চলে গেলেন পিডিএফ প্রযুক্তির জনক চার্লস গেশকি

গত ১৬ এপ্রিল চার্লস 'চাক' গেশকি মারা গিয়েছেন। নাম শুনে নিশ্চয়ই ভাবছেন, ইনি আবার কে? আপনার মোবাইলে বা কম্পিউটারে যে অ্যাডোবি অ্যাক্রোব্যাট পিডিএফ রিডারটা আছে, পোর্টেবল ডকুমেন্ট ফরম্যাট (পিডিএফ) নামে যে ফরম্যাটটা আছে, যে ফরম্যাটের কল্যাণে মোবাইল বা কম্পিউটারে বই পড়া যায়, ডকুমেন্টস বা কাগজপত্র প্রিন্ট দেওয়া যায় সহজেই- সেই পিডিএফ ফরম্যাট ও পিডিএফ রিডারের উদ্ভাবক তিনি। আজকের অ্যাডোবি ফটোশপ, ইলাস্ট্রেটর কিংবা ইন-ডিজাইন, এসব ছাড়া বর্তমান পৃথিবী আসলে কল্পনা করাও কঠিন। এই অ্যাডোবি ইনক.-এর সহপ্রতিষ্ঠাতা চার্লস গেশকি।

১৯৮০ সাল। জেরক্স পার্ক। জেরক্সে কাজ করতে গিয়েই পরিচয় গেশকি ও জন ওয়ার্নকের। জেরক্সকে চেনেন আপনারা। লেজার প্রিন্টার তৈরির জন্য যারা আজও বিখ্যাত।

সে সময় কোনো কাগজ প্রিন্ট করাতে হলে প্রফেশনাল প্রিন্টিং প্রেসে নিয়ে যেতে হত। কম্পোজ করে, হাজারটা ঝামেলা করে প্রিন্ট দিতে হতো সেই কাগজ। গেশকি ও ওয়ার্নক মিলে নতুন এক পদ্ধতি উদ্ভাবন করলেন। এ পদ্ধতি ব্যবহার করে সহজেই কম্পিইটার থেকে প্রিন্টারে কাগজ পাঠানো যায়, প্রিন্ট দেওয়া যায়। জেরক্স এ সুযোগ ছাড়বে কেন? তারা বলল, মাত্র ৭ বছরের মধ্যে এ প্রযুক্তি বাজারে নিয়ে আসতে পারবে। গেশকি এবং ওয়ার্নক বুঝলেন, এই তাদের সুযোগ। দ্রুত নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে হবে। জেরক্সের চাকরি ছেড়ে দিলেন তাঁরা।=

ওয়ার্নকের বাড়ির পেছনে ছোট্ট একটা গ্যারেজ। গাড়ি রাখার কাজে ব্যবহার হয় না। স্টোররুম হিসেবে টুকটাক কাজে লাগে। বছরের পর বছর ধরে জমা ধুলো, বাসার ফেলনা, অব্যবহৃত কত কত জিনিস- সব পরিষ্কার করে-টরে দুজনে মিলে খুলে বসলেন নিজেদের কোম্পানি। ওয়ার্নকের বাসার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে অ্যাডোবি ক্রিক। সেই ক্রিকের নামানুসারে নিজেদের কোম্পানির নাম দিলেন অ্যাডোবি সিস্টেমস। প্রতিষ্ঠানটির লোগো ডিজাইন করেন মার্ভা ওয়ার্নক, জনের গ্রাফিক্স ডিজাইনার স্ত্রী।

ওয়ার্নক, গেশকি, ডাগ ব্রটজ, এড ট্যাফট এবং বিল প্যাক্সটন মিলে তখন হাতের প্রযুক্তির দিকে মন দিলেন। গড়ে উঠল পেজ ডেসক্রিপশন ল্যাঙ্গুয়েজ পোস্টস্ক্রিপ্ট (PostScript)। খানিকটা অতিসরলীকরণ করে বললে, কম্পিউটার এই ভাষা ব্যবহার করে পৃষ্ঠাগুলোকে সহজেই আলাদা করতে পারে, শনাক্ত করতে পারে ঠিকভাবে। ফলে ব্যক্তিগত কম্পিউটার ও প্রিন্টার ব্যবহার করে কাগজপত্র প্রিন্টিং করা যায় সহজেই। সে সময়কার প্রযুক্তি বিশ্বে এরকম একটা বিপ্লব হয়ে যাচ্ছে, আর তার মধ্যে স্টিভ জবস নেই- তা-ই কি হয়?

