বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ইয়াসির মুহাম্মদ তাসিফ খান। চলতি বছর গুগলের সেরা বিজ্ঞানীর সম্মাননা ‘গুগল রিসার্চ অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছেন তিনি। বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ গবেষণা পদকগুলোর একটি এই গুগল রিসার্চ অ্যাওয়ার্ড। এর আগে, তিনবার বিখ্যাত বিজ্ঞান জার্নাল নেচার-এর প্রচ্ছদে স্থান পেয়েছেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে পোস্ট-ডক্টরাল রিসার্চের সময় একটা নতুন টিউমার সেন্সর ডিজাইন করেন তাসিফ খান। এই সেন্সরের সাহায্যে টিউমারের আয়তন মাপা যায়। টিউমারের আয়তন যদি ১০ মাইক্রোমিটারও বৃদ্ধি পায়, তবু তা মাপা যায় এই সেন্সরের সাহায্যে। ১০ মাইক্রোমিটার মানে, একটি চুলের প্রস্থের সমান। তাঁর এ গবেষণাপত্রটি প্রথমে সায়েন্স অ্যাডভান্স জার্নালে প্রকাশিত হয়। পরে শিরোনাম হয় বিখ্যাত জার্নাল নেচার-এ।
তাসিফ খানের বাড়ি বাংলাদেশের চট্টগ্রামে। বয়স ৩৫ বছর। পড়াশোনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি ও অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির মতো বিখ্যাত সব বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাংলাদেশি এই বিজ্ঞানী স্নাতক সম্পন্ন করেছেন ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস অ্যাট ডালাস থেকে। কাউস্ট থেকে মাস্টার্স এবং ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া থেকে করেছেন পিএইচডি। পোস্ট-ডক্টরাল গবেষণা করেছেন স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে। বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ায় ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে রয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বার্কলির ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ায় গবেষণাকালে তিনি ফ্লেক্সিবল ইলেকট্রনিকস এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহায়তায় হাতের পেশির সংকেত ব্যবহার করে রোবটিক বাহু সঞ্চালন করেন। তাসিফ খানের এ গবেষণাটিও নেচার ইলেকট্রনিকস জার্নালে প্রকাশিত হয়। তাঁর এ গবেষণাপত্রটি নানাভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে হাইপার ডাইমেনশনাল কম্পিউটিং ও আনসুপারভাইসড লার্নিং গবেষণায়।
ইলেকট্রনিক ত্বকের ওপর তাঁর আরেকটি উল্লেখযোগ্য অবদান হলো, হাতের আঙুলের মতো সংবেদনশীল সেন্সর আবিষ্কার। এই সেন্সরটি ত্বকের মতোই কোমল। স্পর্শ করলেই ইলেকট্রনিক সিগন্যাল তৈরি করে। এই গবেষণাটিও প্রকাশিত হয় সায়েন্স অ্যাডভান্সেস জার্নালে। এটি পরে নেচার ইলেকট্রনিকস-এ প্রকাশিত হয় বিশেষ প্রচ্ছদ হিসেবে।
প্রেশার আলসারের ডায়াগোনসটিকসের জন্য তিনি আরও একটি ইলেকট্রনিক সেন্সর উদ্ভাবন করেছেন। এই সেন্সরের সাহায্যে আলসার চোখে দেখার আগেই ইলেকট্রনিক সিগন্যাল দিয়ে নির্ণয় করা যায়। এই প্রবন্ধটিও প্রথমে নেচার কমিউনিকেশেন জার্নালে প্রকাশিত। পরে স্থান পায় বিবিসি নিউজ-এর প্রচ্ছদে।
