বন্যায় সহজেই তৈরি করুন নিরাপদ খাবার পানি

বন্যায় নিরাপদ পানি সবচেয়ে প্রধান সমস্যা। অথচ বন্যার পানিকেই আমরা পানের উপযোগী করে নিতে পারি, যদি তার মধ্যে থাকা ডায়রিয়া, টাইফয়েড, কলেরা ইত্যাদির রোগজীবাণুকে মেরে ফেলতে পারি। আর এ কাজটি কিন্তু কঠিন নয়। এরকম কয়েকটি পদ্ধতি এখানে তুলে ধরা হয়েছে।

১. চুলায় ফুটিয়ে নেয়া

পানি ফোটানো প্রাচীন পদ্ধতি। তবে আগেকার দিনে পানিকে ২০ মিনিট ফোটানোর কথা বলা হতো। আধুনিক গবেষণায় দেখা গেছে, তার কোনো প্রয়োজন নেই। পানি ফোটে ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়। সে তাপমাত্রায় পেটের অসুখের জীবাণু মেরে ফেলতে কয়েক মুহূর্তই যথেষ্ট। তাহলে পানি ফুটতে শুরু করলেই তাপ দেওয়া বন্ধ করে দিতে পারি। তাই বন্যার পানিকেই এভাবে চুলায় ফুটিয়ে নিয়ে পান করতে পারবেন, নিরাপদ খাবার পানির জন্য দূর-দূরান্তে যেতে হবে না। তবে আগে ঘোলা পানিকে মোটা কাপড় দিয়ে বা কয়েক পরত কাপড় (শাড়ি, লুঙ্গি বা চাদর) দিয়ে ছেঁকে নিন। ভাল হয় যদি ফিটকিরি ব্যবহার করে ভাসমান ময়লাকে নিচে থিতিয়ে নিতে পারেন।

তবে বন্যার সময় পানি গরম করার জন্য চুলা ও জ্বালানী পাওয়াটা কঠিন হতে পারে। তাই সূর্যের আলোয় সহজে পানিকে কীভাবে জীবাণুমুক্ত করা যায়, তার কয়েকটি পদ্ধতি নিচে তুলে ধরছি। এ পদ্ধতিগুলো যে কোনো উঁচু জায়গায়, এমনকি ভেলার উপরও স্থাপন করা যাবে।

ছবি ১ : সোলার ডিজইনফেকশন পদ্ধতি
উইকিপিডিয়া

২. SODIS বা সোলার ডিজইনফেকশন পদ্ধতি

১৯৮০ দশকে আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব বৈরুতে উদ্ভাবিত হওয়া এ পদ্ধতিটি সুইজারল্যান্ডের EAWAG কেন্দ্র প্রচার করে আসছে। একটি স্বচ্ছ ও পরিষ্কার পেট বোতলে (বাজারে খাবার পানি যে বোতলে সরবরাহ করা হয়) পানি ভরে সেটিকে পরিষ্কার রোদে ৬ ঘণ্টা রাখুন (ছবি ১)। এতে পানি তেমন গরম হয় না, কিন্তু রোদের আলট্রাভায়োলেট রশ্মি পানির ক্ষতিকর জীবাণু মেরে ফেলে। দুই লিটার বা তার কম আয়তনের বোতল ব্যবহার করবেন। কারণ এর থেকে বড় বোতলে পানির গভীরতা বেশি, তাই আলট্রাভায়োলেট রশ্মি নিচ পর্যন্ত পৌঁছুতে পারে না। একই কারণে পানি স্বচ্ছ হওয়া দরকার। ঘোলা পানি হলে আলট্রাভায়োলেট রশ্মি পানির নিচ পর্যন্ত ঢুকতে পারবে না। এক্ষেত্রে আগের বর্ণনা অনুযায়ী ফিটকিরি ব্যবহার করে থিতিয়ে নিন বা মোটা কাপড় দিয়ে ছেঁকে নিন।

