বড় হচ্ছে পারমাণবিক প্রযুক্তির বাজার
যুদ্ধ নয়, মানুষের কল্যাণ ও উন্নয়নে দেশে দেশে বাড়ছে পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার। এর মধ্যে অন্যতম হলো পারমাণবিক শক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন। তবে শুধু বিদ্যুৎ খাত নয়, আরও নানা খাতে পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার বাড়াতে তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন প্রযুক্তি। বড় হচ্ছে পারমাণবিক প্রযুক্তির বাজার। বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত এ বাজারে নতুন নতুন পণ্য নিয়ে আসছে রাশিয়া।
জ্বালানি ও প্রযুক্তির নতুন বাজার দখলে পারমাণবিক শক্তির বহুমুখী ব্যবহার নিয়ে কাজ করছে রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত পারমাণবিক শক্তি করপোরেশন—রোসাটম। বিদ্যুৎ উৎপাদনে তারা নিয়মিত পারমাণবিক জ্বালানি রপ্তানি করে বিভিন্ন দেশে। এর পাশাপাশি পারমাণবিক প্রযুক্তি, চিকিৎসা খাতে রোগনির্ণয় ও বিদ্যুৎ–চালিত গাড়ির বাজারে নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরি করতে চায় রাশিয়া।
পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের মধ্য দিয়ে পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারকারী দেশের সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশও বিদ্যুৎ খাতের মধ্য দিয়ে পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারকারী দেশের তালিকায় নাম লিখিয়েছে। আগামী বছর উৎপাদনে আসতে পারে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। বাংলাদেশেও পারমাণবিক প্রযুক্তির বাজার সম্প্রসারণে আগ্রহ আছে রাশিয়ার। এ নিয়ে কূটনৈতিক তৎপরতা চলমান।
রাশিয়ার পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারের ৮০ বছর পূর্তিতে মস্কোয় গত সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে আয়োজিত হয়েছে ওয়ার্ল্ড অ্যাটমিক উইক বা বিশ্ব পারমাণবিক সপ্তাহ। এর আয়োজন করেছে রোসাটম। এতে পারমাণবিক প্রযুক্তির নানা ব্যবহার নিয়ে একাধিক সেমিনার করা হয়। নতুন প্রযুক্তির প্রদর্শনী করা হয়। রোসাটমের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলেন, পারমাণবিক শক্তির ভৌগোলিক পরিসর বাড়ছে। পারমাণবিক শক্তি নিয়ে রাশিয়ার প্রথম আয়োজনে ২৫টি দেশ অংশ নিয়েছিল। আর এবার ১১৮টি দেশের ২০ হাজারের বেশি প্রতিনিধি অংশ নিয়েছেন। এটিকে সফলতা হিসেবে দেখছে তারা। এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলোকে সঙ্গে নিয়ে একটি বিকল্প জ্বালানি জোট তৈরির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে রাশিয়া।
বৈশ্বিক জ্বালানির সংকট ও জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প খুঁজছে বিশ্ব। এতে একটা শূন্যতা তৈরি হচ্ছে। পারমাণবিক প্রযুক্তি, জ্বালানি সরবরাহ ও বিনিয়োগ মডেলের মাধ্যমে এ সুযোগ নিতে চাচ্ছে রাশিয়া। রোসাটমের কর্মকর্তারা বলছেন, টেকসই জ্বালানির ভবিষ্যৎ পারমাণবিক শক্তির ওপর নির্ভর করবে। এটি পরিচ্ছন্ন, নির্ভরযোগ্য ও দীর্ঘমেয়াদি উৎস। তাই সব জাতি ও সব দেশ যেন পারমাণবিক প্রযুক্তির সর্বশেষ সাফল্যে ন্যায্যভাবে প্রবেশাধিকার পায়। আর পারমাণবিক সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্ক হতে হবে পারস্পরিক অংশীদারত্ব ও শ্রদ্ধাপূর্ণ সহযোগিতার ভিত্তিতে। যেসব দেশ পারমাণবিক শক্তি বিকাশে আগ্রহ প্রকাশ করে, তাদের সঙ্গে রোসাটম এই নীতিতেই কাজ করে যাচ্ছে।
