ফাইভ–জি নেটওয়ার্ক কি পাখির ক্ষতি করে?

২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে, ফাইভ–জি নেটওয়ার্কের তরঙ্গের কারণে মারা যাচ্ছে অসংখ্য পাখি। নেদারল্যান্ডসে ঝাঁকে ঝাঁকে ইউরোপীয় স্টার্লিং পাখি মরে পড়ে আছে, এমন ছবি দিয়ে বলা হয়, পঞ্চম প্রজন্মের মোবাইল নেটওয়ার্ক দায়ী এ জন্য। রাতারাতি ভাইরাল হয়ে যায় মাটিতে পড়ে থাকা ঝাঁকে ঝাঁকে পাখির ছবি। অনেক মানুষ বিশ্বাস করে, ফাইভ–জি নেটওয়ার্ক পাখি ও পোকামাকড়ের মৃত্যুর কারণ। তারা এই নেটওয়ার্কবিরোধী জনমত গড়ে তুলতে থাকে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে। ফাইভ–জি নেটওয়ার্ক চালু হয় ২০১৮ সালের শুরুতে। এই প্রযুক্তিতে মিলিমিটার তরঙ্গ ব্যান্ড ব্যবহার করা হয়, যা প্রতি সেকেন্ডে ২০ গিগাবিট গতি দিতে সক্ষম। এতে ব্যবহৃত হয় বড় পরিসরের ‘মাল্টিপল ইনপুট-মাল্টিপল আউটপুট’ অ্যানটেনা। চতুর্থ প্রজন্মের নেটওয়ার্ক থেকে এর কর্মক্ষমতা ন্যূনতম ১০ গুণ। এর মাধ্যমে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় অতি দ্রুত তথ্য পাঠানো যায়। অনেকে একই সঙ্গে একই নেটওয়ার্ক ব্যবহার করতে পারে লোডিং বা ধীরগতির যন্ত্রণা ছাড়াই।

২০২১ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশে চালু হয় পঞ্চম প্রজন্মের মোবাইল নেটওয়ার্ক। দেশের ছয়টি স্থানে পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হয় এটি। আশির দশকে প্রথম আসে ওয়ান-জি মোবাইল। শুধু কথা বলা যেত এতে৷ এরপর কথা বলার সঙ্গে এসএমএস আদান-প্রদান সুবিধা নিয়ে আসে টু-জি৷ এতে অতি ধীরগতিতে ইন্টারনেটও চালানো যেত। ২০০৩ সালে আসে থ্রি-জি, যার মাধ্যমে মুঠোফোনে যুক্ত হয় কিছুটা দ্রুতগতির ইন্টারনেট৷ ২০০৮ সালে ফোর-জির কারণে উচ্চগতি পায় মোবাইল ইন্টারনেট৷ ফাইভ-জি অতি উচ্চ গতির পাশাপাশি বিভিন্ন আইওটি ডিভাইসকেও যুক্ত করতে পারবে৷

পঞ্চম প্রজন্মের এই নেটওয়ার্কে যোগাযোগের জন্য উচ্চ কম্পাঙ্কের ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড ব্যবহার করা হয়, যা ট্রান্সমিশন সীমার মধ্যে জীবিত প্রাণীর ওপর তাপীয় প্রভাব ফেলতে পারে। তবে রেডিয়েশন নির্ধারিত সীমার মধ্যে থাকায় কোনো জীবের ক্ষতি হওয়ার কোনো প্রমাণ নেই। জার্মানির ফেডারেল অফিস ফর রেডিয়েশন প্রোটেকশন (বিএফএস) এ ধরনের বিকিরণের বিপদ সম্পর্কে বিশদ গবেষণা করেছে। তারা জানিয়েছে, ট্রান্সমিটার থেকে নির্গত তীব্রতা জীবদের ক্ষতি করতে পারে না। তাই পাখি বা মৌমাছির মতো পোকার ক্ষতি করছে মোবাইল নেটওয়ার্ক, এমন গবেষণাগুলোর যথাযথ বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।

ফোর্বস ম্যাগাজিনে প্রকাশিত সাইমন রকম্যানের রিপোর্ট অনুসারে, যুক্তরাজ্যে সাড়ে চার হাজার মানুষ বেতারতরঙ্গ বিকিরিত হয়, এমন অঞ্চলে কাজ করেন। তাঁদের অনুমতি দেওয়া হয়েছে সাধারণ মানুষের চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি তরঙ্গের বিকিরণের মধ্যে কাজ করার। ফলে তাদের ক্যানসার বা অন্য কোনো স্বাস্থ্য সমস্যা হয়েছে, এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