যদি পেট বোতল পাওয়া না যায়, তবে ছবি ২-এ দেখানো আমাদের উদ্ভাবিত উপায়ে স্বচ্ছ পলিথিন (PE) বা পলিপ্রোপিলিন (PP) ব্যাগ ব্যবহার করে একই পদ্ধতিতে পানি জীবাণুমুক্ত করতে পারেন। এখানে আমরা এনামেল পেইন্ট দিয়ে কালো রঙ করা বাঁশের ডালা ব্যবহার করেছি। তার ওপর এ ব্যাগগুলো ছড়িয়ে দিলে আরও ভাল ফলাফল পাওয়া যাবে। কারণ কালো রঙ সূর্যের আলো শোষণ করে গরম হবে। এ তাপ আবার পানিতে সঞ্চারিত হবে, ফলে পানির তাপমাত্রা একটু বেড়ে যাবে। বাড়তি তাপমাত্রা ও আলট্রাভায়োলেট রশ্মি—দুইয়ে মিলে আরও তাড়াতাড়ি জীবাণু ধ্বংস করতে পারবে। আরও ভাল হয় যদি বাঁশের ডালার নিচে খড় বা শুকনো পাতা ইত্যাদির একটি পুরু বিছানা রাখা যায়। তাহলে তাপ নিচের দিকে হারিয়ে যাবে না এবং পানির তাপমাত্রা একটু হলেও বেশি হবে। ব্যাগের পানির গভীরতা কম হলে তাড়াতাড়ি কাজ হবে। পুরো ব্যাগ পানি দিয়ে ভরে ফেললে তা অনেক গভীর হবে মাঝখানটা। এজন্য আমরা যে বুদ্ধিটি করেছি, তা ছবি-৩ এ দেখানো হয়েছে।

ছবি ২

একটি স্বচ্ছ হাই ডেনসিটি পলিথিন (HDPE) ব্যাগের এক তৃতীয়াংশ পানি ভরে বাকি অংশের বাতাস বের করে দেওয়ার জন্য ওপরের অংশটি পেঁচিয়ে নিন। এরপর খোলা মুখটি বন্ধ করে দিন ওপরের দিকে গিট দিয়ে। ফলে ভেতরে বাতাস থাকবে না, কিন্তু ব্যাগটিকে মাটিতে ছেড়ে দিলে পানি ছড়িয়ে পড়বে (ছবি ২)। তাই এর গভীরতাও অল্প থাকবে (এক ইঞ্চির কম, আঙুলের এক কড়ার মতো)। এ অবস্থায় যে কোন সমান তলের ওপর পানি ভরা ব্যাগগুলো রোদে ছড়িয়ে রাখুন ৫-৬ ঘণ্টার মতো। ছবির মতো বাঁশের ডালাই যে হতে হবে তা নয়। সমতল মাটির ওপর বা বাঁশের চাটাই, কুলা, বড় থালা ইত্যাদির ওপরও রাখতে পারেন। তবে ঢালু টিনের চালে রাখলে পানি ব্যাগের নিচে জমা হয়ে গভীরতা বেড়ে যাবে, তাহলে আলট্রাভায়োলেট রশ্মি নিচ পর্যন্ত পৌঁছুবে না। তাই ঢালু কিছুর ওপর রাখবেন না।

