আলট্রাসনোগ্রাফির সাত-সতেরো

বুকে কান পাতলেই হৃৎপিন্ডের শব্দ শোনা যায়। মাঝে মাঝে পেটের শব্দ শোনা যায় কান না পেতেও। মানুষ এই শব্দের মাধ্যমে শরীরের ভালোমন্দ বিচার করে আসছে সেই আদি যুগ থেকে। কিন্তু শরীরের শব্দ শুনে ছবি তৈরির ব্যাপারটা বিংশ শতাব্দীর উদ্ভাবন। আধুনিক চিকিৎসায় বিশেষ করে মায়ের গর্ভে ভ্রূণের ঠিকমতো বেড়ে ওঠার ব্যাপারটা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করার জন্য শরীরের ভেতরের শব্দ শুনে চলমান ছবি তৈরি করা হয় যে ব্যবস্থায়, তার নাম আলট্রাসনোগ্রাফি।

শব্দের ধর্ম এবং গতিপ্রকৃতির পদার্থবিজ্ঞান সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা জেনেছেন বহু শতাব্দী আগে। শব্দ এক ধরনের যান্ত্রিক শক্তি। শব্দের উৎপত্তি হওয়ার জন্য দুটো পদার্থের মধ্যে ইন্টারঅ্যাকশান বা মিথস্ক্রিয়া ঘটতে হয়। আমরা কথা বলার সময় যে শব্দ তৈরি করি তা আমাদের স্বরযন্ত্রের সাথে বাতাসের মিথস্ক্রিয়ার ফল। শব্দ প্রবাহিত হয় তরঙ্গের মাধ্যমে। আলোর তরঙ্গের সাথে শব্দের তরঙ্গের পার্থক্য অনেক। আমরা দেখেছি আলোর তরঙ্গ বিদ্যুৎচুম্বকক তরঙ্গ। এক্স-রে, গামা-রে, বেতার তরঙ্গ– সবাই আলোর পরিবারের সদস্য এবং তারা সবাই বিদ্যুৎচুম্বকক তরঙ্গ। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে তাদের কোন মাধ্যমের দরকার হয় না। অর্থাৎ শূন্য মাধ্যমেও তারা চলাচল করতে পারে। তাইতো সূর্য থেকে মহাশূন্য ভেদ করে আলো এসে পৌঁছায় আমাদের পৃথিবীতে। কিন্তু শব্দ সেরকম নয়। শব্দ চলাচলের জন্য মাধ্যমের দরকার হয়। পৃথিবীতে আমরা যে শব্দ শুনি, তা প্রধানত বাতাসের মধ্য দিয়ে চলাচল করে। যেখান থেকে শব্দ উৎপন্ন হয়, সেই শব্দ তরঙ্গ বাতাসকে একবার সংকুচিত করে, আবার প্রসারিত করে। এভাবে ক্রমাগত সংকোচন ও প্রসারণের মাধ্যমে শব্দ চলাচল করে। শূন্য মাধ্যমে যেখানে আলোর বেগ সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার, সেখানে শব্দের বেগ শূন্য। বাতাসে আলোর বেগ সেকেন্ডে ২,৯৯,৯০০ কিলোমিটার, সেখানে শব্দের বেগ সেকেন্ডে মাত্র ৩৩১ মিটার। আলোর তরঙ্গের সাথে শব্দের তরঙ্গের গঠনগত পার্থক্যও আছে। যেমন আলোর কণার কম্পনের দিক আর তরঙ্গের প্রবাহের দিক পরস্পর সমকোণ বা ৯০ ডিগ্রি। এই কোণের কোন পরিবর্তন হয় না কোন সময়। কিন্তু শব্দের তরঙ্গের কম্পনের দিক এবং প্রবাহের দিক পরস্পর সমান্তরাল। অর্থাৎ কম্পন যেদিকে ঘটে, প্রবাহও সেদিকে ঘটে।

