রাতের আকাশে মিটমিটে আলোর বিন্দুগুলো আসলে কী? কেনই-বা রাতে চাঁদের আলো, আর দিনে সূর্যের আলোয় ভরে যায় পৃথিবী? কী আছে আকাশের ওপারে? এসব কৌতুহল মানুষের মাঝে আজন্মকাল ধরে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জ্ঞানের বিকাশ ঘটেছে। সভ্যতা যত উন্নত হয়েছে, এই কৌতুহল হয়েছে তত শক্তিশালী। একটা সময় মানুষ সাহস করেছে আকাশ ছোঁয়ার। আকাশ পাড়ি দেওয়ার।
মহাকর্ষ বলের কারণে চাইলে আমরা ভূপৃষ্ঠ থেকে ওপরে উঠতে পারি না। এজন্য প্রয়োজন শক্তি। পৃথিবীর আকর্ষণ কাটিয়ে মহাশূন্যে পৌঁছানোর কাজটি আরও কঠিন। শুধু শক্তি হলেই হয় না, প্রয়োজন গণিত ও বিজ্ঞান। এই জ্ঞান কাজে লাগিয়ে গত শতক থেকেই মানুষ মহাশূন্যে নিজের উপস্থিতি জানান দিয়েছে।
মহাকাশ অভিযান মানেই ভীষণ ব্যয়বহুল। কোটি কোটি টাকা খরচা। একটি রকেট পৃথিবীর কক্ষপথে পাঠাতে গেলেই, হয়েছে! আসলে রকেটের খরচ বেশি নয়। মূল খরচটা হয় কীভাবে রকেট বানাতে হবে, কীভাবে মহাশূন্য পৌঁছানো যাবে, সেসব নিয়ে গবেষণায়। প্রশ্ন আসতে পারে, এই যে মহাশূন্য নিয়ে এত এত খরচ করা হচ্ছে, এগুলো কি মাটিতে খেটে খাওয়া মানুষের দৈনন্দিন জীবনে কোনো কাজে লাগে?
হ্যাঁ, কাজে লাগে। কীভাবে কাজে লাগে, তা জানতেই আজকের এ লেখা। আমাদের প্রতিদিনের জীবনে কাজে লাগে, এমন ১০টি প্রযুক্তির কথা জানব আজ। এর সবকটি এসেছে মহাকাশ অভিযানের কল্যাণে। এসব অভিযানের মাধ্যমে আমাদের হাতে ভৌত সম্পদ হয়তো আসে না, তবে জ্ঞান ঠিকই অর্জিত হয়। নানা সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে কখনো প্রকৃতির নানা রহস্য ভেদ করেন বিজ্ঞানীরা, কখনো খুঁজে ফেরেন জীবনকে আরেকটু সহজ করার উপায়। সেসব উপায় ও প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে অনেক সহজ ও আনন্দময় করেছে। চলুন, জেনে আসা যাক সেই ১০ প্রযুক্তির কথা।
ক্যামেরা ফোন
১৯৯০ সালে জেট প্রোপালশন ল্যাবরেটরির (জেপিএল) একদল গবেষক প্রথমবারের মতো ছোট আকারের ক্যামেরা তৈরি করেন। উদ্দেশ্য, নভোযানে ঠিকভাবে বসিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণার উপযোগী ছবি তোলা। বর্তমানে আমরা যে স্মার্টফোনে জোড়ায় জোড়ায় ক্যামেরা পাই, সেটা এ ক্যামেরার উত্তরসূরী। বাজারে থাকা এখনকার তিনভাগের একভাগ ক্যামেরায় জেপিএল-এর উদ্ভাবিত প্রযুক্তিটি ব্যবহার করা হয়।
সিটি স্ক্যান প্রযুক্তি
মহাকাশের নানা অভিযানে খুব উচ্চমানের ডিজিটাল ছবি প্রয়োজন। এখানেও জেপিএল দারুণ কাজ করেছে। ল্যাবরেটরিটির গবেষকেরা নতুন এক প্রযুক্তি তৈরিতে নেতৃত্ব দেন। পরে সেই প্রযুক্তি ব্যবহার করেই তৈরি করা হয় সিটি স্ক্যানার ও রেডিওগ্রাফি। দুটোরই মূল কাজ, দেহের অভ্যন্তরীণ কোনো অঙ্গে সমস্যা রয়েছে কি না, উচ্চমানের ডিজিটাল ছবি তুলে তা দেখা।
এলইডি
