কোয়ান্টাম কম্পিউটারের পদধ্বনি

আমাদের বাসায় প্রথম কম্পিউটার এসেছিল ২০০০ সালে। তার হার্ডডিস্ক ছিল ২০ গিগাবাইট, র্যাম ৩২ মেগাবাইট, পেন্টিয়াম থ্রি মডেলের। সেই কম্পিউটার তখন বাজারে সবচেয়ে নতুন। সেই কম্পিউটারে একটা অডিও গান কপি করতে লাগত ৩ থেকে ৪ মিনিট। তখন আমরা নিয়মিত বিরতিতে ওয়ালপেপার মুছতাম জায়গা বের করার জন্য। এখন আমার বাসায় যে ডেস্কটপ ব্যবহার করা হচ্ছে, তার হার্ডডিস্ক ৬ টেরাবাইট, সঙ্গে ২৫০ গিগাবাইটের একটা এসএসডিও আছে, র্যাম ১৬ গিগাবাইট এবং প্রসেসর কোর-আই-ফাইভ এইটথ জেনারেশন।

মাঝখানের এই ১৮ বছরে কম্পিউটারজগতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়েছে। এখন কম্পিউটার নিয়ে প্রচুর গবেষণা হচ্ছে, হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যারের প্রচুর চাহিদা তৈরি হচ্ছে। সেগুলো সরবরাহ করে কুলানো যাচ্ছে না, বাজারে প্রতিদ্বন্দ্বী বাড়ছে, গবেষণা হচ্ছে, অনেক অনেক কাজকর্ম করতে গিয়ে আগের ক্ষমতার কম্পিউটার দিয়ে কুলাচ্ছে না। কাজেই আরও বেশি ক্ষমতার চিপ তৈরি করতে হচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে মোটামুটি এলাহি অবস্থা। এই পরিবর্তনের মধ্যেই আমরা প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতার সুবিধাটুকু পেয়ে গেছি। আমাদের কাছে কম্পিউটার এখন অনেক সহজলভ্য, আগের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন।

গুগল, আইবিএম এবং আরও কয়েকটি সিলিকন ভ্যালির স্টার্টআপের মধ্যে বেশ অনেক দিন ধরে তুমুল প্রতিযোগিতা চলছে। এটি হচ্ছে পরবর্তী প্রজন্মের সুপারকম্পিউটার তৈরির প্রতিযোগিতা। আমাদের বর্তমান প্রজন্মের কম্পিউটার এখন অনেক কিছুই করতে পারে। ১৫ বছর আগের তুলনায় কম্পিউটারের কাজ করার ক্ষমতা বহুগুণে বেড়েছে। তারপরও এ যুগের কম্পিউটার দিয়ে আমরা অনেক কাজ করতে পারি না বা বিষয়টি অনেক সময়সাপেক্ষ হয়ে দাঁড়ায়।

শিগগিরই বাজারে আসছে কোয়ান্টাম কম্পিউটার। ঠিক কবে নাগাদ ওটা সাধারণ ক্রেতার হাতের নাগালে আসবে, বলা মুশকিল। কিন্তু নিঃসন্দেহে বলা যায়, সেই কম্পিউটারের ক্ষমতা বর্তমান যেকোনো কম্পিউটারের চেয়ে বহুগুণে বেশি হবে। সে লক্ষ্যেই বেশ কতগুলো প্রতিষ্ঠান দিন-রাত মোটামুটি পাগলের মতো কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। চেষ্টা করছে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী কম্পিউটার তৈরির জন্য।

কোয়ান্টাম কণিকাগুলো মূলত অতিপারমাণবিক কণা। সেগুলো একই সঙ্গে একাধিক অবস্থায় (State) থাকতে পারে। অন্যান্য কম্পিউটারের চেয়ে এর কাজ সম্পন্ন করার প্রক্রিয়াটাই ভিন্ন। এটাই হবে এই কম্পিউটারের সবচেয়ে বড় সুবিধা। বর্তমানের সাধারণ কম্পিটারের ক্ষমতা হিসাব করা হয় প্রতি সেকেন্ডে কত বিটের অপারেশন করতে পারে, তার ওপর। সাধারণ কম্পিউটারগুলোয় বিটসংখ্যা হয় দুটি—হয় ০ অথবা ১। এটাকে চাইলে ভোল্টেজ আপ আর ডাউনের সমতুল্য হিসেবে চিন্তা করা যেতে পারে। কোয়ান্টাম কম্পিউটারে বিটকে বলে কোয়ান্টাম বিট বা সংক্ষেপে কিউবিট (Qbit)। কোয়ান্টাম কণিকাগুলো একই সঙ্গে একাধিক অবস্থায় থাকতে পারে। অর্থাৎ কিউবিটের মান চাইলে একই সঙ্গে ০ ও ১ দুটোই হতে পারে। শুধু তা-ই কিন্তু নয়! বরং ১ আর ০ এই দুটি অবস্থার সুপারপজিশনের কারণে কিউবিটের মান আরও অনেক কিছুই হতে পারে। অর্থাৎ আরও অনেক বেশি তথ্য ধারণ করা সম্ভব।