১৯৫০–এর দশক থেকে এখন পর্যন্ত সোভিয়েত ও রুশ নকশায় বিশ্বজুড়ে ৫৯টি বিদ্যুৎ ইউনিট ও ২২টি গবেষণা রিঅ্যাক্টর বা চুল্লিপাত্র নির্মিত হয়েছে। এ চুল্লিপাত্র হলো পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের হৃদয়। এর ভেতরে পারমাণবিক জ্বালানি প্রবেশ করিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। সোভিয়েত ও রুশ পারমাণবিক–শিল্পের ইতিহাসে মোট ২৫০টি পারমাণবিক চুল্লিপাত্র তৈরি হয়েছে, যার মধ্যে ৮০টি রপ্তানির জন্য। সবশেষ চুল্লিপাত্রটি রপ্তানি হয়েছে তুরস্কে। বাংলাদেশের রূপপুরেও দুটি চুল্লিপাত্র সরবরাহ করেছে রাশিয়া।
২০২৪ সালে বিশ্বে ৭ গিগাওয়াট নতুন পারমাণবিক বিদ্যুৎ চালু হয়েছে। ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ ১২ গিগাওয়াট, আর ২০২৬ সালেও একই পরিমাণ যুক্ত হওয়ার আশা। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ছাড়া ভারত, চীনসহ বিশ্বের নানা দেশে পণ্য সরবরাহ করেছে জিও পোদলস্ক। এ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা বলেন, বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা ও টেকসই উন্নয়নের পথে পারমাণবিক শক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। চিকিৎসা খাতেও কাজ করার সুযোগ আছে।
তৈরি হচ্ছে ছোট আকারের চুল্লিপাত্র
বিশ্বের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হয়েছে ১৯৫২–১৯৫৪ সময়ে, সোভিয়েত ইউনিয়নে। ওই সময় থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের যন্ত্রপাতি তৈরিতে কাজ করছে রোসাটমের সহযোগী প্রতিষ্ঠান জিও পোদলস্ক। পারমাণবিক ও তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের ভারী যন্ত্রপাতি তৈরি করে তারা। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রেও যন্ত্রপাতি সরবরাহ করেছে জিও পোদলস্ক। গত ২৪ সেপ্টেম্বর মস্কোর অদূরে পোদলস্ক শহরে অবস্থিত এ প্রতিষ্ঠানের কারখানা ঘুরে দেখা গেছে, এখানে তৈরি হচ্ছে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অত্যাধুনিক ইঞ্জিন, বয়লার ও ভারী যন্ত্রপাতি। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র হলো নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর ভেসেল বা পারমাণবিক চুল্লিপাত্র, সেই চুল্লিপাত্র তৈরি হয় এ কারখানায়। এখন ছোট আকারের চুল্লিপাত্র তৈরি করছে তারা। এতে অনেক দেশ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করতে পারবে।