ছবিতে আমরা কালো রঙ করা বাঁশের ডালা ব্যবহার করেছি। এর ওপর ব্যাগগুলো ছড়িয়ে দিলে আরও ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে। কারণ কালো রঙ সূর্যের আলো শোষণ করে গরম হবে। এ তাপ আবার পানিতে সঞ্চারিত হবে, ফলে পানির তাপমাত্রা একটু বেড়ে যাবে। বাড়তি তাপমাত্রা ও আলট্রাভায়োলেট কিরণ দুটো মিলে আরও তাড়াতাড়ি ধ্বংস করতে পারবে জীবাণু। আরও ভালো হয় যদি বাঁশের ডালার নিচে খড় বা শুকনো পাতা ইত্যাদির একটি পুরু বিছানা রাখা যায়। তাহলে তাপ নিচের দিকে হারিয়ে যাবে না, তাই পানির তাপমাত্রা একটু হলেও বেশি হবে। ব্যাগের পানির গভীরতা কম হলে তাড়াতাড়ি কাজ হবে। একটি কালো বাঁশের ডালার ওপর এরকম কয়েকটি ব্যাগ একসঙ্গে ছড়িয়ে দিন। যেহেতু পানির গভীরতা কম, আর তাপমাত্রা PET বোতলের ব্যবস্থা থেকে একটু বেশি, তাই প্রায় ৪ ঘণ্টার মধ্যেই পানি জীবাণুমুক্ত হবে। যে কোনো সমতল কিছু, যেমন বাঁশের চাটাই, কুলা, বড় থালা ইত্যাদির উপরে কালো প্লাস্টিক শিট বা কালো কাপড় বিছিয়েও তা করা যায়। বাজারে যে প্যাকিংয়ের কর্ক-শিট পাওয়া যায় তা পেলে আরও ভালো, কারণ এটি ভাল তাপ নিরোধক।

SODIS পদ্ধতিতে জীবাণুমুক্ত করা পানি দু-এক দিনের মধ্যেই ব্যবহার করে ফেলা উচিৎ। এ পদ্ধতিতে কিছু জীবাণু ধ্বংস হয় না, সেগুলো ঘরের তাপমাত্রায় আবার বেড়ে উঠতে পারে।

মাঝে মাঝে মেঘ থাকলে SODIS পদ্ধতি ভাল কাজ করবে না। সেক্ষেত্রে নিচে লেখা আমাদের উদ্ভাবিত সোলার পাস্তুরাইজেশন পদ্ধতি ব্যবহার করুন, অথবা ভালভাবে সংরক্ষণ করা বৃষ্টির পানি ব্যবহার করুন।

ছবি ৪

৩. সোলার পাস্তুরাইজেশন পদ্ধতি

পানিকে মাত্র ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় গরম করে সে তাপমাত্রায় আধা ঘণ্টা রাখতে পারলেই ক্ষতিকর জীবাণু মরে যায়। আর এর থেকে বেশি তাপমাত্রায় আরও কম সময়েই কাজ হয়। যেমন ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় লাগে মাত্র ১৫ সেকেন্ড। বিজ্ঞানী লুই পাস্তুরের নামে এ পদ্ধতিকে বলা হয় ‘পাস্তুরাইজেশন’ বা পাস্তুরিতকরণ। সূর্যের কিরণে সহজে পানিকে পাস্তুরিত করে জীবানুমুক্ত করা যায়। এ জন্য বিদেশে বেশ কিছু তৈরি যন্ত্র পাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের একটি উদ্ভাবন আছে, এটি অল্প খরচে স্থানীয় বাজারে পাওয়া যায়, এমন জিনিস দিয়ে বিখ্যাত ‘গ্রিন হাউস এফেক্ট’-কে কার্যকর করতে পেরেছে। ফলে পানির তাপমাত্রা ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকেও অনেক বাড়িয়ে ফেলা যায়। যে কেউ নিজেই বানিয়ে নিতে পারবেন। কারও কাছ থেকে যন্ত্র সরবরাহ পাবার জন্য বসে থাকতে হবে না।

