অ্যামেচার রেডিও: শখের চর্চায় জীবনরক্ষা

আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন থেকে বেলজিয়ামের এক স্কুলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে হ্যাম রেডিওতে কথা বলছেন সুনিতা উইলিয়াম

বিজ্ঞানচর্চার জগতে অ্যামেচার রেডিও আসলে একধরনের শখ। বিশেষ ধরনের রেডিওর মাধ্যমে দূর দেশের আরেক রেডিও গ্রাহকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন অ্যামেচার রেডিও অপারেটররা। তাঁদের হ্যাম বলা হয়

হোটেল ইকো লিমা পাপা (Hotel Echo Lima Papa)। শব্দগুলো একসঙ্গে কোনো অর্থই প্রকাশ করে না। কিন্তু প্রতিটা শব্দের আদ্যাক্ষরগুলো নিয়ে পাশাপাশি সাজালে একটা অর্থবোধক শব্দ হয় ঐঊখচ (হেল্প)। উল্লিখিত শব্দগুলো আসলে কোড ওয়ার্ড, যা অ্যামেচার রেডিও অপারেটররা পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগে ব্যবহার করেন। এই রেডিও সবচেয়ে বেশি পরিচিত হ্যাম (HAM) রেডিও নামে। প্রচলিত বেতার যোগাযোগ অচল হয়ে পড়লেও দেশ-বিদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা বিপর্যয়ে এগিয়ে এসে প্রাণ রক্ষায় উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন অ্যামেচার রেডিও অপারেটররা।

বিজ্ঞানচর্চার জগতে অ্যামেচার রেডিও আসলে একধরনের শখ। বিশেষ ধরনের রেডিওর মাধ্যমে দূর দেশের আরেক রেডিও গ্রাহকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন অ্যামেচার রেডিও অপারেটররা। তাঁদের হ্যাম বলা হয়। বর্তমানে সারা পৃথিবীতে হ্যামের সংখ্যা ২৫ লাখের ওপর। এই তালিকায় রয়েছেন পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মার্কিন বিজ্ঞানী জোসেফ টেইলর। ৭৫ বছর বয়সী এই বিজ্ঞানী কৈশোরেই হ্যাম হন। হ্যামের তালিকায় রয়েছেন কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীর মতো রাজনীতিকও। তালিকায় আরও আছেন জর্ডানের রানি নূর, প্রয়াত রাজা হুসেনের ভাই প্রিন্স হাসান, চাচাতো ভাই প্রিন্স রাআদ, সৌদি রাজপরিবারের সদস্য প্রিন্স তালাল। ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী ও জর্ডানের প্রয়াত রাজা হুসেনও হ্যাম ছিলেন।

১৯১১ সালের দিকে বব আলমি ও পেগি মুরি নামের দুই ব্যক্তিকে সঙ্গে নিয়ে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আলবার্ট হাইম্যান একটি অ্যামেচার রেডিও স্টেশন গড়ে তোলেন। তাঁদের নামের আদ্যাক্ষরগুলো (হাইম্যানুআলমিমুরি) নিয়ে হ্যাম শব্দটির প্রচলন ঘটে। অবশ্য হ্যাম নামকরণে আরেকটি কথাও প্রচলিত। বেতার গবেষণায় তিন কিংবদন্তি বিজ্ঞানী হেনরিক রুডলফ হার্জ, এডউইন আর্মস্ট্রং ও গুলিয়েলমো মার্কনির নামের শেষ শব্দগুলোর আদ্যাক্ষরগুলো নিয়ে হ্যাম শব্দের প্রচলন হয়েছে।

স্বল্পক্ষমতার রেডিও ট্রান্সরিসিভারের (গ্রাহক ও প্রেরক যন্ত্র) মাধ্যমে গড়ে ওঠে একটি ব্যক্তিগত রেডিও স্টেশন। একজন হ্যাম বেতারযন্ত্রের সাহায্যে সরাসরি কথাবার্তা, মোর্সকোড কিংবা কম্পিউটারের মাধ্যমে অপর হ্যামের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। হ্যামরা একে অপরকে কিউএসএল কার্ড পাঠান কোনো সময়, কোন ফ্রিকোয়েন্সিতে পরস্পরের যোগাযোগ হয়েছিল তার উল্লেখ করে। আগে ডাকযোগে এসব কার্ড পাঠানো হতো। এখন ই-মেইলের মাধ্যমে কাজটা সেরে নেন হ্যামরা।