জিও পোদলস্কের কর্মকর্তারা বলেন, বিশ্বে এখনো প্রায় ৭৫ কোটি মানুষ নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ–সুবিধা থেকে বঞ্চিত; অর্থাৎ বিশ্বের প্রতি ১০ জনের একজনের ঘরেই বিদ্যুৎ নেই। বিশ্বের অনেক অঞ্চলে এখনো বিদ্যুৎ–সুবিধা পৌঁছায়নি। অর্থনৈতিক বিবেচনায় সেখানে বড় আকারের বিদ্যুৎকেন্দ্র করা যৌক্তিক নয়। দীর্ঘ সঞ্চালন লাইনও টেনে নেওয়া সম্ভব নয়। এমন অঞ্চলে বিদ্যুৎ–সুবিধা এনে দিতে পারে ছোট আকারের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে ৭০টি ছোট আকারের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ চলছে। রোসাটম প্রথম এ ধরনের ছোট বিদ্যুৎকেন্দ্রের সূচনা করেছে। ৬০ বছর ধরে বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে এসব কেন্দ্র। ৫৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার ছয়টি ইউনিট মিলে উজবেকিস্তানে ৩৩০ মেগাওয়াট ক্ষমতার পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করছে রোসাটম। ইরানেও ছোট চুল্লিপাত্র সরবরাহের সমঝোতা স্মারকে সই করেছে রাশিয়া। ১০ মেগাওয়াট ক্ষমতারও চুল্লিপাত্র তৈরি করছে পোদলস্ক। এর চেয়ে ছোট আকারের চুল্লিপাত্র তৈরির গবেষণা চলছে। এ ছাড়া ছোট আকারের চুল্লিপাত্র ব্যবহার করে ভাসমান পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করছে রোসাটম। দুর্গম এলাকায় বিদ্যুৎ–সুবিধা নিশ্চিত করতে পারে ভাসমান বিদ্যুৎকেন্দ্র।
ছোট পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হতে পারে আগামী দিনে বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সবচেয়ে কার্যকর সমাধান। কম খরচে, দ্রুত ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এ ধরনের প্রকল্প স্থাপনে আগ্রহ দেখাচ্ছে রোসাটম। বিশ্বের উন্নয়নশীল বেশ কিছু দেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে ছোট প্রকল্পকে আদর্শ বলছেন রোসাটমের কর্মকর্তারা। তাঁদের মতে, এটি আরও বেশি নিরাপদ ও সাশ্রয়ী। রাশিয়ায় এ ধরনের দুটি প্রকল্প পরীক্ষামূলকভাবে চলছে, যা থেকে দুটি শহরে দুই লক্ষাধিক মানুষের বিদ্যুতের চাহিদা মেটানো হচ্ছে। বাংলাদেশের মতো নদীমাতৃক বা সমুদ্রতীরবর্তী দেশে যা খুবই কার্যকর হবে বলে আশা করছেন রুশ কর্মকর্তারা।
অ্যাটম গাড়ি বানাচ্ছে রাশিয়া
রাশিয়ার বিজ্ঞানীরা ফিউশন পরমাণু শক্তির গবেষণা ও উন্নয়নেও ব্যাপক গুরুত্ব দিচ্ছেন। তাঁরা বলছেন, আগামী দিনের বিদ্যুৎ ও জ্বালানির অন্যতম উৎস হবে ফিউশন পরমাণু শক্তি। এটি হবে পরিবেশবান্ধব ও অনেকটাই ঝুঁকিমুক্ত। পারমাণবিক শক্তির সঙ্গে হাইড্রোজেন জ্বালানির যৌথ মিশ্রণে নতুন এক ফিউশন প্রযুক্তি গড়ে তুলতে কাজ করছে রোসাটম।
বিদ্যুৎ–চালিত গাড়ি জনপ্রিয় হচ্ছে বিশ্বজুড়ে। চীনে এটা অনেক বেশি দেখা যায়। বেইজিং বা সাংহাইয়ের রাস্তায় প্রায় ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ গাড়ি এরই মধ্যে সবুজ লাইসেন্স প্লেটধারী। তার মানে, এগুলো হাইব্রিড বা বিদ্যুৎ–চালিত। এটি দ্রুতই রাশিয়াসহ সব দেশে ছড়িয়ে পড়বে। এত বিদ্যুৎ–চালিত গাড়ির জন্য বিদ্যুতের উৎস প্রয়োজন। যেখানে নির্ভরযোগ্য সমাধান হতে পারে পারমাণবিক শক্তি। পারমাণবিক ব্যাটারিচালিত গাড়ি তৈরি করছে রাশিয়া। এবার অ্যাটম নামে একটি গাড়ির প্রদর্শনী করা হয়েছে বিশ্ব পারমাণবিক সপ্তাহে। আগামী বছর থেকে এ গাড়ি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের পরিকল্পনা আছে। এর পাশাপাশি দুটি বিশাল ব্যাটারি কারখানা নির্মাণ করেছে রাশিয়া। এক লাখ বিদ্যুৎ–চালিত গাড়ির ব্যাটারি সরবরাহ করা হবে। তবে এগুলো শুধু গাড়ির জন্য নয়, বিদ্যুৎ খাতেও শক্তি সঞ্চয়ের কাজে ব্যবহার করা যাবে।
