অন্তর্জালের ৫০ বছর

ইন্টারনেট বা অন্তর্জাল এখন আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে গেছে। সোশ্যাল মিডিয়া তো আছেই, অন্তর্জালের মাধ্যমে ব্যক্তিগত টেক্সট করা থেকে শুরু করে পড়াশোনা বা গবেষণার জন্য সার্চ করাও আমাদের নিয়মিত কাজের অন্তর্ভুক্ত। এক ইউটিউবেই প্রতিদিন চার মিলিয়ন বা ৪০ লাখ ঘণ্টার ভিডিও আপলোড করা হয়। প্রায় সাড়ে চার বিলিয়ন (চার শ কোটি) মানুষ প্রতিদিন অন্তর্জাল ব্যবহার করে। ফলে প্রতিদিন আড়াই মিলিয়ন টেরাবাইট নতুন তথ্য তৈরি হয় অন্তর্জালে। সহজ কথায়, অন্তর্জাল এখন আমাদের মৌলিক চাহিদাগুলোর একটি হয়ে উঠেছে।

এই সবকিছুর শুরু হয়েছিল অর্ধশতাব্দী আগে, ১৯৬৯ সালে। তবে এ রকম কিছু একটা আবিষ্কার তো আর এক দিনে হয়ে যায় না। তাই পুরো ব্যাপারটা জানার জন্য আমাদের আরেকটু পেছনে ফিরে যেতে হবে।

১৯৬২ সালের আগস্ট মাস। এমআইটির জে সি আর লিকলাইডার প্রথমবারের মতো ‘গ্যালাক্টিক নেটওয়ার্ক’ নামে একটি ধারণা নিয়ে কথা বলেন। তিনি চিন্তা করলেন, পৃথিবীর সব কম্পিউটারকে যদি একটি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে যুক্ত করে রাখা যায়, তাহলে মানবসভ্যতা অনেক দূর এগিয়ে যাবে। পৃথিবীর এক প্রান্তের মানুষ অন্য প্রান্তের কারও কম্পিউটারে রাখা বিভিন্ন তথ্য বা প্রোগ্রাম মুহূর্তের মধ্যে সংগ্রহ করে নিতে পারবে। তিন মাস পর অক্টোবরে তিনি ডারপায় (DARPA) যোগ দেন। দ্য ডিফেন্স অ্যাডভান্সড রিসার্চ প্রজেক্ট বা ডারপা মূলত মার্কিন সেনাবাহিনীর গবেষণা শাখা। নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও উন্নয়নে কাজ করে তারা। আসল উদ্দেশ্যটা হলো, আরও উন্নত প্রযুক্তি যদি থাকে, তা যেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতেই আগে আসে! তবে মূল উদ্দেশ্য যা-ই হোক, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নে মার্কিন সেনাবাহিনীর এসব গবেষণা এবং ফান্ডিংয়ের অবদান অনস্বীকার্য।

নতুন ধরনের নেটওয়ার্কিংয়ের এই ধারণা নিয়ে ডারপায় নিজের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বোঝালেন তিনি। এদিকে এমআইটির লরেন্স জি রবার্টসের সঙ্গেও কথা বললেন। শুরু হলো গবেষণা।