এই রেডিওর মাধ্যমেই আজকের বেতার যোগাযোগের মূল গবেষণার শুরু হয়েছিল। ১৯০১ সালে ইতালির বিজ্ঞানী মার্কনি স্পার্ক গ্যাপ ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে প্রমাণ করেন, বেতার সংকেতের মাধ্যমে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সংবাদ আদান-প্রদান সম্ভব। তখন অনেকে উত্সাহী হয়ে এ ধরনের বেতারযন্ত্র তৈরি করে গবেষণা ও পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ শুরু করেন। এভাবেই অ্যামেচার রেডিওর যাত্রা। সে সময় এসব স্টেশন লোয়ার ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করত। ধীরে ধীরে বেতার যোগাযোগের গুরুত্ব বুঝতে পেরে গড়ে ওঠে বিভিন্ন ব্রডকাস্টিং স্টেশন। পরে হাই ফ্রিকোয়েন্স নিয়ে কাজ শুরু হয়। বর্তমানে দুটি দেশের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদান হয় কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে। পৃথিবীর কক্ষপথে কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠানোর আগেও হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে সংকেত পাঠানো হতো। বায়ুমণ্ডলের আয়নমণ্ডলে সংকেত প্রতিফলনের মাধ্যমে তা করা হতো। এ পদ্ধতি প্রথম ব্যবহার করেন হ্যামরাই। ১৯১৪ সালের প্রথম দিকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথমবারের মতো গড়ে ওঠে হ্যামদের সংগঠন আমেরিকান রেডিও রিলে লিগ (এআরআরএল)।

মহাকাশকেন্দ্র কিংবা কৃত্রিম উপগ্রহে নভোচারীরাও হ্যাম ব্যবহার করেন। এ কারণে পৃথিবীতে থাকা হ্যামরা কখনো কখনো মহাশূন্যে ভাসমান নভোচারীদের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে পারেন। বর্তমানে আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়ন (আইটিইউ) ও আন্তর্জাতিক অ্যামেচার রেডিও ইউনিয়নের (আইএআরইউ) স্বীকৃত ১৬০ মিলিমিটার ব্যান্ড থেকে ২৩ সেন্টিমিটার ব্যান্ড (১ হাজার ৮০০ কিলোহার্জ থেকে ২৩ গিগাহার্জ পর্যন্ত) রেডিও ফ্রিকোয়েন্সির মধ্যে কিছু শুধু অ্যামেচার রেডিওর জন্য নির্ধারিত।

হ্যামরা কিছু বিষয় মেনে চলেন। সরকারও বিষয়গুলো মাথায় রেখেই একজন হ্যামকে নিবন্ধন দেয়। সেগুলো হলো অ্যামেচার রেডিওর মাধ্যমে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনো অর্থ বা অন্য কোনো সুবিধা নেওয়া যাবে না, গান বা সংবাদ প্রচার করা যাবে না, কোনো রাজনৈতিক বা ধর্মীয় আলাপ আলোচনা করা যাবে না, অপরাধমূলক কার্যক্রমে সহায়তা করা যাবে না, অ্যামেচার রেডিওতে কোড বা সাইফার ব্যবহার করে গোপন যোগাযোগ করা যাবে না, কোনো প্রকার অশ্লীল বা বিদ্বেষমূলক কথা বলা যাবে না।

