আফগান ড্রিমার্সদের জন্য ভালবাসা

অবশেষে আফগান ড্রিমাররা নিজের দেশ ছেড়ে অভিবাসী হল। ২০০১ সালের পর জন্ম নেয়া এই কিশোরীরা এরই মধ্যে সারা বিশ্বের নজর কেড়েছিল নিজেদের অবিশ্বাস্য প্রতিভা, দক্ষতা আর মেধা দিয়ে। যে দেশে মাত্র ১০ শতাংশ জনগণের ইন্টারনেট সুবিধা আছে, যে দেশে মাত্র ১৫% প্রাপ্তবয়স্ক নারী লেখাপড়া জানেন, মেয়েরা ছেলেদের তুলনায় শিক্ষার সুযোগে তিন গুণ পিছিয়ে আছে যেখানে, বাল্যবিবাহের হার যেখানে আশংকাজনক, সেই দেশের এই স্বপ্নবাজ বালিকারা তাদের রোবটিক টিম নিয়ে একের পর এক তাক লাগানো সাফল্য এনে দিচ্ছিল দেশকে। সাম্প্রতিক তালেবান উত্থান তাদের এই স্বপ্নকে ভেঙে চুরমার করে দিল। এই দেশ নিয়ে তারা একদিন বড় স্বপ্ন দেখত। এই দেশের মেয়েদের জন্য তারা গড়ে তুলছিল স্টেম স্কুল আর ড্রিমার্স ইনস্টিটিউট, আফগানিস্তানের মেয়ে হয়ে একদিন মঙ্গলগ্রহে যাবে বলে তারা ঘোষণা দিয়েছিল, সেই দেশ ছেড়ে রাতের অন্ধকারে পালাতে বাধ্য হয়েছে তারা। শুধু কি তারাই অনিশ্চিত জীবনে পা বাড়াল, নাকি হতভাগ্য আফগানিস্তানও হারাল তার শ্রেষ্ঠ মেধাবী নতুন প্রজন্মকে? সময়ই একদিন বলে দেবে হয়তো।

২০১৭ সালে প্রথম আফগান ড্রিমার্স যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক রোবটিকস প্রতিযোগিতার শিরোপা জিতে বিশ্বকে চমকে দেয়। পরের বছর কানাডায় অনুষ্ঠিত ফার্স্ট গ্লোবাল রোবটিক প্রতিযোগিতায় রুকি অল স্টার এওয়ার্ড জিতে নেয়। এরপর তাদের আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। তবে কেবল বিদেশের মাটিতেই নয়, নিজের দেশেও নানা রকম আশ্চর্য উদ্ভাবনে তারা সর্বদাই ছিল এগিয়ে। যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানে তারা ল্যান্ড মাইন ডিটেক্ট করার জন্য রোবট তৈরি করেছিল। কোভিড অতিমারিকালেও বসে ছিল না এই মেয়েরা। হেরাত রাজ্যে প্রথম কোভিড রোগী সনাক্ত হবার পরপরই তারা নিজেদের মধ্যে দ্রুত এক জরুরি মিটিং ডাকে আর কিছুদিনের মধ্যেই পুরনো টয়োটা গাড়ির পার্টস দিয়ে কম দামে বহনযোগ্য ভেন্টিলেটর তৈরি করে ফেলে। তাদের এই আবিষ্কারগুলো সাড়া ফেলে দেয় সারা বিশ্বে, এই উদ্ভাবক টিমের সোমাইয়া স্থান করে নেয় ২০২০ সালের বিবিসির ১০০ সাড়া জাগানো নারীর তালিকায়, ইউনিসেফ তাকে ভয়েস অফ ইয়ুথ উপাধি দেয়। ফোর্বস ম্যাগাজিন ৩০-এর নিচে এশীয় বিজ্ঞানী ও উদ্ভাবকদের তালিকার ৩০ জনের মধ্যে আফগান ড্রিমার্সদের স্থান দিয়েছিল। তালিবানদের দখলের আগ পর্যন্ত আফগান সরকারের সাথে ড্রিমার্স ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাচ্ছিল তারা।

আফগান ড্রিমার্স এর যাত্রা শুরু হেরাতের তরুণী রয়া মেহবুবের হাত ধরে। রয়া ১৬ বছর বয়সে প্রথম কম্পিউটার ও ইন্টারনেট ব্যবহার করতে শেখে। ২০২০ সালে মাত্র ২৩ বছর বয়সে সে আফগানিস্তানের প্রথম নারী টেক সিইও হতে সক্ষম হয়। ২০১২ সালে সে গড়ে তোলে ডিজিটাল সিটিজেন ফান্ড। এই অলাভজনক প্রতিষ্ঠানটির লক্ষ্য ছিল আফগানিস্তানের নারী ও শিশুদের মধ্যে ডিজিটাল লিটারেসির উন্নয়ন করা। ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সী স্কুলগামী কিশোরীদের জন্য স্কুলে স্কুলে আইটি সেন্টার চালু করেছে এই প্রতিষ্ঠান, স্কুলগুলিতে ফ্রি ইন্টারনেট সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নিরলস কাজ করেছে। এর বাইরে প্রায় ১২ হাজার নারী-শিশুকে অপ্রাতিষ্ঠানিক আইটি শিক্ষাদান করেছে। এছাড়া নারীদের স্টার্টআপ উদ্যোগেও সাহায্য করে এই ফান্ড। ফান্ডের সহায়তায় প্রায় ১০০ জন নারী ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে আত্নপ্রকাশ করেছেন। আফগানিস্তানের প্রথম স্টেম হাই স্কুলও গড়ে উঠছিল তার হাত দিয়েই।

