উড়োজাহাজের ভেতর সব যাত্রী একসঙ্গে লাফ দিলে কী হবে?

উড়োজাহাজে চড়ার আগে অনেকেরই নার্ভাস লাগে বা এক ধরনের ভীতি কাজ করে। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। পৃথিবীর প্রায় ৩৩ থেকে ৪০ শতাংশ মানুষের মাঝেই এই ভীতি আছে। অর্থাৎ উড়োজাহাজে ওঠার আগে স্নায়ুবিক চাপ অনুভব করেন।

ধাতব ও কৃত্রিম এই মহাপতঙ্গের মতো বিশাল কাঠামো বায়ুতে ভেসে থাকাটা এক বিস্ময়। শূন্যে ছুটে চলা মানুষ ও মালামাল ভর্তি এই যান ভীতিকর মনে হলেও উড়োজাহাজ আসলে বেশ স্থিতিশীল বাহন। স্বাভাবিক অবস্থায় ট্রেন, বাস বা নৌযানের চেয়েও ঝাঁকুনি এতে কম হয়। কী? বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে? আসুন একটা পরীক্ষার মাধ্যমে বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাক। পরীক্ষাটি করবো আমরা যৌক্তিক কল্পনার মাধ্যমে।

ধরা যাক, আমাদের কাছে একটা বোয়িং ৭৭৭ উড়োজাহাজ আছে। আছে উড়োজাহাজ ভর্তি, অর্থাৎ ৫০০ যাত্রী। উড়োজাহাজের স্থিতিশীলতা পরীক্ষার জন্য সবাই মিলে মাঝ আকাশে একসঙ্গে লাফ দিবো। তাহলে কী ঘটবে, সেটা দেখাই আমাদের উদ্দেশ্য। গড়পড়তা ৫০০ মানুষ একসঙ্গে লাফ দিলে কতটা শক্তিটা প্রয়োগ করবে উড়োজাহাজের ওপর? বালির ব্যাগই বা কেন রাখা হয় উড়োজাহাজে? এসব প্রশ্নের উত্তর আমরা জানবো। সেইসঙ্গে জানবো উড়োজাহাজের সব যাত্রী একসঙ্গে লাফ দিলে আসলে কী ঘটবে?

মূল দৃশ্যপটে চলে যাই। যাত্রী বোঝাই উড়োজাহাজ উড্ডয়নের পর এখন মাঝ আকাশ দিয়ে ছুটে যাচ্ছে। আপনি এবং আমি এই উড়োজাহাজের দুজন যাত্রী। ঘটনাক্রমে আজই আমাদের পাইলটের জন্মদিন। উড়োজাহাজ সব ক্রু মিলে ঠিক করেছে, পাইলটকে এবার একটু ভিন্নভাবে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাবে। উড্ডয়নের ঠিক আধঘণ্টা পর সবাই মিলে উড়োজাহাজের মাঝে লাফ দিয়ে চমকে দিবে চালককে। দুষ্টুমি হিসেবে এটা কতটুকু ঝুঁকিমুক্ত সেই আলোচনায় এখন যাবো না। একটু পরেই প্রমাণ পেয়ে যাবো। যা-হোক, উড়োজাহাজের ক্রুরা কমপ্লিমেন্টারি নাস্তা দেওয়ার সময়, সবাইকে তাদের পরিকল্পনার কথা জানালো। নির্দোষ রসিকতা ও পাইলটের ক্রুদের ভালোবাসার কথা ভেবে উড়োজাহাজ সব যাত্রী লাফ দিতে রাজিও হলেন। একটু লম্বা যারা, তাঁরা নিজের আসন ছেড়ে গেলেন উড়োজাহাজের মাঝের ফাঁকা জায়গাতে। এখানে জায়গা ছাদের উচ্চতা একটু বেশি। সবাই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। ক্রু-র সংকেত পাওয়া মাত্রই ৫০০ যাত্রী একসঙ্গে লাফ দিলেন উড়োজাহাজের মাঝে! ফলাফলটা একটু পর বলছি।