এ পদ্ধতির জন্য ছবি-২-এ দেখানো কালো রঙ করা বাঁশের ডালার ব্যবস্থাটি ব্যবহার করব। এর ব্যাস ছিল প্রায় ৩০ ইঞ্চি। তবে ডালার নিচে প্রায় চার ইঞ্চি পুরু খড়ের বিছানা অবশ্যই লাগবে। এ বিছানার জন্য খড়গুলো একটি বড় পলিথিন ব্যাগে ঢুকিয়ে মুখটি গরম করে বা সেলাই করে বন্ধ করে নিলে সুবিধা হবে। কারণ, প্রতিদিনই যেহেতু এ কাজটি করতে হবে। তাছাড়া বৃষ্টি হলে খড় ভিজবে না। এর সঙ্গে দরকার দুটি বড় (প্রায় ৪ ফুট×৪ ফুট) স্বচ্ছ প্লাস্টিক শিট। এটা দিয়ে বাঁশের ডালাকে সম্পূর্ণ ঢেকে চার দিকে ওজন দিয়ে টান টান করে রাখা যাবে (ছবি ৪)। তবে শিট দুটির মাঝখানে একটি বাতাসের ফাঁকা স্তর থাকতে হবে, কোথাও লেগে গেলে হবে না। এজন্য ছবি ৪-এর ব্যবস্থায় আমরা ব্যবহার করেছি মোটা কাগজের তৈরি আধা ইঞ্চির মতো উচ্চতা বিশিষ্ট কয়েকটি আংটা। নিচের শিটটি যেন আবার পানি ভরা ব্যাগের সাথে লেগে না যায়, তার জন্য সেখানেও একই রকমের কয়েকটি আংটা লাগবে। অর্থাৎ, পানি ভরা ব্যাগের উপর একটি বাতাসের ফাঁকা স্তর থাকবে, আবার উপরের দুটো স্বচ্ছ শিটের মধ্যেও বাতাসের ফাঁকা স্তর থাকবে। বাঁশের ডালার ধারগুলোর উচ্চতা এ জন্য কাজে আসবে। ভাল করে দেখলে ছবি-৪ এ দুটি স্তরের কাগজের আংটাগুলো দেখতে পাবেন। কাগজের চিলতা কেটে নিয়ে আঠা দিয়ে বা স্টেপলারের পিন দিয়ে আটকে আংটা তৈরি করা যায়।

ছবি ৫

কাগজের বদলে পাটের দড়ি বা খড় পেঁচিয়েও আংটা তৈরি করা যায়, যেমনটি দেখানো হয়েছে ছবি ৫-এ। তবে এগুলো যেন সম্পূর্ণ শুকনো হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। না-হলে গরম হওয়ার পর এ থেকে জলীয় বাষ্প বেরিয়ে ওপরের স্বচ্ছ শিটের নিচে বিন্দু বন্দু শিশিরের মতও পানির ফোঁটা তৈরি করে সূর্যের আলো ঢুকতে বাধা দেবে। বাঁশের ডালাগুলো সাধারণত চিকন লোহার তার দিয়ে বাঁধা হয়। তারের মাথাগুলো বেরিয়ে থাকলে প্লাস্টিক শিটগুলো ফুঁটো করে দিতে পারে। তাই তারের মাথাগুলো মাঝখানে বাঁকা করে দিন, যেন প্লাস্টিকের শিটে স্পর্শ না করে। অথবা তার পাল্টিয়ে পাট বা নাইলনের সুতো দিয়ে বাঁধনগুলো নতুন করে দিয়ে নিন।