তবে ত্বকের ওপর বেতারতরঙ্গের তাপীয় প্রভাব আছে। দৃশ্যমান অথবা অবলোহিত আলো যে রকম প্রভাব ফেলে, এখানেও একই রকম প্রভাব দেখা যায়। অনেক বেশি পরিমাণ তরঙ্গ একসঙ্গে ত্বকে পড়লে তাপ উৎপন্ন হতে পারে। রেডিও মাস্ট বা টাওয়ারের চারপাশে একটি ছোট পরিত্যক্ত এলাকা থাকে সে জন্য। মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এই ব্যবস্থা। টাওয়ারের চারপাশের ১০ মিটার পরিধিজুড়ে বিকিরণসংকেত বেশ শক্তিশালী হয়। টাওয়ার উঁচু হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই মানুষ এই সীমার বাইরে থাকে। তাই ফাইভ–জি মানুষের জন্য নিঃসন্দেহে নিরাপদ।

ভারতে এক গবেষণায় বলা হয়, মুঠোফোনের তরঙ্গ মৌমাছির ক্ষতি করছে। দেখা যায়, মৌমাছিগুলো তাদের বাসায় আগের চেয়ে কম মধু জমা করছে। এ জন্য তারা দায়ী করে মোবাইল টাওয়ারকে। পরে দেখা যায়, মৌমাছিগুলো ভালোভাবে বিকিরণের সংস্পর্শে আসেনি। প্রাকৃতিক অন্যান্য কারণে তাদের খাবারের অভাব দেখা গেছে, তাই মধুর পরিমাণ কমে এসেছে।

ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির বায়োফিজিসিস্ট জো কিরশভিঙ্ক বেতারতরঙ্গ বিশেষজ্ঞ। তিনি জানিয়েছেন, রেডিও ট্রান্সমিশন অ্যানটেনা বা মোবাইল টাওয়ার থেকে ১০ মেগাহার্টজের ওপরে রেডিও তরঙ্গ বের হয়, যা পাখি বা মৌমাছিদের কোনো ক্ষতি করে না।

২০১৪ সালে জার্মানির জীববিজ্ঞানীদের একটি গ্রুপ দেখেছিল, কম মাত্রার চৌম্বকীয় বিকিরণ, যেমন এ এম রেডিও তরঙ্গ পরিযায়ী পাখিদের পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র ব্যবহার করে নিজেদের গন্তব্যে যাওয়ার ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে। পাখিদের এ থেকে এখনো রক্ষা করা সম্ভব। তাই গবেষকেরা এ এম রেডিও তরঙ্গের ব্যবহার সীমিত করার প্রস্তাব দিয়েছেন।

তামিল একটি ব্লকবাস্টার সিনেমা থেকে মোবাইল টাওয়ার বিষয়ে ভুল ধারণা তৈরি হয়। সিনেমায় দেখানো হয়, বিরূপ আবহাওয়ায় পাখি আলোর দিকে ছুটে আসে। মোবাইল টাওয়ারে যে আলো জ্বলে, তার আকর্ষণে পাখি ছুটে এসে ধাক্কা খায়, তারপর নিচে পড়ে গিয়ে ধরা পড়ে শিকারির হাতে। ইউটিউবে এ রকম ভিডিওগুলোতে দেখা যায়, অনেকেই দাবি করেন, প্রতিবছর লাখ লাখ পাখি মারা যায় মোবাইল টাওয়ারের কারণে। এসব ভিডিওতে অনেক মন্তব্য দেখা যায়, পরিবেশগত কারণে পঞ্চম প্রজন্মের তরঙ্গকে বন্ধ করে দেওয়া হোক! প্রযুক্তি আমাদের অনেক ক্ষতি করে ইত্যাদি। আসলে পাখি ও পতঙ্গের মৃত্যুর জন্য দায়ী পরিবেশগত মূল কারণগুলো আড়াল করে এ রকম কাল্পনিক প্রযুক্তিবিরোধী প্রচারণা চালান অনেকে। এতে মানুষের লাভ না হলেও পাখি ও পতঙ্গের ক্ষতি হয়। পাখি ও পতঙ্গ মারা যাওয়ার পরিবেশগত আসল কারণগুলো ঢাকা পড়ে যায় এসব গুজবের ভিড়ে।

মোবাইল সেলুলার নেটওয়ার্কের পঞ্চম প্রজন্ম—পাখি বা পোকা হত্যা করে না, মানুষের ক্ষতি করে না। মানুষ, পাখি ও পোকামাকড়ের জন্য এটি সম্পূর্ণ নিরাপদ।

লেখক: সহসমন্বয়ক, বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার

সূত্র: দ্য স্টার এবং অডাবন ডট অর্গ