শব্দ তরঙ্গের প্রকৃতি
ছবি: লেখক

কোনো মাধ্যমে শব্দ তরঙ্গের একটি সংকোচন থেকে পরবর্তী সংকোচনের যে দূরত্ব, বা একটি প্রসারণ থেকে পরবর্তী প্রসারণের যে দূরত্ব তাকে সেই শব্দ তরঙ্গের তরঙ্গ-দৈর্ঘ্য ধরা হয়। এক সেকেন্ডে যতবার সংকোচন বা প্রসারণ ঘটে সেই সংখ্যাকে শব্দের কম্পাঙ্ক বলা হয়। যে মাধ্যমের ঘনত্ব যত বেশি, সেই মাধ্যমে শব্দ তরঙ্গের সংকোচন প্রসারণের হারও বেশি হয়। ফলে সেই মাধ্যমে শব্দের বেগও বেশি হয়। যেমন বাতাসের ভেতর দিয়ে শব্দ সেকেন্ডে ৩৩১ মিটার যেতে পারে, চর্বির ভেতর দিয়ে যেতে পারে সেকেন্ডে ১৪৫০ মিটার, পানির ভেতর দিয়ে যেতে পারে সেকেন্ডে ১৫৪০ মিটার, আমাদের শরীরের নরম টিস্যুর ভেতর দিয়েও সেকেন্ডে ১৫৪০ মিটার যেতে পারে। আমাদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ঘনত্বের পার্থক্য আছে। তাই তাদের ভেতর দিয়ে শব্দের বেগেরও পার্থক্য আছে। যেমন, এক সেকেন্ডে শব্দের বেগ মস্তিষ্কে ১৫৪১ মিটার, লিভারে ১৫৪৯ মিটার, কিডনিতে ১৫৬১ মিটার, রক্তে ১৫৭০ মিটার, মাংসপেশীতে ১৫৮৫ মিটার, চোখের লেন্সে ১৬২০ মিটার, মাথার খুলিতে ৪০৮০ মিটার ইত্যাদি।

সব শব্দ কিন্তু আমরা শুনতে পাই না। শব্দ চলাচলের জন্য যেমন মাধ্যমের দরকার হয়, তেমনি শব্দ শোনার জন্যও দরকার হয় উপযুক্ত রিসিভারের। আমাদের কান আমাদের সাউন্ড রিসিভার। মানুষের কানে শোনার একটা সীমাবদ্ধতা আছে। মানুষ সর্বনিম্ন ২০ হার্জ বা সেকেন্ডে ২০ কম্পাঙ্কের শব্দের চেয়ে কম কম্পাঙ্কের কোন শব্দ শুনতে পায় না। যেমন একটা পিঁপড়া যে শব্দ করে–মানুষ তা শুনতে পায় না। ২০ হার্জের কম কম্পাঙ্কের শব্দকে বলা হয় ইনফ্রাসনিক সাউন্ড। আবার উচ্চ কম্পাঙ্কেরও সীমা আছে। মানুষ সর্বোচ্চ ২০ হাজার হার্জ বা ২০ কিলোহার্টজ কম্পাঙ্কের শব্দ শুনতে পায়। কোন শব্দের কম্পাঙ্ক তার বেশি হলে সেই শব্দ মানুষ শুনতে পায় না। ২০ হাজার হার্জের বেশি কম্পাঙ্কের শব্দকে বলা হয় আলট্রাসনিক সাউন্ড। ডলফিন, বাঁদুড় এবং এরকম আরো কিছু প্রাণী আলট্রাসনিক শব্দ শুনতে পায়। বাঁদুড় উজ্জ্বল আলোতে চোখে দেখতে পায় না। রাতের বেলা বাঁদুড় সাবলীলভাবে উড়ে উড়ে কীটপতঙ্গ ধরে ধরে খায় চোখে না দেখেই। তারা এই কাজে আলট্রাসনিক সাউন্ড বা আলট্রাসাউন্ড ব্যবহার করে। তারা মুখ দিয়ে উচ্চ কম্পাঙ্কের শব্দ তৈরি করে। সেই শব্দ কীটপতঙ্গের গায়ে প্রতিফলিত হয়ে তাদের কানে ফিরে আসে। তখন তারা বুঝতে পারে কতদূরে কোথায় রয়েছে তাদের খাদ্য।