স্বচ্ছ প্লাস্টিক শিট পলিথিন, পলিপ্রপিলিন বা পিভিসি (PVC)-এর তৈরি হতে পারে। স্বচ্ছ পিভিসি শিট বাজারে টেবিল ক্লথ হিসেবে বিক্রি হয়। দাম একটু বেশি হলেও বেশি স্বচ্ছ হওয়ায় এতে কাজ ভাল হয়। চারদিকে ওজন দেওয়ার জন্য ছবি ৪-এ পাটের দড়ির তৈরি একটি মালা ব্যবহার করেছি আমরা। এর বদলে ছবি-৬-এর মত ৪/৫ টি ইট বা যে কোন ওজন দিয়ে চাপা দিলেও হবে। এক একটি ব্যাগে এক লিটার মতো পানি নিলে এরকম একটি ডালায় ৩টি বা ৪টি ব্যাগের পানি পাস্তুরিত করা যাবে। গ্রীষ্মের কড়া রোদে এক থেকে দেড় ঘণ্টায় জীবাণুমুক্ত করার মতো যথেষ্ট গরম (৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি) হবে। শীতকালের রোদে দু ঘণ্টা লেগে যেতে পারে। গরম হয়েছে কিনা, ব্যাগের ওপরে আঙুল দিয়ে স্পর্শ করে অনুভব করলেই বোঝা যাবে।

ছবি ৬

৬০ বা ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে আঙুল ধরে রাখা যাবে না। সঙ্গে সঙ্গে উঠিয়ে ফেলতে হবে। মুখ আটকানো ছোট-ছোট ব্যাগে এভাবে পানি পাস্তুরিত করার সুবিধা হলো, পানিতে হাতের স্পর্শ লাগছে না। তাই নতুন করে ঢুকতে পারছে না জীবাণু। এজন্য ব্যাগ না খুললে কয়েক মাস পর্যন্ত এ পানি নিরাপদ থাকবে। বন্যার সময় বিতরণের জন্য এ ব্যবস্থা খুবই সুবিধাজনক। চাইলে একটি বড় ব্যাগেও বেশি পানি গরম করা যায়। ছবি ৭-এ এরকম ব্যবস্থা দেখানো হয়েছে। তবে পানির গভীরতা যেন আঙুলের এক কড়া বা প্রায় ২ সেন্টিমিটারের বেশি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখবেন। এক্ষেত্রে ব্যাগের মুখটি না আটকে ডালার উঁচু ধারের ওপর দিয়ে বের করে দিতে পারেন। ব্যাগের মধ্যে পানির ওপরে বাতাসের বুদ বুদ থাকলে তা আঙুল দিয়ে আলতোভাবে চাপ দিয়ে মুখের দিকে বের করে দিন। না হলে এখানেও জলীয় বাষ্প তৈরি হবে এবং উপরের পলিথিনে বিন্দু বিন্দু শিশিরের ফোঁটার মতো জমা হয়ে সূর্য রশ্মি ঢুকতে বাধা দেবে। এরপর আগের মতও আংটার মাধ্যমে বাতাসের ফাঁকা স্তরের ব্যবস্থা করে দুটি স্বচ্ছ প্লাস্টিক শিট দিয়ে টান টান করে ঢেকে দিন। দু ঘণ্টা পর ব্যাগটির মুখের এক প্রান্ত ধরে সাবধানে উঠিয়ে নিন। কারণ পানি অনেক বেশি গরম হয়, তাতে আপনার হাত পুড়ে যেতে পারে। এবার ব্যাগ থেকে পানি পরিষ্কার একটি কলসে ঢেলে নিন এবং ঠান্ডা হওয়ার জন্য অপেক্ষা করুন।