১৯৮৩ সালের একদিন জবস এলেন অ্যাডোবি সিস্টেমসের অফিসে। কিনে নিতে চাইলেন কোম্পানিটি ৫ মিলিয়ন ডলারে। গেশকি কিন্তু রাজি হননি। কিন্তু স্টিভ জবস তখন অনেক বড় নাম। শেষ পর্যন্ত তাই তাঁদের ইনভেস্টরের অনুরোধে জবসের সঙ্গে কাজ করতে রাজি হয় অ্যাডোবি। জবস এ সময় কিনে নেন কোম্পানিটির ১৯% শেয়ার। পাশাপাশি, অ্যাডোবির সে সময়কার শেয়ারের মূল্য অনুযায়ী পুরো কোম্পানির যে দাম পড়ে, তার পাঁচগুণ বিনিয়োগ করেন তিনি ওই কোম্পানিতে। তার ওপর অগ্রীম মূল্য পরিশোধ করে পাঁচ বছর পোস্টস্ক্রিপ্ট ব্যবহারের লাইসেন্স করে নেন। সিলিকন ভ্যালিতে প্রতিষ্ঠার প্রথম বছরেই লাভের মুখ দেখা প্রথম কোম্পানি হিসেবে সময়ের খাতায় নাম লেখায় অ্যাডোবি। তারপরেরটুকু ইতিহাস।

মাস পেরোনোর আগেই অ্যাপল ম্যাকিনটোশ লঞ্চ করে। পরের বছর বাজারে আসে অ্যাপলের প্রিন্টার, লেজাররাইটার (LaserWriter)। পুরো জিনিসটা দাঁড়িয়ে আছে পোস্টস্ক্রিপ্ট ল্যাঙ্গুয়েজের ওপর। বলাই বাহুল্য, প্রিন্টার প্রকল্পে অ্যাপলের পার্টনার হিসেবে আছে অ্যাডোবি। চিফ অপারেটিং অফিসার গেশকির দায়িত্বে বড় কোম্পানিদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শুরু হলো অ্যাডোবির পথচলা। এরই সূত্র ধরে ধীরে ধীরে গড়ে উঠল অ্যাক্রোবেট (পিডিএফ রিডার), ফটোশপ, ইলাস্ট্রেটর, ইন ডিজাইন। কিন্তু অ্যাডোবি আজও মনে করে, তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন ছিল পোর্টেবল ডকুমেন্ট ফর্ম্যাট (পিডিএফ)। আর, এসব উদ্ভাবনের হাত ধরেই অ্যাডোবি সিস্টেমস নামের ছোট্ট প্রতিষ্ঠানটি পরিণত হয় আজকের অ্যাডোবি ইনকর্পোরেশন (ইনক.)-এ। যাদের বর্তমান বাজার মূল্য ২৪৫ বিলিয়ন ডলার। আজকের ডিজিটাল জীবন যাদেরকে ছাড়া কল্পনা করাও দুঃসাধ্য।

ওপরের গল্পটা যতটুকু অ্যাডোবির, ততটাই চার্লস গেশকির। ১৯৩৯ সালে ওহায়োর ক্লিভল্যান্ড শহরে জন্ম। গণিত খুব পছন্দ করতেন। স্নাতকোত্তর পড়াশোনাও করেছেন গণিতে। এমনকি, জন ক্যারোল বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে শিক্ষকতাও করেছেন প্রায় ছয় বছর। তারপর চলে আসেন কম্পিউটার বিজ্ঞানে। পিএইচডি করেন কার্নেগ মেলন বিশ্ববিদ্যালয়ে। পিএইচডি শেষে যোগ দেন জেরক্সে। তারপরের ঘটনা তো আগেই বলেছি।

চার্লস গেশকি মারা গেছেন ক্যানসারে। তাঁর স্ত্রীর নাম ন্যান্সি ম্যাকডোনাহ। এই দম্পতির একটি মেয়ে ও দুই ছেলে আছে।

নিজেকে গেশকি ব্যবসায়ী ভাবতেন না, ভাবতেন প্রকৌশলী। ২০০৯ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা গেশকি ও ওয়ার্নককে ন্যাশনাল মেডাল অব টেকনোলজি অ্যান্ড ইনোভেশন পুরষ্কারে ভূষিত করেন।

প্রযুক্তির ইতিহাসে চার্লস গেশকির নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

লেখক : শিক্ষার্থী, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

সূত্র : দ্য ভার্জ, নিউ ইয়র্ক টাইমস, উইকিপিডিয়া