ওদিকে এমআইটিতে আরও আগে থেকেই প্যাকেট সুইচিং তত্ত্ব নিয়ে কাজ চলছিল। ১৯৬১ সালে লেওনার্ড ক্লেইনরক এ–সম্পর্কিত প্রথম বৈজ্ঞানিক পেপার প্রকাশ করেন। প্যাকেট সুইচিং তথ্য আদান-প্রদানের যুগান্তকারী এক প্রক্রিয়া। এখানে সম্পূর্ণ তথ্যটিকে বাইনারি প্যাকেট আকারে ভেঙে ফেলা হবে। তারপর প্রতিটি প্যাকেটকে পাঠিয়ে দেওয়া হবে আলাদাভাবে। পৃথিবীর দুই মাথার দুটো কম্পিউটারের মধ্যে শত-সহস্র নেটওয়ার্ক পথ আছে। একেক প্যাকেট একেক পথ ধরে গন্তব্যে পৌঁছাবে। ফলে খুব অল্প সময়ে সব কটি প্যাকেট গন্তব্যে পৌঁছে যাবে। তারপর প্যাকেটগুলো একটার পর একটা বসে একসঙ্গে জুড়ে গিয়ে তৈরি করবে মূল তথ্যটি। আমরা যখন কোনো ইমেজ সার্চ করি, তখন সেটা এভাবেই আমাদের হাতের যন্ত্র বা ডিভাইসে এসে পৌঁছায়। ইউটিউব বা নেটফ্লিক্সের মতো ভিডিও স্ট্রিমিং সাইটগুলো এই তত্ত্বকে আরও অনেকটা উন্নত করেছে। ফলে পুরো তথ্য বা ভিডিওটা এসে পৌঁছানো লাগে না। যতটুকু এসে পৌঁছালে ভিডিওটা প্লে হয়ে চলতে পারবে, সেটুকু এসে পৌঁছালেই ভিডিওটা চলতে শুরু করে। পুরো ভিডিও একবারে এসে তারপর প্লে হলে আমাদের আর ভিডিও দেখতেই হতো না!

যা–ই হোক, পেপার প্রকাশ করেই ক্লেইনরক থেমে যাননি। তিন বছর পর ১৯৬৪ সালে প্যাকেট সুইচিং তত্ত্বের ওপর একটি বইও লিখে ফেললেন। তাঁর এই কাজের আগে তথ্য আদান-প্রদান হতো মূলত সার্কিট ব্যবহার করে। তাঁর এই তত্ত্ব বাস্তবে আসলেই কাজ করে কি না, সেটা পরীক্ষা করার জন্য রবার্টস এবং থমাস মেরিল ম্যাসাচুসেটস এবং ক্যালিফোর্নিয়ার দুটো কম্পিউটারের মধ্যে প্রথম ওয়াইড-এরিয়া-কম্পিউটার নেটওয়ার্ক (WAN) তৈরি করলেন। ওয়াইড নাম হলেও বর্তমানের তুলনায় ওই দূরত্ব ছিল নিতান্ত কম।

এখন প্যাকেট সুইচিং তত্ত্ব তো হলো, কিন্তু এটা ব্যবহারের জন্য একটা নেটওয়ার্ক তো লাগবে। ১৯৬৬-৬৭ সালে এ নিয়েই কাজ করছিলেন রবার্টস। তাঁর এই নেটওয়ার্কের পরিকল্পনা তিনি জানালেন ডারপাকে। এর ফলে নেটওয়ার্কটার নাম দেওয়া হলো অ্যাডভান্সড রিসার্চ প্রজেক্টস এজেন্সি নেটওয়ার্ক বা আরপানেট (ARPANET)।

অনেক ধাপ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং অনেক মানুষের পরিশ্রমের ফসল হিসেবে ১৯৬৯ সালে প্রথম এই নেটওয়ার্ক পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্যাকেট সুইচিং তত্ত্ব নিয়ে ক্লেইনরকের প্রাথমিক কাজের স্বীকৃতি হিসেবে প্রথম নোডটি বসানো হয় ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। দ্বিতীয় নোডটি স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগার বা রিসার্চ ইনস্টিটিউটে। নোড বলতে এখানে যন্ত্র বা পয়েন্টকে বোঝানো হচ্ছে। সহজ কথায়, প্রেরক ও প্রাপক। এখন নেটওয়ার্ক পরীক্ষার জন্য তথ্য পাঠাতে হবে। কী হবে সেই তথ্য? ঠিক করা হলো, LOGIN শব্দটা লিখে পাঠানো হবে।

প্রিয় পাঠক, এক মুহূর্ত থেমে একটু কল্পনা করার চেষ্টা করুন। টান টান উত্তেজনা নিয়ে একদল বিজ্ঞানী ৩৫০ মাইল দূরে দাঁড়িয়ে অন্তর্জালে প্রথমবারের মতো তথ্য পাঠানোর চেষ্টা করছেন।

প্রথমেই L টাইপ করা হলো। টেলিফোনে খোঁজ নিয়ে জানা গেলে, পৌঁছেছে!