বাঁদুড় আলট্রাসাউন্ডের মাধ্যমে দেখে

শব্দের এই ব্যাপারটাকে কাজে লাগিয়ে শতাধিক বছর আগে বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করেছেন সাউন্ড ন্যাভিগেশান রেঞ্জিং–সংক্ষেপে সোনার (Sound Navigation Ranging - Sonar)। বিভিন্ন খনিজ ক্রিস্টাল বা কোয়ার্টজের ভেতর বিদ্যুৎ প্রবাহ চালনা করে উচ্চ কম্পাঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমে আলট্রাসাউন্ড তৈরি করা হয়। সেই শব্দ পানির মাধ্যমে পাঠিয়ে দিয়ে পানির নিচে যদি কোন পদার্থ থাকে তাতে প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসতে কতক্ষণ সময় লাগে তার ভিত্তিতে হিসেব করা হয় পানির নিচে বস্তুটি কত গভীরে আছে। সমুদ্রে ডুবে যাওয়া জাহাজ ইত্যাদি খুঁজে বের করার জন্য এই পদ্ধতির ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। ১৯১২ সালে টাইটানিক জাহাজ যখন ডুবে যায়, তখন সোনার পদ্ধতিতে সেটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু সেই সময় সোনার পদ্ধতির কারিগরি দক্ষতা খুব উন্নত ছিল না। তাই টাইটানিক খুঁজে পাওয়া যায়নি। ১৯৮৫ সালে আরো উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রাডার প্রযুক্তির মতোই সোনার প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নতি ঘটে। সমুদ্রের নিচে সাবমেরিনের চলাচলে সোনার প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানে আলট্রাসাউন্ডের ব্যবহার শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে, ১৯৫০-এর শুরুতে।

দুই

চিকিৎসাবিজ্ঞানে আলট্রাসাউন্ডের প্রাথমিক ব্যবহার শুরু হয়েছিল গলব্লাডারের পাথর শনাক্ত করার কাজে। তারপর স্তনের টিউমার শনাক্ত করার জন্য আলট্রাসাউন্ড ব্যবহার করা হয় ১৯৫০-এর শুরুতে। ১৯৫৩ সালে হৃৎপিন্ডে আলট্রাসাউন্ড প্রয়োগ করে প্রথম ইকো-কার্ডিওগ্রাম করা হয়। আলট্রাসাউন্ডের সবচেয়ে কার্যকর ব্যবহার শুরু হয় ১৯৫৮ সালে মাতৃগর্ভে ভ্রূণের স্বাস্থ্য পরীক্ষায়। ইংরেজ ডাক্তার প্রফেসর আয়ান ডোনাল্ড ছিলেন গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ধাত্রীবিদ্যা বিভাগের প্রধান। গর্ভপাতের ব্যাপারে তিনি ছিলেন ভীষণ রক্ষণশীল। অনাকাঙ্খিত ভ্রুণের গর্ভপাত করাতে কেউ এলে তিনি খুব কড়াভাবে তার বিরোধিতা করতেন। তিনি ভাবলেন গর্ভবতী মাকে যদি তাঁর গর্ভস্থ শিশুর উপস্থিতি এবং ক্রমশ বেড়ে ওঠার ব্যাপারটা দেখানো যায়, কীভাবে একটা জীবন তিল তিল করে বেড়ে ওঠে মায়ের গর্ভে–তা দেখলে কোনে মা-ই চাইবে না গর্ভপাত ঘটাতে। তিনি আলট্রাসাউন্ডের মাধ্যমে তিনি মাতৃগর্ভের ছবি তোলা যায় কিনা পরীক্ষা করলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৈনিক ছিলেন তিনি। রাডার এবং সোনার সম্পর্কে ভালো জ্ঞান ছিল তাঁর। তাঁর হাসপাতালের গর্ভবতী মায়েদের উপর আলট্রাসাউন্ড প্রয়োগ করে শুরুতে তেমন কোন সাফল্য পাননি তিনি। তাঁর হাসপাতালে একজন রোগীর ডিম্বাশয়ে ক্যান্সার টিউমার ধরা পড়েছিল। এক্স-রে করে দেখা গেছে যে টিউমারটি অপারেশান করে বাদ দেয়ার অবস্থায় নেই। অনেকটা নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে চলে যাচ্ছিল রোগী। ডাক্তার ডোনাল্ড সেই রোগীর ডিম্বাশয়ে আলট্রাসাউন্ড প্রয়োগ করে যে ছবি পান–তাতে মনে হলো টিউমারটি ক্যান্সার টিউমার নয়, বরং অপারেশানযোগ্য সিস্ট। অপারেশান করে রোগীর প্রাণ বাঁচানোর পর প্রফেসর আয়ান ডোনাল্ডের আলট্রাসাউন্ডের গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেড়ে গেল। কয়েক বছরের মধ্যেই আলট্রাসনোগ্রাফি হয়ে উঠলো গর্ভস্থ ভ্রূণের স্বাস্থ্যপরীক্ষার প্রধান যন্ত্র। এক্স-রে এবং অন্যান্য সব পরীক্ষায় রেডিয়েশন ব্যবহার করা হয় বলে তা স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। কিন্তু আলট্রাসনোগ্রাফিতে কোন রেডিয়েশন ব্যবহার করা হয় না বলে তা স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ।

গর্ভের শিশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও বেড়ে ওঠা পর্যবেক্ষণে এখনো সবচেয়ে বড় ভরসা আল্ট্রাসনোগ্রাফি

