দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লবের স্বপ্নের শহর

শিল্পবিপ্লব হলো শক্তির প্রাযুক্তিক বিপ্লব। বাষ্পীয় ইঞ্জিনের উদ্ভাবনেই তা শুরু হয়েছিল। মানুষ ও পশুর শ্রমকে যন্ত্র দিয়ে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হয়। ফলে বিপুল পরিমাণ সম্পদ উত্পাদন করা যায় এবং পুঁজিকে জমা করার সুবিধা পাওয়া যায়। তাই বাষ্পীয় ইঞ্জিনকে বলা যায় শিল্পায়নের চাকা বা চালিকা শক্তি। এই চালিকা শক্তিকে রসদ জুগিয়েছিল জীবাশ্ম জ্বালানি। কিন্তু জীবাশ্ম উেসর সঞ্চয়গুলো পাওয়া গেছে বিশ্বের নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে এবং সীমিত সংখ্যায়। এর ফলে খনিজ সম্পদকে ঘিরে সবার চাহিদা কেন্দ্রীভূত হয়েছিল।

বড় বড় অল্প কয়েকটি কোম্পানি ও শক্তিধর রাষ্ট্রের পক্ষেই শুধু সম্ভব হয়েছে এই উত্সগুলো থেকে শক্তি বের করে তা ব্যবহারের। এর জন্য কেন্দ্রীভূত শক্তি ও অবকাঠামো শুধু তাদেরই আছে। ফলে বিশ্বব্যাপী জীবাশ্ম শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো নিজের অস্তিত্বের কারণেই ক্রমাগত কেন্দ্রীভূত হয়েছে মনোপলাইজ এবং বিশ্বায়নে। এতে সবকিছু নিজের দখলে রাখার প্রবণতা বাড়ছে মানুষের ভেতরে।

বর্তমানে জীবাশ্ম জ্বালানি খরচে দহনজনিত নির্গমন বিশ্বব্যাপী সংকট তৈরি করছে। ফলে সৃষ্টি হয়েছে পরিবেশদূষণ, প্রকৃতিবিমুখতা এবং এককেন্দ্রিকতা। এর থেকে মুক্তির কি কোনো উপায় নেই? সে রকম একটি উপায় হচ্ছে নবায়নযোগ্য জ্বালানি—বিশেষত সৌরশক্তি।

সেটা বোঝা গিয়েছিল ১৯৬৯ সালে। সেবার রলফ ডিস্ক ইউরোপের ফ্রেইবুর্গে এ রকম এক হাউজিং এস্টেট গড়তে চাইলেন। সেই এস্টেটে বাড়িগুলোতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রক যন্ত্র ছাড়াই সব সময় তাপমাত্রা ১৫-২০ ডিগ্রির মধ্যে থাকবে। ৪ সদস্যের জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণ এসব বাড়ি বছরে গড়ে প্রয়োজনীয় শক্তির চেয়ে বেশি শক্তি উত্পাদন করবে। ফলে বাড়ির সদস্যরা শক্তি বিক্রির মাধ্যমে প্রতি মাসে কিছু উপার্জনও করতে পারবেন। কোনো ধরনের জ্বালানি তেল বা কেন্দ্রীয় শক্তি-সংকটে তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না, বরং সহযোগিতার হাত বাড়াতে পারবেন। ডিস্কের মতে, এ ব্যবস্থায় পাবলিক গ্রিডগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত থাকার উপায়ও থাকবে।

প্রতিটি বাড়ি থাকবে সূর্যের দিকে মুখ করে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো। বাড়ির সামনের অংশটা ছাদের মতো দেখতে। সেগুলোর নকশা এমনভাবে করা, যাতে তা উত্তাপ শুষে নিতে পারে। এ ব্যবস্থাটা শীতের জন্য, যখন সূর্য আকাশের নিচের অংশে থাকে। উত্তর দিকের অংশটা (তিন-চারতলার সমান উচ্চতার হবে) বন্ধ রাখা হয়, যাতে বাতাস আর বৈরী আবহাওয়া কোনো সমস্যা করতে না পারে। পরিশুদ্ধ আলো-বাতাস ঢোকার প্রক্রিয়া গরমের সময় বাড়ি রাখে ঠান্ডা আর শীতে রাখে গরম। কোনো রকম শীতাতপ নিয়ন্ত্রক যন্ত্র ছাড়াই গ্রীষ্মে তাপমাত্রা যখন ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছে যায় অথবা শীতে মাইনাস ২০, বাড়ির ভেতরের তাপমাত্রা তখন ১৫ থেকে ২৫ ডিগ্রির মধ্যে থাকে—সারা বছর ধরে, কোনো শীতাতপ নিয়ন্ত্রক যন্ত্র ছাড়াই। এটা শুধু জার্মানির শহর নয়, এটা আমাদের দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লবোত্তর ভবিষ্যত্ পৃথিবীর শহর। উল্লেখ্য, রলফ ডিস্কের অন্তত চার বছর পর শিল্পপ্রধান দেশগুলোর মানুষ বুঝতে পারে যে জ্বালানির অপর্যাপ্ততা ও তেল-সংকট এগিয়ে আসছে।

