ন্যানোর পরিচয়

ন্যানো মানে অতি ক্ষুদ্র। ন্যানো টেকনোলজি বলতে বোঝায় সেই ধরনের প্রযুক্তি, যা অতি ক্ষুদ্র কণা নিয়ে কাজ করে। কিন্তু কতটা ক্ষুদ্র? ১ ন্যানো মিটার হচ্ছে ১ মিটারের ১০০ কোটি ভাগের ১ ভাগ। আর ১ ইঞ্চি সমান ২ কোটি ৫৪ লাখ ন্যানো মিটার। ১ ন্যানো মিটার মানুষের চুলের ব্যাসের ১ লাখ ভাগের ১ ভাগ।

এ বিষয়ে জানার আগে, প্রথমেই আসা যাক পরমাণুর কথায়। পরমাণু পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণা, যা খালি চোখে দেখা যায় না। এমনকি অত্যন্ত শক্তিশালী সাধারণ আলোক অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যেও দেখা যায় না। একটি পরমাণুর ব্যাস ০.১ ন্যানো মিটার থেকে ০.৫ ন্যানো মিটারের মধ্যে। বিশ্বের সব পদার্থই পরমাণু দিয়ে তৈরি। তাই পদার্থ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পরমাণুর ধর্ম, গঠন, প্রকৃতি ব্যাখ্যা করতে চাইলেন বিজ্ঞানীরা। মাত্র ৩০ বছর আগে ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে পরমাণুগুলোকে আলাদা করে দেখা ও বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করা সম্ভব হয়। তখন থেকেই ন্যানো প্রযুক্তির নতুন পর্যায় শুরু। এ ক্ষেত্রে সাধারণভাবে দুই ধরনের ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। একটা হলো স্ক্যানিং টানেলিং মাইক্রোস্কোপ, যা দুর্বল বিদ্যুতের সাহায্যে এই মাইক্রোস্কোপ পরিচালনা করা হয়। আরেকটা হলো অ্যাটমিক ফোর্স মাইক্রোস্কোপ। এই মাইক্রোস্কোপ যেসব তথ্য সংগ্রহ করে, সেগুলো এর সঙ্গে থাকা মনিটরে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করে।

একই মৌল বিভিন্ন রূপে থাকতে পারে। যেমন কয়লা, হীরা, গ্রাফাইট। সব কটিতেই একটাই মৌল। সেটা হলো কার্বন। তবু এদের চেহারা ও বৈশিষ্ট্য আলাদা কেন? আসলে একই পরমাণু দিয়ে তৈরি, কিন্তু সেগুলোর সজ্জাতে পার্থক্য তৈরি হলেই আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে। এ কারণেই হীরা অনেক কঠিন কিন্তু গ্রাফাইট বেশ নরম। গ্রাফাইট বিদ্যুৎ পরিবাহী কিন্তু হীরা অপরিবাহী। গ্রাফাইট অস্বচ্ছ কিন্তু হীরা স্বচ্ছ। আবার একই পদার্থের দৃশ্যমান অবস্থা এবং পারমাণবিক অবস্থার মধ্যেও আচরণগত বিরাট পার্থক্য দেখা যায়। স্বাভাবিক দৃশ্যমান অবস্থায় পদার্থের ভর আছে, স্থানও দখল করে। এ অবস্থায় বস্তুর গতিপ্রকৃতি বোঝা যায় ‘ক্ল্যাসিক্যাল মেকানিকসের’ সাহায্যে। কিন্তু পরমাণু পর্যায়ে পদার্থগুলো একেবারে নিজস্ব মৌলিক অবস্থায় বিরাজ করে। এই পর্যায়ে পদার্থের ধর্ম কণাগুলোর আকারের ওপর নির্ভরশীল হয়। অতি ক্ষুদ্র অবস্থায় পদার্থের কণাগুলো কখনো কণা আবার কখনো তরঙ্গের মতো আচরণ করে। সে ক্ষেত্রে এদের গতিপ্রকৃতি ও আচরণ কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সূত্র দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়।

কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সূত্র ও নিয়মাবলি চিরায়ত বলবিদ্যা থেকে আলাদা। তাই ন্যানো পর্যায়ে বস্তুর কণাগুলোর আচরণও স্বাভাবিক অবস্থার মতো নয়। ধরা যাক, আপনি হাঁটছেন। চলার পথে আপনার সামনে একটা উঁচু খাড়া দেয়াল পড়ল। তবে আপনি তা ভেদ করে চলে যেতে পারবেন না। কিন্তু ন্যানো জগতের কিছু কিছু ইলেকট্রন তার সামনের বাধা ভেদ করে বেরিয়ে যেতে পারে। এই প্রক্রিয়াকে ‘টানেলিং’ বলা হয়। আর এই প্রক্রিয়ার কারণে বিদ্যুৎ অপরিবাহী একটি বস্তু ন্যানো পর্যায়ে এসে অর্ধপরিবাহীও হয়ে উঠতে পারে। বস্তুর গলনাঙ্ক, রাসায়নিক বিক্রিয়াজনিত আচরণ, চুম্বকীয় আচরণ, প্রতিপ্রভা ইত্যাদি ক্ষেত্রেও ব্যাপক পরিবর্তন দেখা দেয় ন্যানো পর্যায়ে গেলে।