লাল এলইডি মহাশূন্যে গাছের বেড়ে ওঠার জন্য ব্যবহার করা হতো। পৃথিবীতে ব্যবহার করা হতো অসুস্থ মানুষকে সারিয়ে তোলার কাজে। নাসার ব্যবহৃত এই এলইডি প্রযুক্তি পরে ওয়ারপ ১০ (WARP10)-এর মতো মেডিকেল যন্ত্রাংশ উন্নত করতে ব্যবহার করা হয়। তা ছাড়া এলইডি প্রযুক্তি এখন সাধারণ বাতি বানাতেও ব্যবহৃত হয়। আমরা ব্যবহারও করি প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে।
অ্যাথলেটিক শু/খেলোয়াড়দের জুতো
নাসার প্রযুক্তি না থাকলে হয়তো নাইকি এয়ার ট্রেইনার জুতোটি কখনো তৈরিই হতো না। স্পেসস্যুট তৈরির প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় এ জুতোয়। নাসার সাবেক এক প্রকৌশলী প্রথম এ ধরনের আইডিয়া নিয়ে আসেন।
ফয়েল ব্ল্যাংকেট
এখনকার দিনে পৃথিবীতে চরম তাপমাত্রা মোকাবেলায় ফয়েল ব্ল্যাংকেট ব্যবহৃত হয়। ফয়েল ব্ল্যাংকেট মূলত একটি ধাতব পাত। হালকা অপরিবাহী পদার্থ থেকে এটি উদ্ভাবন করে নাসা। উদ্দেশ্য ছিল নভোযান ও নভোচারীকে মহাশূন্যের হিমশীতল পরিবেশ থেকে বাঁচানো।
পানি বিশুদ্ধকরণ সিস্টেম
১৯৬০ সালে নাসা নভোচারীদের খাবার পানি বিশুদ্ধ করার জন্য তৈরি করে ইলেকট্রোলাইটিক সিলভার আয়োডাইজার। প্রযুক্তিটি এখন সুইমিংপুলে ব্যাকটেরিয়া নাশে ব্যাপক ভাবে ব্যবহৃত হয়।
ডাস্ট বাস্টার/ধুলা পরিষ্কারক
চাঁদের পৃষ্ঠ থেকে নমুনা সংগ্রহের উদ্দেশ্যে একটি হালকা যন্ত্রের প্রয়োজন ছিল নাসার। ব্ল্যাক অ্যান্ড ডেকারকে এ ধরনের একটি যন্ত্র তৈরির দায়িত্ব দেয় তারা। ১৯৭৯ সালে নিজেদের উদ্ভাবিত প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে ডাস্ট বাস্টার তৈরি করে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে এ যন্ত্র ধুলা পরিষ্কারের কাজে পুরো পৃথিবীজুড়ে ব্যবহৃত হয়।
ওয়্যারলেস হেডফোন
যোগাযোগ প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নয়নের পেছনে যেসব প্রতিষ্ঠান ছিল, তাদের মাঝে নাসা অন্যতম। নভোচারীদের হাত-পা যেন তারে জড়িয়ে না যায়, এজন্য তারা উদ্ভাবন করে তারবিহীন হেডফোন। আর আজ আমরা তারবিহীন হেডফোন ব্যবহার করে গান শুনি প্রতিনিয়ত।
কম্পিউটার মাউস
কম্পিউটারকে কীভাবে আরও ইন্টারঅ্যাক্টিভ করা যায়, তা নিয়ে কাজ করছিলেন নাসার এক গবেষক। এটা সেই ১৯৬০-এর দশকের কথা। তাঁর সেই গবেষণার তথ্য-উপাত্ত কাজে লাগিয়েই পরবর্তীতে উদ্ভাবিত হয় মাউস।
শুকনো হিমায়িত খাবার
মহাকাশচারীদের খাবার শুরু থেকেই বিজ্ঞানীদের দুশ্চিন্তার একটি বড় কারণ ছিল। কারণ, মহাকাশের পরিবেশ পৃথিবীর মতো নয়। এ পরিবেশে খাবার সংরক্ষণ করা খুবই কঠিন। তা ছাড়া পৃথিবীতে আমরা যেসব খাবার খাই, সেসব ওখানে পাঠানোও ব্যয়বহুল। এ সমস্যা নিয়ে ব্যাপক গবেষণা চালিয়েছে নাসা। এর ফল হিসেবে তারা হিমায়িত করার মাধ্যমে যেকোনো খাবারকে শুকনো খাবারে পরিণত করার প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে। এ প্রযুক্তিতে খাবারের পুষ্টিগুণ ৯৮ শতাংশ বজায় থাকত। কিন্তু ওজন কমে হতো মাত্র ২০ শতাংশ।
লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা
সূত্র: নাসা, জেপিএল, স্যাটালাইটব্রডব্যান্ডইউকে