২০১৩ সালে রয়া মেহবুব টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে বিশ্বের ১০০ জন ইনফ্লুয়েনশিয়াল পিপল এর তালিকায় স্থান করে নেয়। টাইম ম্যাগাজিনে শেরিল স্ট্যানবার্গকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে রয়া বলেছিল, 'আফগানিস্তানের জনসংখ্যার অর্ধেকই টিনএজার। আমরা যদি তাদের শিক্ষা ও প্রযুক্তির সুযোগ দিতে পারি তবে তারা সমাজটাকেই পালটে দেবে। আমরা আফগানিস্তানের প্রথম সায়েন্স, টেকনোলজি, ইনজিনিয়ারিং আর্ট অ্যান্ড ম্যাথ স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছি।'

কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই ওলটপালট হয়ে গেল সব কিছু। অনেকদিন থেকেই নানা রকম হুমকির শিকার হয়ে আসছিল আফগান ড্রিমার্সরা। তালেবানদের দখল প্রক্রিয়ায় ক্রমেই শংকিত হয়ে উঠছিল তারা। দেশের বাইরে বন্ধু ও শুভার্থীদের মেসেজ আর টেক্সট পাঠাচ্ছিল বার বার। ওকলাহামা নিবাসী অ্যালিসন রেনিউ এর সাথে তাদের পরিচয় হয়েছিল ২০১৯ সালে, ওয়াশিংটন ডিসিতে হিউম্যান টু মার্স সামিটে অংশ নেবার সময়। ৬০ বছর বয়সী এই হাভার্ড গ্র্যাজুয়েট, নয় সন্তানের মা, বিচলিত হয়ে ওঠেন ভীত-সন্ত্রস্ত বালিকাদের মেসেজ পড়ে। নিজ এলাকার সিনেটরদের সাথে যোগাযোগ করে বিফল হয়ে এই নারী নিজেই উড়াল দিলেন কাতারের উদ্দেশ্যে। সেখানে তাঁর হাভার্ড বান্ধবী কাতার দূতাবাসে বড় চাকুরি করেন। তাঁরই সাহায্যে গত ২১ আগস্ট আফগান ড্রিমার্সদের ৫ কিশোরীকে নিয়ে একটি বিমান কাতারের দোহায় অবতরণ করে। তারপর গত ২৫ আগস্ট আরেকটি বিমানে করে তারা মেক্সিকোতে পৌঁছে। মেক্সিকোর ডেপুটি ফরেন মিনিস্টার মার্থা দেলগাদো আল জাজিরাকে জানান, তিনি এই মেধাবী প্রতিভাবান বালিকাদের আনতে নিজে এয়ারপোর্টে গিয়েছিলেন। তিনি বলে, এরা এখন থেকে কেবল মেক্সিকো নয়, সারা বিশ্বের সম্পদ। তবে আফগান ড্রিমার্সদের আরও প্রায় ২০ কিশোরীকে এখনও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তাদের উদ্ধার করতে।

এরই মধ্যে বিশ্বের বড় বড় টেক বিশ্ববিদ্যালয়গুলি আফগান ড্রিমার্সদের স্কলারশিপ দেওয়ার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠেছে। কিন্তু এই ছোট ছোট মেয়েরা পেছনে ফেলে এসেছে তাদের পরিবার, বাবা মা, দেশ, স্বজন, যাদের জন্য তারা স্বপ্ন দেখেছিল একদিন। সেই স্বপ্ন কি সত্যি চুরমার হয়ে গেছে? ২১ আগস্ট কাতারের রাজধানী দোহায় বসে ডিজিটাল সিটিজেন ফান্ড এর বোর্ড মেম্বার এলিজাবেথ শেফার ব্রাউন এনবিসি নিউজ-কে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন, এই মেয়েরা সত্যি ড্রিমার্স। তাদের মুখে তালিবান বা যুদ্ধ নিয়ে কোন নেতিবাচক কথা শুনিনি, যা শুনেছি তার পুরোটাই এক আশ্চর্য আশা আর স্বপ্নের কাহিনী। যে স্বপ্ন দিয়ে তারা একদিন আবার নিজের দেশকে নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চায়!

লেখক: তানজিনা হোসেন, সহযোগী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনলজি এন্ড মেটাবলিজম, গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজ, ঢাকা