এ ছাড়াও অক্সিমিটারের ওপর মৌলিক গবেষণা করে তিনি পৃথিবীর প্রথম জৈব পদার্থের অক্সিমিটার, রিফ্লেকশন মোড অক্সিমিটার ডিজাইন করেন। এসব গবেষণার তথ্যও প্রকাশিত হয় নেচার কমিউনিকেশেন, যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেস ও অ্যাডভান্সড ম্যাটেরিয়ালস জার্নালে।
তাসিফ খান প্রমাণ করেছেন, গায়ের রং ভিন্ন হলে অক্সিমিটারের মতো ডিভাইসগুলো একই ভাবে কাজ করে না। তাই যাঁদের গায়ের রং বাদামি বা কালো, তাঁদের জন্য ভিন্ন ধারার অক্সিজেন পরিমাপক যন্ত্র উদ্ভাবন করেছেন তাঁরা।
এ বিষয়ে তাসিফ খান বলেন, ‘আমরা ত্বকের মতো নতুন ধরনের ইলেকট্রনিকস বানাতে চাই। এতে থাকবে সবচেয়ে আধুনিক পরিধানযোগ্য প্রযুক্তি (ওয়্যারেবল টেকনোলজি), কেমিক্যাল সেন্সিং এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এ প্রযুক্তি সফল হলে আমরা এমন ওয়্যারেবল টেকনোলজি বানাতে পারব, যা দেখে ত্বকের অংশ বলেই মনে হবে। এ ধরনের প্রযুক্তিকে বলা হয় অদৃশ্য প্রযুক্তি। মেডিকেল ডিভাইসে এ প্রযুক্তির সম্ভাবনা প্রচুর।’
এই বিজ্ঞানী আরও জানান, ‘অক্সিমিটার রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ নির্ণয় করে। এ নিয়ে আমি প্রায় ৭ বছর কাজ করছি। পিএইচডির শুরু থেকেই চেষ্টা করছিলাম, অক্সিমিটারকে কীভাবে পরিধানযোগ্য করা যায়। কোভিডের সময় অক্সিজেন মাপার জন্য অক্সিমিটারের ব্যবহার অনেক বেড়ে যায়। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব মিশিগানের চিকিৎসকরা দেখেন, অক্সিমিটার সব ত্বকের রঙের ওপর একভাবে কাজ করে না। এতে যেহেতু আলো ব্যবহার করা হয়, ফলে ত্বকের রঙের ওপর নির্ভর করে অক্সিজেনের মাত্রা বোঝা যায়। গায়ের রং হালকা হলে অক্সিমিটার ঠিক মতো কাজ করে। কিন্তু রং গাঢ় হলে অক্সিমিটারে ভুল দেখায়। কারণ, এ ধরনের অক্সিমিটারগুলো পাশ্চাত্যে বানানো। সেখানকার বেশিরভাগ মানুষের গায়ের রং ফরসা বা হালকা ফরসা। এই রিপোর্ট প্রকাশের পর আমি এর সমাধানের জন্য একটা প্রকল্প শুরু করি। এ বছর আমরা একটা নতুন অক্সিমিটার ডিজাইন করেছি, যেটা ত্বকের রঙের ওপর নির্ভর করে না। এই অক্সিমিটার প্রকল্পের জন্যই আমি ২০২৩ সালের ‘‘গুগল রিসার্চ অ্যাওয়ার্ড’’ পেয়েছি।’
এই বাংলাদেশি বিজ্ঞানী মনে করেন, বাংলাদেশে এই গবেষণা কাজে লাগানো যেতে পারে। ‘নতুন অক্সিমিটারটি সহজেই বাংলাদেশে ব্যবহার করা যাবে। আর আমাদের গায়ের রং যেহেতু গাঢ়, এই গবেষণার ফল বাংলাদেশে সরাসরি কাজে লাগানো যাবে।’ সবাই যেন সহজে মেডিকেল ডিভাইস ব্যবহার করতে পারে, তা নিশ্চিত করতেই কাজ করে যাচ্ছেন তাসিফ খান।
এই বিজ্ঞানীর বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামের রহমতগঞ্জে। ফয়েজ আহমদ খান ও রওশন আরা ফয়েজের ছোট সন্তান তাসিফ খান। পড়াশোনা করেছেন চট্টগ্রামের সেন্ট মেরি’স স্কুল, চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল এবং চট্টগ্রাম কলেজে। এর আগেও তিনি ফাই কাপ্পা ফাই অ্যাওয়ার্ড, গোল্ডেন কি অনার সোসাইটি অ্যাওয়ার্ড, ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন গ্রান্ট, নেক ফ্লেকস গ্রান্ট পুরস্কার পেয়েছেন।