সভ্যতা যে বিভিন্নভাবে বিকশিত হতে পারে, এ ধারণা অনেকের কাছে একসময় অসম্ভব মনে হয়েছিল। কেননা বেশির ভাগ বিশ্লেষক শক্তিব্যবস্থা, অর্থনীতি ও সামাজিক বিকাশের মধ্যকার সম্পর্কগুলো নিয়ে তেমন সচেতন হতে পারেননি। বর্তমানে জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প হিসেবে নবায়নযোগ্য শক্তিকে অবধারিত ভাবা হচ্ছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি হচ্ছে দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লব। নবায়নযোগ্য শক্তি হচ্ছে সৌরতাপ, সূর্যরশ্মি, পানিশক্তি, বায়োমাস ও বায়ুশক্তি।

নবায়নযোগ্য জ্বালানিবিষয়ক এক গবেষণায় ড. শিয়ার হারম্যান দেখান, নিউক্লিয়ার শক্তি ও জীবাশ্ম উত্স বিশ্বকে যে পরিমাণ জ্বালানি দেয়, তার চেয়ে ১৫ হাজার গুণ বেশি শক্তি দিতে পারে সূর্যরশ্মি বা সৌরশক্তি। এ কারণে জীবাশ্ম উৎসের পরিবর্তে সৌরশক্তি ব্যবহার করা অনেক বেশি বাস্তবসম্মত।

শিয়ার হারম্যানের অভিমত, সূর্যরশ্মি অফুরন্ত। এটি বিশ্বের সর্বত্র সহজলভ্য। একে ব্যক্তিকেন্দ্রিক করা যায় না। এই উত্স পরিবেশবান্ধব। অনিয়ন্ত্রিত শোষণ ও শাসনের হাতিয়ারে পরিণত করা সম্ভব নয়। তারপরও বর্তমানে বিশ্বের ৯০ শতাংশ জ্বালানি শক্তি অনবায়নযোগ্য উৎসের ওপর নির্ভরশীল। সম্ভবত দ্রুত মুনাফা এবং এককভাবে স্বার্থসিদ্ধি না হওয়ায় গোটা বিশ্ব নবায়নযোগ্য উেসর দিকে খুব ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। তারপরও বিশ্বের ২০ শতাংশ বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য উত্স থেকে উত্পাদিত হচ্ছে। তবে নভেম্বর-২০১৬-এ বিবিসির এক প্রতিবেদন বলছে, বর্তমানে পৃথিবী কয়লার চেয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানি বেশি বিদ্যুৎ উত্পাদন করছে।

শক্তির এই বিকেন্দ্রীকরণ সমাজকে আরও মানবিক করবে, কেননা সূর্যকে ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে রূপান্তরিত করা যাবে না। সৌর উেসর ব্যবহারের জন্য দরকার হবে অগুনতি ছোট ছোট মাপের স্থাপনা। ব্যাপক পুঁজির দরকার নেই, বরং দরকার অগুনতি ছোট বিনিয়োগ। যেকোনো মানুষের পক্ষে অংশগ্রহণ সম্ভব। এভাবে প্রত্যেক মানুষের অংশগ্রহণে সৌরশক্তির ব্যাপক ব্যবহার সম্ভব হতে পারে। সৌরশক্তিনির্ভর অর্থনীতির দিকে ধাবিত হওয়াকেই বলা যায় দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লবের সূচনা। এটা বাস্তবায়িত হলে প্রথম শিল্পবিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে যাবে; কিন্তু অস্তিত্বের মারাত্মক হুমকিকে দূর করবে। এ ধরনের অগ্রগতি ও সুবিধা সমাজকে নতুন রাজনৈতিক ভিত্তির দিকে নিয়ে যাবে। সম্ভবত এই কারণেই এখানে পুঁজিপতিদের বিনিয়োগে একধরনের অনীহা কাজ করছে। যে কারণে কুটিরশিল্পের বিকাশ ঘটেনি, কিন্তু পোশাকশিল্পের বিকাশ ঘটেছে। শুধু সস্তা শ্রমই নয়, পরিবেশ বিপর্যয়, নদীদূষণের বিনিময়ে এই দ্রুত মুনাফা প্রাপ্তি ঘটেছে।