ছবি ৭

যদি হাতের কাছে বড় একটি কর্ক-শিট পাওয়া যায়, তাহলে বাঁশের ডালা ব্যবহার না করলেও চলবে। খড়ও লাগবে না। কর্ক-শিটের পুরুত্ব এক ইঞ্চির বেশি হওয়া দরকার, তাহলে তাপ নিরোধের ব্যাপারটি ভাল হবে। কর্ক-শিটের পাশ থেকে এক বা দেড় ইঞ্চি চওড়া কতগুলো লম্বা টুকরো ছুরি দিয়ে কেটে নিন। কর্ক-শিটের চার ধারের ওপরে এই টুকরোগুলিকে প্রথমে কাঠের সাদা আঠা দিয়ে লাগান (ছবি ৮-এর মত)। আরও শক্ত করার জন্য কতগুলো টুথ-পিক বা নারকেলের শলা ব্যবহার করে টুকরোগুলিকে নিচের শিটের সঙ্গে গেঁথে দিন। একটু ডানে-বামে বাঁকা করে শলাগুলো লাগালে বেশি শক্ত হবে। শলার মাথাগুলো কর্ক-শিটের ভেতরে ঢুকিয়ে দেবেন, যেন তা বেরিয়ে না থাকে। এবার কর্ক-শিটটিকে সমান করা মাটিতে বিছিয়ে ছবি ৮-এর মতো ওপরে একটি কালো কাপড় বা কালো প্লাস্টিক শিট বিছিয়ে দিন। তৈরি হয়ে গেল তাপ নিরোধক পানির ট্রে।

ছবি ৮

এবার আগের মতো মুখ আটকানো ছোট ছোট ব্যাগে পানি ট্রের উপর রাখুন। অথবা ছবি ৯-এর মতো একটি স্বচ্ছ ও বড় পলিথিন ব্যাগ ট্রের উপর রেখে তার মধ্যে পানি ভরে নিন। মনে রাখবেন, পানির গভীরতা যেন আঙুলের এক কড়া বা প্রায় ২ সেন্টিমিটারের বেশি না হয়। বড় ব্যাগের মুখটি উঠিয়ে দিন এক পাশের উঁচু ধারের ওপর। ব্যাগের ভেতরে পানির ওপরে বাতাসের বুদ বুদ থাকলে তা আঙুল দিয়ে আলতোভাবে চাপ দিয়ে মুখের দিকে বের করে দিন। এবার আগের মতো ওপরে বাতাসের ফাঁকা স্তরের ব্যবস্থা রেখে দুটো স্বচ্ছ প্লাস্টিক শিট দিয়ে ঢেকে চারদিকে ওজন চাপিয়ে দিতে পারেন। তবে ছবি ১০ ও ১১-এর মতো আগে থেকেই একটি শক্ত ফ্রেমের ওপরে ও নিচে স্বচ্ছ প্লাস্টিক শিট টান টান করে লাগান। এখন এটি কর্ক-শিটের ট্রের ওপরে রেখে দিলেই কাজ হবে। প্রতিদিন করতে হলে এটি কাজকে অনেক সহজ করে দেবে। ছবি ১০-এ দেখিয়েছি বাঁশের তৈরি ফ্রেম আর ছবি ১১-তে দেখিয়েছি পিভিসি বা অ্যালুমিনিয়ামের পাইপ দিয়ে তৈরি ফ্রেম। দুটোই প্রায় ১ ইঞ্চি পুরু। এতে শক্তিও আসবে, আবার বাতাসের জন্য যথেষ্ট ফাঁকা স্তর পাওয়া যাবে। এ ব্যবস্থাটি তৈরি করার জন্য ফ্রেমের ওপরে ও নিচে দুপাশেই একটি করে স্বচ্ছ প্লাস্টিক শিট চারদিকে ফ্রেমের সঙ্গে স্বচ্ছ আঠাল প্লাস্টিক টেপ দিয়ে লাগান। এক্ষেত্রে একটি একটি করে শিট দুটো লাগালে সুবিধা হবে। শিট দুটো স্বচ্ছ পিভিসি হলে ভালো হয়। কর্ক-শিটের এ ব্যবস্থায় বাঁশের ডালা ও খড়ের বিছানার ব্যবস্থার তুলনায় বেশি তাপমাত্রা পাওয়া যাবে। আমরা আড়াই ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৯৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস পেয়েছি। পানির স্ফুটনাঙ্কের প্রায় কাছাকাছি। ছবি ৯ ও ১১-তে একটি ভাঁজ করা বা ফোল্ডিং টেবিলের সাথে মিশিয়েই ব্যবস্থাটি করা হয়েছে।

