প্রতিদিনকার ন্যানো

খুব আয়েশি একটা ছুটির দিনের কথা ভাবুন। কক্সবাজারে অবকাশ যাপনের জন্য চড়ে বসেছেন বিমানে। গায়ে জড়িয়েছেন সিল্কের তৈরি বিশেষ কাপড়, যে কাপড় পরলে ইস্তিরি করতে হয় না নিয়মিত। সঙ্গে নিয়েছেন শক্তিশালী এক ক্যামেরা, যা দিয়ে ছবি তুলে দেখাবেন পরিবার ও বন্ধুকে। বিমান থেকে নেমে রওনা দিয়েছেন সুইমিংপুলের দিকে। চোখে লাগিয়েছেন এক বিশেষ চশমা, যে চশমার কাচে আঁচড় পড়ে না সহজে। মোবাইল থেকে বাজিয়ে দিয়েছেন পছন্দের গান, বাজছে নিখুঁত শব্দে। তারপর ঝাঁপ দিলেন না–শীতল না–উষ্ণ আরামদায়ক পানিতে।

এই যে কাজগুলো করলেন, এদের প্রতিটিতেই আছে ন্যানো প্রযুক্তির হাত। সব সময় এদের মাঝে ডুবে থাকেন বলে হয়তো টের পাচ্ছেন না, কিন্তু তারা ঠিকই প্রতিনিয়ত আপনার জীবনকে আয়েশ দিয়ে চলছে। যে প্লেনটিতে চড়েছেন, তার প্রলেপের জন্য যে উপাদান ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহার আছে। সাধারণ পদার্থ দিয়ে প্রলেপ করালে সেটিতে বাতাসের বাধা লাগে প্রচুর, যা প্লেনের স্বাভাবিক গতিতে সমস্যা তৈরি করে। বাধাহীন ঘর্ষণহীনভাবে চলার জন্য ন্যানো প্রযুক্তির সাহায্যে বিশেষভাবে তৈরি প্রলেপ ব্যবহার করা হয়।

সিল্ক বা রেশমের কাপড় অন্য সব কাপড় থেকে আলাদা। সহজে বটে যায় না, মসৃণ থাকে সব সময়। আলাদা হওয়ার পেছনে কাজ করছে বিশেষ একটি কারণ। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ন্যানো স্তরে বিশেষ সজ্জা দিয়ে গড়া এরা। এই সজ্জা এদের আলাদা বিশেষত্ব দিয়েছে সাধারণ কাপড় থেকে। প্রাকৃতিকভাবে ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহারের চমৎকার একটি উদাহরণ হতে পারে এই রেশম কাপড়।

ছবি তোলার জন্য যে ক্যামেরাটি ব্যবহার করছেন কিংবা গান শোনার জন্য যে মোবাইলটি ব্যবহার করছেন, তাদের পরতে পরতে আছে ন্যানো প্রযুক্তির ব্যবহার। ভেবে দেখুন একটি যত সুবিধা পাওয়া যায়, তার সবগুলোর জন্য যদি আলাদা আলাদা যন্ত্র বসানো হয়, তাহলে কত জায়গা দখল করবে? এগুলো কিন্তু এঁটে আছে হাতে ধরে রাখার উপযোগী ছোট্ট একটি যন্ত্রের মাঝে। জিনিসগুলোকে কল্পনাতীত পরিমাণ ক্ষুদ্র রাখতে সহায়তা করেছে ন্যানো প্রযুক্তি।

আঁচড়ে নষ্ট হয়ে যাওয়া সাধারণ কাচ থেকে আঁচড়রোধী বিশেষ কাচ তৈরির পেছনে আছে ন্যানো প্রযুক্তির ব্যবহার। কচুপাতার কথাই ভাবুন না। বেশির ভাগ গাছের পাতায় পানি লাগলেও কচুপাতায় লাগে না। কারণ ন্যানো স্তরে এর পৃষ্ঠের গঠন এমন যে এর পৃষ্ঠ পানিবিদ্বেষী হয়। এই ধর্মকে কাজে লাগিয়ে এমন পোশাক ডিজাইন করা হচ্ছে, যা পানি কিংবা কাদায় পড়ে গেলেও কিছু হবে না।

সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি থেকে রক্ষা দেওয়ার জন্য বিশেষ ধরনের সান্সক্রিম হয়তো ব্যবহার করেছেন অনেকে। সেখানে এমন কিছু উপাদান দেওয়া থাকে, যা ন্যানো স্তরে সূর্যের বিশেষ ক্ষতিকর রশ্মিগুলোকে প্রতিফলনের মাধ্যমে ফিরিয়ে দেয়। টেলিভিশনে ক্রিকেট ম্যাচ দেখার সময় অনেকেই হয়তো খেয়াল করেছেন, রোদের সময় অনেক খেলোয়াড় মুখে বা ঠোটে সাদা ক্রিম ব্যবহার করেন। এটিও মূলত সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি থেকে বাঁচার জন্যই। এতে থাকা জিংক অক্সাইড ন্যানো স্তরে ক্ষতিকর রশ্মিকে প্রতিফলিত করে ফিরিয়ে দেয়।

টিকটিকির চলন খেয়াল করেছেন কি না, দেয়াল বেয়ে ওপরে উঠতে পারে এমনকি ছাদ থেকে উল্টো হয়ে ঝুলেও চলতে পারে। এই অসম্ভব সম্ভবের পেছনে আছে ন্যানোর হাত। টিকটিকির পা বিশেষ ধরনের ন্যানো ফাইবার দিয়ে গঠিত। এর সাহায্যে বিশেষ প্রক্রিয়ায় দেয়াল বেয়ে উঠতে পারে এবং ছাদ থেকে ঝুলে ঝুলে হাঁটতে পারে। বিজ্ঞানীরা টিকটিকির এই বৈশিষ্ট্যের মতো করে নিজেরা কিছু করে মানবজাতির জন্য দারুণ কিছু করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

ন্যানো প্রযুক্তির এ রকম অনেক কিছু আছে, যাদের সঙ্গে আমরা প্রতিনিয়তই বাস করছি কিন্তু অনুভব করতে পারি না তাদের ন্যানো বৈশিষ্ট্য।

লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজ

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, সিসিউইক