তাই ন্যানো অবস্থার ধর্ম ব্যবহার করে উদ্ভাবন করা যায় নানা প্রযুক্তি। আবার ন্যানো প্রযুক্তির সাহায্যে পদার্থের গঠনগত মান পরিবর্তন বা পদার্থের ভৌত ও রাসায়নিক ধর্মের আমূল পরিবর্তন করা সম্ভব। এভাবে প্রযুক্তিবিদ ও বিজ্ঞানীরা প্রতিদিন নতুন নতুন বস্তু তৈরি করে চলেছেন। ইতিমধ্যেই কোনো কোনো বস্তুকে অধিক শক্তিশালী, কোনোটিকে হালকা অথচ অধিক টেকসই আবার কোনোটিকে রাসায়নিকভাবে বিক্রিয়াশীল বা অধিক বিদ্যুৎ পরিবাহী করে তোলা সম্ভব হয়েছে। ফলে বিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তি, শক্তি উত্পাদন, পরিবেশবিজ্ঞান, শিল্প, চিকিত্সা, পরিবহন ও যাতায়াত, খাদ্যনিরাপত্তা ইত্যাদি প্রায় সব ক্ষেত্রেই এই প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে দিন দিন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে ন্যানো প্রযুক্তি। ইতিমধ্যে প্রায় ৮০০ ধরনের বস্তুকে বাণিজ্যিক বস্তুতে রূপান্তরিত করে বাজারজাত করা হয়েছে।

বিজ্ঞানীরা দুটি বিশেষ ধরনের ন্যানো নকশার ব্যবহার করছেন। একটি হলো ন্যানো ওয়্যার এবং অপরটি কার্বন ন্যানো টিউব। ন্যানো ওয়্যার হচ্ছে ১ ন্যানো মিটার ব্যাসের অতি সূক্ষ্ম একধরনের তার, যার দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের অনুপাত ১০০০:১। অর্থাৎ এটিকে এক মাত্রার পদার্থ বলা যেতে পারে। প্রয়োজন অনুযায়ী এগুলোকে বিদ্যুৎ অপরিবাহী, পরিবাহী, অর্ধপরিবাহী এমনকি অতি পরিবাহী করে তোলা যায়। ন্যানো ওয়্যার সংশ্লেষ করা হয় দুইভাবে। একটি পদ্ধতিতে বস্তুর একটি বড় টুকরাকে ভেঙে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র করা হয়। আরেকটি পদ্ধতিতে উপাদান অনুযায়ী একটির পর একটি পরমাণুর সংযোজন ঘটানো হয়। দ্বিতীয় পদ্ধতিটাই বেশি প্রচলিত।

ন্যানো কার্বন টিউব

কার্বন ন্যানো টিউব হচ্ছে কার্বন পরমাণু দিয়ে তৈরি ষড়ভুজ আকৃতিবিশিষ্ট একটি ন্যানো সিলিন্ডার। কার্বন পরমাণুর পাতলা একটি পাতকে ভাঁজ দিয়ে (রোল করে) এটা তৈরি করা হয়। এই ভাঁজের ওপরই এটির ধর্ম নির্ভর করে। অর্থাৎ সব কার্বন ন্যানো টিউব কার্বন পরমাণু দিয়ে তৈরি হলেও টিউবটির ভেতরের প্রতিটি পরমাণু কীভাবে বিন্যস্ত হয়েছে, এর ওপর ভিত্তি করে এগুলোর ধর্ম বিভিন্ন হয়ে থাকে। কার্বন পরমাণুর তুলনায় এগুলো রাসায়নিক বিক্রিয়ার ক্ষেত্রে কম সক্রিয় এবং এগুলোর মধ্যে প্রাকৃতিকভাবে প্রাপ্ত হীরা ও গ্রাফাইট—এ দুটি পদার্থেরই গুণাগুণের সন্নিবেশ ঘটানো হয়েছে। তাই এগুলো হীরার মতো শক্তিশালী অথচ গ্রাফাইটের মতো বিদ্যুৎ পরিবাহী। স্টিলের তারের চেয়ে এগুলো প্রায় ১০০ গুণ শক্তিশালী, অথচ ওজন মাত্র ৬ ভাগ। আবার খুবই কার্যকরভাবে এগুলোকে বিদ্যুৎ অর্ধপরিবাহী করে তোলা সম্ভব হচ্ছে, যা শুধু একটি বিশেষ দিকে বিদ্যুৎ পরিবহনে সক্ষম।

লেখক: অধ্যাপক, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, ঢাকা