রোসাটম বলছে, মানবজাতির ভবিষ্যৎ মূলত বিদ্যুৎ–চালিত গাড়ির ওপর নির্ভর করবে। বিশ্বের বড় বড় শহরের বায়ুদূষণের সবচেয়ে বড় উৎস হচ্ছে পরিবহন। তাই যত দ্রুত পরিবহন খাত বিদ্যুৎ–চালিত যানবাহনে রূপান্তর করা যাবে, তত দ্রুত শহরের মানুষ নির্মল বাতাস পাবে।
বরফের সাগরে চলবে জাহাজ
রাশিয়ার উত্তর সাগর ব্যবহার করে এশিয়া ও ইউরোপের বাণিজ্য পথ তৈরি করতে চায় রাশিয়া। এটি এখন তাদের কৌশলগত অগ্রাধিকার। তারা বলছে, এটি ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে ছোট ও সরাসরি সমুদ্রপথ। তাই এটি সবচেয়ে সম্ভাবনাময় সাগরপথ। এ সাগর অধিকাংশ সময় বরফে আচ্ছাদিত থাকে। বরফ কেটে জাহাজ চালাতে হয়। এর জন্য পারমাণবিক আইসব্রেকারের বহর তৈরি করছে রাশিয়া।
রোসাটমের কর্মকর্তারা বলছেন, চীন, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া ও আরও অনেক দেশ এই সাগরপথ ব্যবহারে আগ্রহী। এটি আফ্রিকা ঘুরে বা সুয়েজ খাল দিয়ে যাওয়ার বিকল্প হিসেবে সময় ও খরচ সাশ্রয়ী হতে পারে। সমুদ্রে বর্তমানে আটটি পারমাণবিক আইসব্রেকার পরিচালনা করছে রোসাটম। এর মধ্যে চারটি নির্মাণাধীন, যার মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী জাহাজের নাম রাশিয়া। চার মিটার পুরু বরফ ভেদ করে চলতে পারবে এ জাহাজ।
রোসাটম এখন ৫০টির বেশি দেশে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। এর মধ্যে রয়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, আইসোটোপ সরবরাহ, চিকিৎসাপ্রযুক্তি, পরিবহন অবকাঠামো, কোয়ান্টাম গবেষণা ও তথ্যপ্রযুক্তি খাত। তারা বলছে, ভবিষ্যতের প্রযুক্তির মেরুদণ্ড হয়ে উঠবে কোয়ান্টাম কম্পিউটার। এর মাধ্যমে দ্রুততর গণনা, নতুন উপাদান উদ্ভাবন, ওষুধ উন্নয়ন, প্রকৌশল সমাধান—সব ক্ষেত্রেই নতুন দিগন্ত খুলবে। রোসাটমের নেতৃত্বে বর্তমানে একটি বৃহৎ বৈজ্ঞানিক কনসোর্টিয়াম চারটি ভিন্ন বৈশ্বিক পদ্ধতিতে কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরির ওপর কাজ করছে।
এদিকে ওয়ার্ল্ড নিউক্লিয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য হয়েছে বৈশ্বিক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফট। আগে সংগঠনটি ছিল মূলত পারমাণবিক বিশেষজ্ঞদের ক্লাব। ডিজিটাল প্রযুক্তি কোম্পানির এতে যুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে নতুন অধ্যায় রচিত হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
মস্কোয় ২৬ সেপ্টেম্বর আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে রোসাটমের প্রথম উপমহাপরিচালক কিরিল কামারভ বলেন, বাংলাদেশ ও ভারত এশিয়ায় পারমাণবিক শক্তি বিকাশের অগ্রদূত। এশিয়ার অনেক দেশ পারমাণবিক শক্তি নিয়ে সতর্ক ছিল, কিন্তু এখন তাদের আগ্রহ বাড়ছে। প্রতিটি দেশে দীর্ঘমেয়াদি অংশীদারত্বের নীতি অনুসরণ করে রোসাটম। পারমাণবিক শক্তিকে কখনো অস্ত্র নয়; বরং উন্নয়ন ও মানবতার কল্যাণের জন্য ব্যবহার করতে চায় তারা।
থ্রি–ডি প্রিন্টারে তৈরি হচ্ছে ভারী যন্ত্র