এক্স-রে, সি-টি স্ক্যান, এম-আর-আই ইত্যাদি ইমেজিং সিস্টেমের সাথে তুলনা করলে সবচেয়ে সহজ, নিরাপদ এবং কম খরচে করা যায় আলট্রোসনোগ্রাফি। আলট্রাসনোগ্রাফিক মেশিনের আকারও বেশ ছোট, রোগীর বেডের পাশে বসেই আলট্রাসনোগ্রাফি করা যায়। রোগীর যে অঙ্গে আলট্রাসনোগ্রাফি করা হবে, সেখানে কিছু জেল প্রয়োগ করা হয়। এই জেল আলট্রাসনোগ্রাফি মেশিনের ট্রান্সডিউসারের সাথে শরীরের সংযোগ ঘটায়। ট্রান্সডিউসার হলো ছোট্ট একটি ইলেকট্রনিক যন্ত্র যার ভেতর পাইজো-ইলেকট্রিক কৃস্টালের লেয়ার এবং অন্যান্য ইলেকট্রনিক উপাদান ও সংযোগ থাকে। ট্রান্সডিউসার ইলেকট্রিক সিগনালকে আলট্রাসনিক সিগনালে রূপান্তরিত করে। প্রয়োজন অনুসারে আলট্রাসনোগ্রাফিক ট্রান্সডিউসার ১ থেকে ১০০ মেগাহার্জ কম্পাঙ্কের আলট্রাসাউন্ড তৈরি করতে পারে।

ট্রান্সডিউসার রোগীর শরীরে আলট্রাসনিক সিগনাল পাঠায়। সেই সিগনাল রোগীর শরীরের টিস্যুর সীমানায় প্রতিফলিত হয়ে ট্রান্সডিউসারে ফিরে আসে। টিস্যুর সীমানা বিভিন্ন রকমের হতে পারে–যেমন ফ্লুইড ও সফ্ট টিস্যুর সীমানা, কিংবা টিস্যু ও হাড়ের সীমানা। ট্রান্সডিউসার শরীর থেকে আসা আলট্রাসনিক সিগনালকে ইলেকট্রিক সিগনালে রূপান্তরিত করে আলট্রাসাউন্ড স্ক্যানারে পাঠায়। স্ক্যানার সিগনাল পাঠানোর সময় ও ফিরে আসার সময় থেকে মোট সময় ও শরীরে শব্দের বেগ হিসেব করে ট্রান্সডিউসার থেকে টিস্যুর সীমানার দূরত্ব নির্ণয় করে এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ইমেজ তৈরি করে। অনবরত সিগনাল আসা-যাওয়া করার পুরো সময়জুড়ে রোগীর শরীরে যে অংশে সিগনাল আসা-যাওয়া করে সেই অংশের সরাসরি চিত্র দেখা যায়। আলট্রাসনোগ্রাফিক স্ক্যানার এই চিত্র ভিডিও আকারে মনিটরে সরাসরি দেখায় এবং কম্পিউটারে রেকর্ডও করে রাখে।

তিন

মেডিক্যাল আলট্রাসনোগ্রাফিকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়–রোগনির্ণয়ের জন্য ডায়াগনস্টিক আলট্রাসনোগ্রাফি এবং রোগের চিকিৎসার জন্য থেরাপিউটিক আলট্রাসনোগ্রাফি। ডায়াগনস্টিক আলট্রাসনোগ্রাফিকে আরো দুভাগে ভাগ করা যায়–অ্যানাটমিক্যাল ও ফাংশনাল।

অ্যানাটমিক্যাল আলট্রাসনোগ্রাফি করা হয় শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অ্যানাটমি পর্যবেক্ষণ ও গর্ভস্থ শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণে। হৃৎপিন্ড, রক্তনালী, চোখ, থাইরয়েড, ব্রেন, স্তন, পাকস্থলী, ত্বক, মাংসপেশী–ইত্যাদি অঙ্গের অ্যানাটমিক্যাল আলট্রাসনোগ্রাফি করা হয়। বর্তমানে একই অঙ্গের বিভিন্ন কোণ থেকে আলট্রাসনোগ্রাফি করে তাদের সমন্বয়ে ত্রিমাত্রিক চিত্র তৈরি করার পদ্ধতির বহুল ব্যবহার হচ্ছে। এদেরকে থ্রিডি আলট্রাসাউন্ড বলা হচ্ছে। থ্রিডি আলট্রাসনোগ্রাফের ভিডিও রূপে প্রকাশ করে তাকে ফোর-ডি বলা হচ্ছে।