কিউবিটের ধারণাটা কেমন হতে পারে? কাল্পনিক একটা গোলক কল্পনা করুন, ক্ল্যাসিক্যাল কম্পিউটারগুলো শুধু এই গোলকের দুই মেরুর দুটি মান গ্রহণ করতে পারে। কোয়ান্টাম কম্পিউটার এই গোলকপৃষ্ঠের ওপর যেকোনো মান গ্রহণ করতে পারবে। ফলে ক্ল্যাসিক্যাল কম্পিউটারের তুলনায় এর তথ্য নিয়ে কাজ করার ক্ষমতা বহুগুণে বেশি হয়। কিন্তু শক্তি খরচ হয় অনেক কম। একটা ফোটন, নিউক্লিয়াস অথবা ইলেকট্রন, এরা সবাই কিউবিট হিসেবে কাজ করতে পারে। এখনকার একদল গবেষক ফসফরাস মৌলের সর্ববহিস্থ কক্ষপথের ইলেকট্রনকে কিউবিট হিসেবে ব্যবহার করছেন।

আইবিএমের তৈরি কোয়ান্টাম কম্পিউটার

এত দিন পর্যন্ত মনে হচ্ছিল কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরির দৌড়ে গুগল সবচেয়ে এগিয়ে। ২০১৭ সালের মার্চে নেচার-এ একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। সেই প্রবন্ধে গুগল পাঁচ বছরের মধ্যে বাজারে বাণিজ্যিকভাবে কোয়ান্টাম কম্পিউটার ছাড়ার সম্ভাবনার কথা ঘোষণা করে। ২০১৭-এর শেষের দিকে গুগল ঘোষণা দেয়, তারা ৪৯ কিউবিটের একটি কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি করেছে। এর ফলে তারা কোয়ান্টাম সুপ্রিমেসি অর্জন করেছে বলে দাবি করে। সাধারণ কম্পিউটারে সেই কাজটা করতে অনেক বেশি সময় লাগে এবং অনেক দীর্ঘ প্রক্রিয়া সেটা। কোয়ান্টাম সুপ্রিমেসিকে গুগল তাদের লক্ষ্য অর্জনের প্রতিশব্দ হিসেবেই ব্যবহার করেছে।

২০১৭ সালের নভেম্বরেই আইবিএম ঘোষণা দেয় তারা ৫০ কিউবিটের কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি করেছে। কিন্তু গবেষকরা একে সত্যিকারের কোয়ান্টাম কম্পিউটার বলতে নারাজ। কারণ আইবিএমের এই কম্পিউটারটির কোয়ান্টাম মাইক্রোস্টেট ধরে রাখার সময় মাত্র ৯০ মাইক্রোসেকেন্ড। আইবিএম গুগলের চেয়ে আর একটি দিক দিয়ে এক ধাপ এগিয়ে আছে। এই কম্পিউটারে তারা গবেষকদের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সুযোগও করে দিয়েছে। এই কোয়ান্টাম কম্পিউটারে কাজকর্মের স্বাদটা কী রকম, সেটা জানতে চায়। এমন কৌতূহলীদের জন্য তারা অনলাইনে তাদের কোয়ান্টাম কম্পিউটারের একটা অংশে প্রবেশের সুযোগ করে দিয়েছে। ২০১৬ সাল থেকেই গবেষকেরা চাইলে ক্লাউডে ৫ কিউবিটের কম্পিউটারে তাঁদের বিভিন্ন কাজ করতে পারেন। ২০১৭-এর শেষে এসে আইবিএম এই ৫ কিউবিটের কোয়ান্টাম কম্পিউটারকে সরিয়ে ২০ কিউবিটের কম্পিউটার স্থাপন করে। অর্থাত্ ক্ষমতা আগের চেয়ে বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। যে কেউ চাইলে অনলাইনে গিয়ে এটি ব্যবহার করতে পারবে।

কোয়ান্টাম সুপারপজিশন এবং এন্টেঙ্গেলমেন্ট কোয়ান্টাম কম্পিউটারের তথ্য প্রক্রিয়াকরণের সক্ষমতা অনেকগুণ বাড়িয়ে দেয়, একই সঙ্গে সুযোগ করে দেয় অনেক দূরে খুব দ্রুত তথ্য আদান-প্রদানের
বিজ্ঞানচিন্তা