ছবি ৯

বৃষ্টির পানি সংগ্রহ

বৃষ্টির পানি মূলত ডিষ্টিলড ওয়াটার, যা বিশুদ্ধ। এতে রোগ-জীবাণু নেই। কেবল প্রথমদিকের কয়েক মিনিটে পড়া বৃষ্টিতে বাতাসের ভাসমান ধূলিকণা ইত্যাদি থাকতে পারে। তাই বৃষ্টি শুরুর পাঁচ মিনিট পর থেকে সংগ্রহ করা উচিৎ। তবে টিনের ছাদের থেকে সংগ্রহ করা পানি সরাসরি পান করা যায় না, কারণ তাতে পাখির মল, পচা পাতা, ইত্যাদি থাকতে পারে। আমাদের উদ্ভাবনে একটি পলিথিন শিট ব্যবহার করেছি, যেটি শুকিয়ে ঘরে পরিষ্কারভাবে রেখে দেবেন। আগে থেকেই শিটের চার কোণে প্লাষ্টিকের চিকণ ফিতা বা দড়ি দিয়ে বেঁধে চারটি লুপ বা আংটা তৈরি করে রাখুন। ছবি ১২-এর মতো চিকন বাঁশের চারটি খুঁটি একটি খোলা জায়গায় (গাছের নীচে নয়) মাটিতে সবসময় পুঁতে রাখবেন। এর পেছনের খুঁটি দুটির দূরত্ব সামনের দুটির দূরত্বের চেয়ে বেশি হবে। যখনই বৃষ্টি আসবে, তখনই শিটের চারকোণের লুপগুলো খুঁটির মাথায় আটকে দিলে পলিথিন শিটটি একটি ফানেলের আকার ধারণ করবে। ফানেলের নীচে একটি পরিষ্কার বালতি রেখে দিলেই যথেষ্ট পানি সংগৃহীত হয়ে যাবে। এই পানি পরে পরিষ্কার কলসে সংরক্ষণ করুন। সরাসরি পান করা যাবে এ পানি। যদি কেউ অন্য উপায়ে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে থাকেন এবং তা জীবাণুযুক্ত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে সোলার পাস্তুরাইজেশন পদ্ধতিতে জীবানুমুক্ত করে নিতে পারবেন। মেঘলা কিন্তু বৃষ্টি হয় না এমন দিনে, যেহেতু সৌর পদ্ধতিগুলো কাজ করবে না, তাই সব সময়েই কিছু বাড়তি পানি সংরক্ষণ করে রাখুন।

ছবি ১০

স্বাভাবিক সময়েও প্রয়োগ

বন্যা ছাড়া স্বাভাবিক ওপরের প্রযুক্তিগুলো ব্যবহার করা যেতে পারে। বিশেষ করে যেসব জায়গায় আর্সেনিকের সমস্যা প্রবল, সেখানে এ প্রযুক্তিগুলো সহজ সমাধান দিতে পারে। বৃটিশ জিওলজিক্যাল সার্ভের রিপোর্ট জানায়, বাংলাদেশে ৭০ ফুট থেকে ৩০০ ফুট গভীরের পানিতে আর্সেনিক আছে। নদী, হাওড়, খাল বিল, পুকুরের পানি আসে বৃষ্টির পানি, বরফ গলা পানি, ইত্যাদি থেকে। তাই এসব পানিতে আর্সেনিক নেই। এ পানি যখন মাটি চুইয়ে নিচের অ্যাকুইফায়ারে জমা হয়, সে পথে ভু-গর্ভস্থ শিলায় আর্সেনিক থাকলে তা থেকে দুষিত হয়। আর্সেনিকযুক্ত এলাকার আশে পাশে নদী, পুকুর, ইত্যাদি না থাকলে ৪০/৪৫ ফুট গভীরের টিউবওয়েল বসিয়ে বা স্বল্প গভীরতার পাত কুয়া স্থাপন করে সে পানিকে ওপরের প্রযুক্তি দিয়ে জীবানুমুক্ত করে নেয়া যায়। আবার পার্বত্য এলাকায় অনেকে ঘরের ছাদের পানি বেশি পরিমাণে সংরক্ষণ করেন। কিন্তু তা সহজে জীবাণু-দুষিত হয়, পান করা যায় না। ওপরের প্রযুক্তি ব্যবহার করে সে পানিকেও জীবাণুমুক্ত করে নেওয়া যায়।