শব্দের একটি বিশেষ ধর্ম ডপলার ইফেক্ট (Doppler Effect)। আমরা প্রতিদিনই বিভিন্নভাবে শব্দের কম্পাঙ্কের পরিবর্তন লক্ষ্য করি। ধরা যাক, আমরা ট্রেন স্টেশনের প্লাটফরমে দাঁড়িয়ে আছি। ট্রেন প্লাটফরমের দিকে আসার সময় ট্রেনের শব্দের কম্পাঙ্ক ক্রমশ বাড়তে থাকে। আবার প্লাটফরম থেকে দূরে যাবার সময় কম্পাঙ্ক কমতে থাকে। ট্রেনের একই গতিতে আমরাও যদি ট্রেনের সাথে ট্রেনের একই দিকে যেতে থাকি, ট্রেনের কম্পাঙ্কের কোন পার্থক্য বুঝতে পারি না। আবার ট্রেন দাঁড়িয়ে হুইসেল দিতে থাকলে আমরা যখন ট্রেনের দিকে যেতে থাকি–শব্দের কম্পাঙ্ক বাড়তে থাকে, আবার ট্রেন থেকে যখন দূরে যেতে থাকি–শব্দের কম্পাঙ্ক কমতে থাকে। ১৮৪২ সালে অস্ট্রিয়ান পদার্থবিজ্ঞানী ক্রিসচিয়ান ডপলার শব্দের উৎস ও রিসিভারের গতির পরিবর্তনের সাথে শব্দের কম্পাঙ্কের যে পরিবর্তন হয় তার গাণিতিক সূত্র প্রতিষ্ঠা করেন। ডপলারের নাম অনুসারে শব্দের কম্পাঙ্কের এই পরিবর্তনকে ডপলার ইফেক্ট বলা হয়। ১৯৭০ এর দশকে আলট্রাসনোগ্রাফিতে ডপলার ইফেক্ট প্রয়োগ করে ফাংশনাল আলট্রাসনোগ্রাফির সূচনা করা হয়।

ডপলার ফাংশনাল আলট্রাসনোগ্রাফির মাধ্যমে রক্তনালীতে রক্ত প্রবাহ সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা যায়। রক্তপ্রবাহের তরঙ্গ বিশ্লেষণ করে বোঝা যায় রক্তনালীর প্রবাহ স্বাভাবিকভাবে হচ্ছে কি না। যদি রক্তনালীতে মেদ জন্মে বা অন্য কোনভাবে রক্তনালীর পথ সরু হয়ে যায়, বাঁ ব্লক হয়ে পড়ে, রক্তপ্রবাহের তরঙ্গ-বিন্যাস এলোমেলো হয়ে যায়। ধমনীর উপর ট্রান্সডিউসার স্থাপন করে ডপলার আলট্রাসাউন্ড পাঠালে রক্তনালীর রক্তকণিকা থেকে তা প্রতিফলিত হয়। শব্দের উৎস থেকে রক্তকণিকা ক্রমশ দূরে চলে যেতে থাকে। ফলে ডপলার ইফেক্ট ঘটে সেখানে। আলসনোগ্রাফিক মেশিনের কম্পিউটার সেই ডপলার ইফেক্ট হিসেব করে ইমেজ তৈরি করে।

থেরাপিউটিক আলট্রাসনোগ্রাফির উচ্চ কম্পাঙ্কের কম্পনের মাধ্যমে শরীরের ভেতরের ছোট ছোট পাথর ধ্বংস করা হয়, যেমন গলব্লাডার কিংবা কিডনির পাথর। আবার তাপ সৃষ্টির মাধ্যমে ছোট আকৃতির টিউমারও ধ্বংস করে ফেলা যায়। কোন কোন অস্ত্রোপচারের সময় আলট্রাসনোগ্রাফির মাধ্যমে রোগীর ভেতরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা হয়। ক্যান্সার টিউমারের বায়োপসি করার জন্য শরীরের ভেতর সুঁই ঢুকাতে হয়। তখন আলট্রাসনোগ্রাফির মাধ্যমে দেখে নেয়া হয় টিউমারের অবস্থান। আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা সমন্বিত চিকিৎসাব্যবস্থা। শুধুমাত্র একটি প্রক্রিয়া ব্যবহারের বদলে এক চিকিৎসার জন্য অনেকগুলি প্রক্রিয়ার সাহায্য নেয়া হয়। আলট্রাসনোগ্রাফি সেখানে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।