তবে আইবিএম, গুগলের নাম বারবার শোনা যাচ্ছে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের বাজারে। তবু কোনোভাবেই এই প্রতিযোগিতাটি এখন আর দুই ঘোড়ার দৌড় বলা যাবে না। ক্যালিফোর্নিয়ার স্টার্টআপ কোম্পানি রিগেট্টি প্রতিযোগিতায় এসেছে। তাদের কাজের ধারাটা একটু আলাদা। কতটি কিউবিট ব্যবহার করা হচ্ছে সেটা নিয়ে তারা বেশি মাথা ঘামাতে রাজি নয়। তার চেয়ে যা আছে সেটিকে আরও কীভাবে সুস্থিত করা যায়, সেটা নিয়ে কাজ করছে। যদি শেষমেশ তারা একটি স্থায়ী পদ্ধতি বের করতেও পারে, আমরা তাহলে কিউবিট সংখ্যা কম হলেও দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করার মতো একটা কম্পিউটার পেয়ে যাব। কানাডার ভ্যাঙ্কুবারের ডি-ওয়েভ নামের একটি কোম্পানির দাবি তারা ইতিমধ্যে ২০০০ কিউবিটের একটি কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি করেছে। গবেষকদের অনেকেই এটিকে প্রকৃত কোয়ান্টাম কম্পিউটার বলতে নারাজ। ইন্টেলও কোয়ান্টাম কম্পিউটার নিয়ে কাজ করছে। ২০১৮-এর ফেব্রুয়ারিতে তারা একটা ঘোষণা দেয়। তাতে বলা হয়, সিলিকন দিয়ে কোয়ান্টাম চিপ প্রস্তুতের একটি পদ্ধতি তারা বের করেছে। প্রচলিত পদ্ধতিতে চিপ প্রস্তুতের প্রক্রিয়াকে এটি অনেক সহজ করে দেবে।

কোয়ান্টাম কম্পিউটার নিয়ে এত মাতামাতি আসলে কেন? এটা বিশেষ কী করতে পারে? কোয়ান্টাম কম্পিউটারের কাজ করার প্রক্রিয়া প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। বিশাল বিশাল গাণিতিক সমস্যা সমাধানে এর দক্ষতা অনেক বেশি। বিশাল বিশাল মৌলিক সংখ্যা বের করার সময় আগের চেয়ে এখন বহুগুণে কমে যাবে। ক্রিপ্টোগ্রাফি বা কম্পিউটার সিকিউরিটির একটা বিশাল গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে মৌলিক সংখ্যা। যত বড় মৌলিক সংখ্যা হবে, সেটি ব্যবহার করে তত শক্তিশালী এনক্রিপশন তৈরি করা যাবে। নিরাপত্তাও বেড়ে যাবে বহুগুণে। কোয়ান্টাম কম্পিউটারের সাহায্যে খুব সহজেই ভেঙে ফেলা যাবে এখনকার কম্পিউটারের প্রচলিত নিরাপত্তাব্যবস্থা। বর্তমানের যত অনলাইন এবং অফলাইন নিরাপত্তা, সেটার বিশাল একটা অংশ তখন এর সামনে একদমই ভঙ্গুর হয়ে যাবে। মজার ব্যাপার হলো, কিছু গবেষক ইতিমধ্যে এক ধাপ এগিয়ে নতুন প্রযুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে কোয়ান্টাম হ্যাকিংকে প্রতিরোধ করা। আশার বাণী হলো, কোয়ান্টাম কম্পিউটারের এনক্রিপশনও নিশ্চয়ই এমন কিছু হবে, যা প্রচলিত-অপ্রচলিত সব হ্যাকিংকে পরাস্ত করতে পারবে।

বর্তমানে সুপারকম্পিউটারগুলো জটিল ধরনের রাসায়নিক বিক্রিয়ার সিমুলেশনের ক্ষেত্রে বেশ ভাল। ২০১৬ সালে গুগলের ইঞ্জিনিয়াররা প্রথমবারের মতো হাইড্রোজেনের অণুকে কোয়ান্টাম কম্পিউটারে সিমুলেট করতে সক্ষম হন। এরপর থেকে আইবিএম আরও জটিলতর রাসায়নিক ক্রিয়ার মডেল তৈরির চেষ্টা করে যাচ্ছে। গবেষকদের প্রত্যাশা, কোয়ান্টাম সিমুলেশন ব্যবহার করে তাঁরা এমনসব নতুন অণু গঠন করতে পারবেন, সেসব অণু ওষুধশিল্পে বা চিকিত্সাক্ষেত্রে বিপ্লব এনে দেবে। দুরারোগ্য ব্যাধিগুলোর নিরাময়ের সমাধান তখন হাতের মুঠোতে চলে আসবে।

আমরা এখনো জানি না, কোয়ান্টাম কম্পিউটারের বিশাল ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে আসলে ঠিক কী কী করা যাবে—এটা এক বিস্ময়কর ব্যাপার। আর এই না-জানাটাই আসলে অনেক ভালো লাগার একটি বিষয়!

লেখক: পরামর্শক, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়

সূত্র: টেকনোলজি রিভিউ, ডিজিটাল ট্রেন্ড ও নিউ সায়েন্টিস্ট নেক্সট ওয়েব

*লেখাটি বিজ্ঞানচিন্তার জুলাই ২০১৮ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়।