ছবি ১১

অনুজীব পরীক্ষা ও বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়োগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ এবং সেন্টার অফ অ্যাডভান্সড রিসার্চ ইন সাইন্সেসের অণুজীব বিজ্ঞানীরা আমাদের উদ্ভাবিত এই পাস্তুরিত পানি করেছেন বহু পরীক্ষা। তাঁরা দেখেছেন, দেড় ঘণ্টা রোদে রাখলে ডায়রিয়া-গোত্রীয় সব পানিবাহিত রোগের জীবাণু ধ্বংস হয়। সঠিকভাবে সংরক্ষণ করে ছয় মাস পরও জীবাণুমুক্ত ছিল। CMES এবং ‘সামাজিক উন্নয়ন সংস্থা’ নামে দুটি এনজিওর চেষ্টায় বরিশালে প্রায় ৩০০ বেদে পরিবার এ ব্যবস্থাটি প্রয়োগ করা হয়। ২০০২ থেকে প্রায় তিন বছর নিজেরাই বাঁশের ডালার ব্যবস্থাটি তৈরি করে পানের পানির প্রয়োজন মিটিয়েছেন সেখানকার জনগোষ্ঠী। এছাড়া ইউল্যাবের একজন শিক্ষক ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় ঢাকার রায়ের বাজার বস্তিতে ফোল্ডিং টেবিল ব্যবস্থাটি সফলভাবে চালু করতে পেরেছিলেন। তারা সবাই এ কাজের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত।

বিশেষ সতর্কতা

আমরা জানি পলিথিন ব্যাগ যেখানে সেখানে ফেলে দিলে পরিবেশের বিরাট ক্ষতি হয়। তাই প্রথমেই চেষ্টা করুন পলিথিন ব্যাগগুলো যত বেশি পারা যায় পূনর্ব্যবহার করার জন্য। যখন নষ্ট হবে, তখন আশে পাশে ফেলে না দিয়ে একটি বড় ব্যাগের ভেতরে ছেঁড়া পলিথিন ব্যাগগুলো জমা করে রাখুন। যথেষ্ট জমা হলে এটি প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহকারীদের কাছে বিক্রি করে দিন।

কৃতজ্ঞতা

১৯৮২ থেকে অনেক ছাত্র-শিক্ষক-গবেষক আমাদের এ প্রজেক্টে কাজ করেছেন। সবার প্রচেষ্টা রয়েছে এর পিছনে, তাই এ কাজের কৃতিত্ব এদের সবার।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে সহযোগিতা

দেশের বর্তমান বন্যা পরিস্থিতিতে কেউ যদি আমাদের এ ব্যবস্থাটি ব্যবহার করে বন্যার্তদের মধ্যে নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করতে চান, তবে আমাদের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগাযোগ করুন। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এ পদ্ধতি ছড়িয়ে দেয়ার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।

এ বিষয়ে আমাদের কাজের উপর কয়েকটি ভিডিওর এবং তথ্যের লিংক:

vimeo.com/250583104

vimeo.com/177114281

vimeo.com/177105370

bmpt.du.ac.bd/publications/books-chapters/ [downlodable from item-04: A booklet on safe drinking water using simple techniques]

যোগাযোগ

বায়োমেডিকেল ফিজিকস অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগ, কার্জন হল ভবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ইমেইল: [email protected]