প্রয়োজনীয় উপকরণ

আইটিইউর অনুমোদন অনুযায়ী, হ্যাম রেডিওতে স্বল্প দূরত্বে (১০ থেকে ৫০ কিলোমিটার) ভেরি হাইফ্রিকোয়েন্সি (ভিএইচএফ) বা আলট্রা হাইফ্রিকোয়েন্সি (ইউএইচএফ) ওয়াকিটকি ব্যবহার করা হয়। আর আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে হাইফ্রিকোয়েন্সি (এইচএফ) রেডিও ব্যবহার করা হয়। হ্যাম রেডিও স্থাপনে প্রয়োজনীয় উপকরণ হলো, একটি রেডিও ট্রান্সরিসিভার (বেতার গ্রাহক ও প্রেরক যন্ত্র), বিদ্যুত্ সরবরাহ ব্যবস্থা (এসি বা ডিসি), অ্যান্টেনা আর লগবুক। লগবুকে যোগাযোগের বিবরণ ও সময় লিখে রাখতে হয়। ইন্টারনেটের মাধ্যমে ইকোলিংক ব্যবহার করে ভিএইচএফ রেডিও দিয়ে সহজেই দেশের বাইরে যোগাযোগ করতে পারেন হ্যামরা।

কল সাইন

কল সাইন হলো হ্যামদের পরিচিতি সংকেত। রেডিও যোগাযোগের ক্ষেত্রে হ্যামরা এই সংকেত বা কল সাইন ব্যবহার করেন। কল সাইন জাতীয়তারও পরিচয় বহন করে। বাংলাদেশের হ্যামদের কল সাইন শুরু হয় ঝ২অ থেকে ঝ৩ত দিয়ে। দুজন হ্যামের কল সাইন কখনো এক হয় না। আর যোগাযোগে আন্তর্জাতিক ফোনেটিক কোড ব্যবহার করা হয়।

বাংলাদেশে অ্যামেচার রেডিওর যাত্রা

বাংলাদেশে ১৯৭৯ সালে গঠিত হয় হ্যামদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যামেচার রেডিও লিগ (বিএআরএল)। ১৯৮২ সালে আন্তর্জাতিক অ্যামেচার রেডিও ইউনিয়নের সদস্য হয় এ সংগঠন। ১৯৯২ সাল থেকে পরীক্ষার মাধ্যমে হ্যাম লাইসেন্স দিতে শুরু করে বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি।

বাংলাদেশ অ্যামেচার রেডিও লিগের সদস্য সৈয়দ সামশুল আলম বলেন, বাংলাদেশে হ্যাম রেডিও এখনো তেমন প্রসার পায়নি। পাশের দেশ ভারতে ২০ হাজারের ওপর হ্যাম আছেন। সেখানে বাংলাদেশে মাত্র দেড় শ। তিনি আরও জানান, হ্যামরা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিজেদের মতো করে যোগাযোগ করতে পারেন। তাই জাতীয় নিরাপত্তার কথাও মাথায় রাখতে হয়। সে জন্য বাংলাদেশে নিবন্ধন দেওয়ার ক্ষেত্রে একটা ন্যূনতম বয়সসীমা নির্ধারিত আছে। যেকোনো সময় চাইলেও হ্যাম নিবন্ধন করা যায় না। বিটিআরসির পক্ষ থেকে সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পরই নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা যায়। লিখিত পরীক্ষা ও বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে উত্তীর্ণরা নিবন্ধন পান।

আর্তমানবতার পাশে অ্যামেচার রেডিও

গত বছর নেপালে ব্যাপক ভূমিকম্পের পর যখন সেখানে টেলিযোগাযোগব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, তখন এগিয়ে এসেছিলেন হ্যামরাই। বাংলাদেশে ১৯৯১ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের সময় রেড ক্রিসেন্টের উদ্ধারকারী ব্যক্তিদের সঙ্গে কাজ করেছিল একদল হ্যাম। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ২০০১ সালে টুইন টাওয়ার হামলার পর, ক্যালিফোর্নিয়ার সান্তা ক্রুজে ১৯৮৯ সালে ভূমিকম্পের পর, অকল্যান্ডের বার্কলেতে ১৯৯১ সালের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সময়, ফ্লোরিডায় হোমস্টিডে ১৯৯২ সালে হারিকেন অ্যান্ড্রুর পরসহ নানা দুর্যোগে আর্তমানবতার সেবায় এগিয়ে এসে হ্যামরা উদাহরণ হয়ে আছেন।