টাইপ করা হলো O। আবারও জানা গেল, পৌঁছেছে।

এপাশে টাইপ করা হলো G। কিন্তু ওপাশ থেকে জানা গেল, সিস্টেম ক্র্যাশড!

এত দিনের চেষ্টায় বিজ্ঞানীরা অন্তর্জালে প্রথম যে বার্তা পাঠিয়েছিলেন, সেটি হলো LO!

এভাবেই একটি অপূর্ণাঙ্গ বার্তা পাঠানোর মধ্য দিয়ে যাত্রা করল অন্তর্জাল। বিজ্ঞানীরা বুঝলেন, আরও উন্নতি করতে হবে। ফলে আজ পুরো পৃথিবীটা অন্তর্জালে ঢেকে গেছে।

শেষ করার আগে একটা মজার এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়ে শেষ করি। অনেকের ধারণা, ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব (www) এবং অন্তর্জাল একই জিনিস। আসলে তা নয়। অন্তর্জালে অনেক ধরনের প্রটোকল, নেটওয়ার্ক এবং সার্ভিস ব্যবহার করা হয়। এ রকম একটি জনপ্রিয় নেটওয়ার্ক সার্ভিস ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব। কিন্তু এটি পুরোটা অন্তর্জাল নয়, বরং অন্তর্জালের একটি অংশ।

সার্নে, প্রতিপদার্থ নিয়ে গবেষণাকালে বিজ্ঞানীরা দেখলেন, বিভিন্ন কম্পিউটারে রাখা তথ্য সরাসরি অ্যাক্সেস করাটা খুব দরকার। তত দিনে অন্তর্জালের ২০ বছর পেরিয়ে গেছে। এর মাধ্যমে তথ্য আদান-প্রদান করা যায় ঠিকই, কিন্তু সরাসরি অ্যাক্সেসটুকু তখনো করা যেত না। আরেকটা ঝামেলা হলো, একেকজনের কম্পিউটারে একেক রকম প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ। একজনের ফাইল আরেকজনের কম্পিউটারে ঠিকভাবে কাজও করে না। স্যার টিম বার্নার্স-লি ১৯৮৯ সালে এই সমস্যা সমাধানের জন্য আবিষ্কার করেন ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব। বছরখানেকের মধ্যে তিনি এমন তিনটি মৌলিক প্রযুক্তি লিখে ফেললেন, যেটা আজকের ওয়েবের মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে। প্রযুক্তি তিনটির একটি এইচটিএমএল (HTML), দ্বিতীয়টি ইউআরএল (URL), আর তৃতীয়টি এইচটিটিপি প্রটোকল (HTTP)। ব্রাউজারে কোনো কিছু করতে গেলে আমরা যে ওয়েব অ্যাড্রেস দিই, যেমন www.bigganchinta.com, এটি একটি ইউআরএল। এর সামনে লেখা থাকে, https://, এটিই সেই এইচটিটিপি প্রটোকল। আর সাইটে ঢোকার পর সবকিছু আমরা যেভাবে দেখি, সেটি মূলত এইচটিএমএল, সিএসএস এবং জাভাস্ক্রিপ্টের মাধ্যমে তৈরি।

বার্নার্স-লির ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব এত জনপ্রিয় এবং আবশ্যক হয়ে উঠেছে যে অন্তর্জাল আর ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব আমাদের কাছে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। আবশ্যক অংশ হয়ে গেছে আমাদের জীবনে।

লেখক: কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ঢাকা

সূত্র: বিবিসি, উইকিপিডিয়া

লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় বিজ্ঞানচিন্তার নভেম্বর ২০১৯ সংখ্যায়