 উড়োজাহাজের ক্ষেত্রে ওজনের ভারসাম্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভারসাম্যহীনতা উড়োজাহাজের জন্য মারাত্মক বিপদজনক। কোনো উড়োজাহাজে পর্যাপ্ত যাত্রী বা মালামাল না উঠলে, যাত্রীদের পুরো উড়োজাহাজে সমান ভাবে ভাগ করে বসানো হয়। মাঝে মাঝে উড়োজাহাজের ওজনের ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য বালির বস্তাও ব্যবহার করা হয়। প্রতিটি বালির বস্তার ওজন হয় ৫০ পাউন্ড বা ২৩ কেজি।

ভাবতেই পারেন, ভারসাম্য ব্যাপারটা যখন এতো গুরুত্বপূর্ণ, তখন ৫০০ মানুষ লাফ দিয়ে মুহূর্তের জন্য যে ওজনহীনতা এবং পর মুহূর্তে ধাক্কা তৈরি হবে, তাতে বড় বিপর্যয় তৈরি হতে পারে উড়োজাহাজে। আসলেই কি তেমন হবে?

গড়পড়তা প্রায় ৫০০ মানুষের ওজন হবে প্রায় ৩৭ হাজার ৫০০ কেজি। উড়োজাহাজের মাঝে সবাই একসঙ্গে লাফ দেওয়া মাত্র উড়োজাহাজের এই ওজনটা হঠাৎ কমে যাবে মুহূর্তের জন্য। উড়োজাহাজ যেহেতু কিছুটা হালকা হবে, তাই কিছুটা ওপরে উঠে যাবে। কতটা ওপরে? যাত্রীরা লাফ দেওয়ার সময় যতোটা ওপরে উঠেছিল, প্রায় ততোটা।

উড়োজাহাজের মেঝেতে যখন যাত্রীদের পা স্পর্শ করে ঠিক সেসময় প্রায় ১০টি হাতি বা প্রায় ৮০০ মানুষের সমান ওজনের ধাক্কা দেয় উড়োজাহাজকে। এই ধাক্কাটা উড়োজাহাজের নিয়ন্ত্রণ হারানোর জন্য যথেষ্ট হতো, যদি উড়োজাহাজটি আকাশে স্থির ভেসে থাকতো। কিন্তু আমাদের এই উড়োজাহাজটি প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ৮৭০ কিলোমিটার বেগে চলছে। উড়োজাহাজের ভরবেগ অনেক বেশি হওয়ায় এই ধাক্কা উড়োজাহাজের জন্য কোনো ঝুঁকির কারণ হবে না। বড়জোর সামান্য একটু ঝাঁকুনি হবে। খুব সহজেই পাইলট এই ঝাঁকুনি সামলে নিতে পারবেন। হয়ত কিছুটা বিরক্তও হবেন। এর বেশি কিছু নয়।

এখানে গড়পড়তা ৫০০ মানুষের ওজন ধরেছি ৭৫ কেজি করে। ঘটনা বদলে যেত যদি উড়োজাহাজে ৫০০ সুমো কুস্তিগীর থাকতেন। সেক্ষেত্রে প্রতিটি মানুষের ওজন হতো প্রায় ২০০ কেজি।

এছাড়া উড়োজাহাজের মাঝে লাফ দেওয়ার এই ব্যাপারটি বিপদজনক হতো, যদি সেটা মাঝ আকাশে না করে উড়োজাহাজ উড্ডয়ন বা অবতরণের সময় করা হতো। কারণ এ দুই সময়ে উড়োজাহাজে গতিবেগ কম থাকে। ফলে, ভরবেগও থাকে কম। এ সময় সামান্য ভরের তারতম্য বিপদ ডেকে আনতে সক্ষম।

এখানে আমরা কল্পনা করেছি সবাই একসঙ্গে লাফ দিয়েছে। এই ব্যাপারটা বাস্তবে প্রায় অসম্ভব। সবমিলিয়ে উড়োজাহাজের সব যাত্রী এক লাফ দিলে মাঝ আকাশে কোনো ক্ষতির আশঙ্কা নেই। এমনটাই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। যেদিক থেকেই দেখি না কেন, গাড়ি কিংবা ট্রেনের মতো যানবাহনের চেয়ে উড়োজাহাজের ভ্রমণ অনেক নিরাপদ। শুধু শুধু উড়োজাহাজ যাত্রা নিয়ে দুশ্চিন্তা করার তাই তেমন কোনো কারণ নেই।

লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা

সূত্র: হোয়াটইফ শো, সায়েন্স অ্যালার্ট, উইকিপিডিয়া, ফোর্বস, হাইপারটেক্সটবুক