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের পথে অন্যতম চালিকা শক্তি হতে পারে অ্যাডিটিভ টেকনোলজি বা সংযোজন প্রযুক্তি। এটি মূলত থ্রি–ডি প্রিন্টার হিসেবে পরিচিত। এটি এমন এক প্রক্রিয়া, যেখানে ডিজিটাল মডেল অনুসারে স্তর স্তরে বস্তু গঠন করা হয়। সাধারণত ধাতু, পলিমার, সিরামিক ইত্যাদি উপাদান ব্যবহার করে এই প্রযুক্তিতে যন্ত্রাংশ, মডেল, এমনকি সম্পূর্ণ অবকাঠামো তৈরি সম্ভব। এটি প্রচলিত কাটিং বা ছাঁচনির্ভর উৎপাদন পদ্ধতির বিপরীতে একটি ‘সংযোজনমূলক’ পদ্ধতি। রাশিয়ার অ্যারোস্পেস ও প্রতিরক্ষা খাতে অ্যাডিটিভ টেকনোলজির ব্যবহার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ফাইটার জেট ও ড্রোনের জন্য অত্যাধুনিক যন্ত্রাংশ তৈরি করছে থ্রি–ডি প্রিন্টার।
২৩ সেপ্টেম্বর রোসাটমের অ্যাডিটিভ টেকনোলজি বা সংযোজন প্রযুক্তির কারখানায় পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা হয়েছে। কারখানা ঘুরে থ্রি–ডি প্রিন্টারে বিভিন্ন ভারী যন্ত্র তৈরি করতে দেখা যায়। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্যও যন্ত্রপাতি তৈরি করা হয় এখানে। যে যন্ত্র তৈরি করতে সাধারণ উপায়ে কয়েক মাস লেগে যায়, সেই একই পণ্য মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে তৈরি করতে পারে থ্রি–ডি প্রিন্টার।
কারখানার কর্মকর্তারা বলেন, থ্রি–ডি প্রিন্টিং প্রযুক্তি ভবিষ্যতের এক বিশাল সম্ভাবনা। পারমাণবিক প্রযুক্তি নিজেই এই প্রিন্টিং ছাড়া কল্পনা করা যায় না। এখন শুধু ধাতব প্রিন্ট নয়, জীব বৈজ্ঞানিক ফরম্যাটেও প্রিন্টিং সম্ভব হয়েছে। জীবন্ত রক্তনালি প্রিন্ট করে খরগোশের শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে এবং ছয় মাস পরও প্রাণীটি পুরোপুরি সুস্থ আছে। ভবিষ্যতে শুধু রক্তনালি নয়, সম্পূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গও জৈব প্রিন্টিংয়ের মাধ্যমে তৈরি করা সম্ভব হবে। রাশিয়ার পাশাপাশি বেলারুশে একটি অ্যাডিটিভ টেকনোলজি সেন্টার নির্মাণ শেষ করছে তারা। ভারতের সঙ্গে আলোচনা চলছে। বাংলাদেশের বাজারেও নজর আছে তাদের।
রোগ শনাক্তে পারমাণবিক প্রযুক্তি
রোসাটম বলছে, শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদনেই নয়; বরং চিকিৎসা খাতেও বিশ্বের অন্যতম প্রধান অংশীদার রোসাটম। বিশ্বের বৃহত্তম আইসোটোপ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে তারা অন্যতম। সবচেয়ে জটিল রোগনির্ণয় ও চিকিৎসায় আইসোটোপ ব্যবহার করা হয়। আগে এই প্রযুক্তি মূলত ক্যানসার চিকিৎসায় সীমিত ছিল। এখন চিকিৎসকেরা এটি হৃদ্রোগ, স্নায়ুরোগসহ নানা জটিল রোগের ক্ষেত্রে ব্যবহার করছেন। এটি অনেক ক্ষেত্রেই জীবন রক্ষাকারীর ভূমিকা রাখছে।
স্বাস্থ্য খাতে পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার বাড়ানো হচ্ছে। এতে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে রোগ শনাক্তে আরও নিখুঁত ফলাফল পেতে সাহায্য করছে পারমাণবিক প্রযুক্তি। রাশিয়ার ওবনিন্স্ক শহরে ইউরোপের সবচেয়ে বড় রেডিও ফার্মাসিউটিক্যাল উৎপাদন কারখানা নির্মাণ করছে রোসাটম। ক্যানসার ও অন্যান্য জটিল রোগের চিকিৎসায় এটি যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে বলে আশা করছে তারা।