ক, বিজ্ঞানচিন্তা  

সূত্র: সায়েন্স ফোকাস, গ্লোবাল কন্সট্রাকশন রিভিউ