সৌর উেসর ব্যবহারের অর্থ হলো এর আঞ্চলিক বাজার থাকবে। যেখানে প্রযুক্তির বাজার না থাকলেও এটাকে ব্যবহার করা যাবে বিকেন্দ্রীভূত পথে। কেননা অর্থনৈতিক কার্যক্রমগুলো সর্বদা শক্তি উত্সকে অনুসরণ করে চিন্তা করা হয়। তাই রাজধানীকেন্দ্রিক মনোযোগ এখানে অচল এবং প্রাযুক্তিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।

এগুলো করতে বড় ট্রানজিশনাল বিজনেস গ্রুপ বা মেগাসিটির প্রয়োজন পড়বে না, বরং ছোট ও মধ্যম আকারের ফার্ম ও পল্লি অঞ্চল থেকে তা সম্পন্ন হবে। শুধু সৌর উেসর ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে জীবাশ্মভিত্তিক এই অর্থনীতির অসাম্য মালিকানা আমাদের দূর করা সম্ভব। স্বভাবগতভাবে ডিজিটাল প্রযুক্তি এর সঙ্গে যুক্ত হলে বিকেন্দ্রিকতা ত্বরান্বিত হবে।

স্পেসএক্সের উদ্যোক্তা এলন মাস্কের মতো ভবিষ্যতের দিকে তাকানোর মানুষেরা অবশ্য বলছেন, ২০৩১ সালের মধ্যে সূর্যকে সবচেয়ে বড় ব্যবহারযোগ্য শক্তি উেস পরিণত করতে হবে। কিন্তু এ ধরনের নতুন ধারণা, আবিষ্কার পৃথিবীর সামগ্রিক অর্থনীতি, রাজনীতি ও সামাজিক পরিবেশকে পরিবর্তন করে দিলেও ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ থেকে বের হওয়া যাচ্ছে না। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে কালেক্টিভ নলেজ ও কালেক্টিভ পার্টিসিপেশন সত্ত্বেও ডিজিটাল প্রযুক্তি দু-তিনজন মানুষকে বিশ্বের প্রথম আট ধনীর কাতারে ফেলছে। একজন হলেন বিল গেটস, দ্বিতীয়জন মার্ক জাকারবার্গ। অর্থাত্ ডিজিটাল প্রযুক্তির বৈশিষ্ট্যগতভাবে বিকেন্দ্রীকরণ হলেও প্রযুক্তিকে যাঁরা নিয়ন্ত্রণ করছেন, তাঁরা অর্থসম্পদকে ভীষণভাবে কেন্দ্রীকরণ করে ফেলছেন। তাহলে বিকেন্দ্রীকরণ ব্যবস্থাকেও কেন্দ্রীকরণ করে ফেলছে সামাজিক প্রক্রিয়াগুলো। তাহলে সমস্যাটা কোথায়? এর একটি সম্ভাব্য উত্তর আছে বিবর্তনীয় জীববিদ্যায়। বিবর্তনের কোটি বছরের ইতিহাসে অস্তিত্ব সংগ্রামে শুধু নিজেকে টিকিয়ে রাখতে শিখিয়েছে, যেকোনো মূল্যে নিজের সুবিধা নিতে শিখিয়েছে, যা সামাজিকভাবে সবাই মিলেমিশে বেঁচে থাকার পরিপন্থী। বর্তমানে এই সমস্যাকে নির্দিষ্ট করতে মস্তিষ্কের একটি অংশ আর-কমপ্লেক্সকে দায়ী করা হচ্ছে। এই অংশের জন্য আমরা অসহিষ্ণুতা প্রদর্শন করছি, আমারটাই শ্রেষ্ঠ বলে দাবি করছি, অন্যের মতামতকে মূল্য দিচ্ছি না, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অকল্পনীয় সম্পদকে কুক্ষিগত করছি।

লেখক: বিজ্ঞানবক্তা ও সাংবাদিক

* লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার জুলাই সংখ্যায় প্রকাশিত