রোবোটিক হাতের রূপকার

সম্পূর্ণ রোবট নয়, রোবটের অঙ্গ দিয়ে গড়া মানুষ। সাইবর্গ বলে অনেকে। কল্পবিজ্ঞানের জগতে তুমুল জনপ্রিয় চরিত্র। কিন্তু সেগুলো ভবিষ্যৎ পৃথিবীর মানুষ হিসেবে দেখানো হয়েছে ঘুরেফিরে। সত্যিকারের সাইবর্গ না হলেও রোবোটিক অঙ্গ নিয়ে চলাফেরা করছেন বিশ্বজুড়ে বহু মানুষ। হয়তো দুর্ঘটনায় কেউ হাত হারিয়েছেন, কারও পা পড়েছে কাটা। পর্যাপ্ত অর্থ থাকলে তাঁরা সহজেই কৃত্রিম অঙ্গ তৈরি করে নিয়ে অনেকটা স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারেন। তবে এসব ক্ষেত্রে বিদেশ থেকেই এত দিন কৃত্রিম অঙ্গ বানিয়ে আনতে হতো। এখন দিন বদলাচ্ছে।

চট্টগ্রামের তরুণ উদ্যোক্তা জয় বড়ুয়া তৈরি করছেন রোবোটিক হাত। রোবোটিক এ হাতগুলোর ওপরে সিলিকন গ্লাভস লাগিয়ে দেওয়ার ফলে তা মানুষের হাতের মতোই দেখা যায়। কাজও করছে দারুণ। ভয়েস কন্ট্রোল, অটো কন্ট্রোল, নার্ভ কন্ট্রোল ও লেগ কন্ট্রোল—চার ধরনের রোবোটিক হাত তৈরি করেছেন তিনি। এর মধ্যে কোনো হাত মস্তিষ্কের সংকেতে, কোনোটি কণ্ঠস্বরের কিংবা পায়ের সঙ্গে লাগানো ডিভাইসের মাধ্যমেও নাড়াচাড়া করা যায়। যিনি যেটাতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন, তিনি সে অনুযায়ী হাত বানিয়ে নিতে পারবেন।

তার মানে এই নয়, সুস্থ হাতের মতো হুবহু ব্যবহার করতে পারবেন এই হাত। এর ব্যবহার কিছুটা সীমিত, তবু হাত হারানো ব্যক্তির কাছে এটা পরিণত হতে পারে মহার্ঘ বস্তুতে। এই হাতের সাহায্যে প্রায় এক কেজি ওজনের কোনো বস্তু তোলা সম্ভব। শুধু দুর্ঘটনায় হাত হারানো ব্যক্তিরাই নয়, এর সাহায্যে জন্ম থেকে হাতহীন মানুষও হাতের কাজ করতে পারবেন।

জয় বড়ুয়ার রোবোটিক হাত এখন পর্যন্ত দেশের ছয়জন ব্যবহার করছেন। তাঁদের প্রত্যেকেই কৃত্রিম এ হাত নিয়ে খুশি। এ হাত তৈরি হয় রোবোটিক যন্ত্রপাতি দিয়ে। তবে সেটা যেন শুধু রোবটের মতোই দেখতে না হয়, সে জন্য নিয়েছেন বিশেষ ব্যবস্থা। মূল রোবোটিক হাত মুড়িয়ে দেওয়া যায় সিলিকনের গ্লাভস দিয়ে। সেটা দেখতে আসল হাতের মতো। তাই আসল হাতের মতো আকৃতি নেয় জয়ের এই কৃত্রিম হাত। এ পর্যন্ত ছয়জনের জন্য কৃত্রিম হাত তৈরি করেছেন তিনি। তাঁদের প্রত্যেকেই ইতিবাচক কথা বলেছেন কৃত্রিম এ হাত সম্পর্কে। তুরস্ক থেকেও পেয়েছেন কৃত্রিম হাত তৈরির ফরমাশ। এই হাত দিয়ে একজন ব্যক্তি দিনে সাত-আট ঘণ্টা কাজ করেন। প্রতিটি হাত তৈরি করতে ৩০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা খরচ হয় বলে জানিয়েছেন জয় বড়ুয়া। অন্যদিকে বিদেশি কৃত্রিম হাত প্রতিস্থাপন করতে ৫ থেকে ৮ লাখ টাকা খরচ হয়।

রোবোটিক হাতের উদ্যোক্তা জয় বড়ুয়া পড়াশোনা করেছেন চট্টগ্রামের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে, ইলেকট্রনিকসে। ছোটবেলা থেকেই রোবটের নেশা। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে পেয়েছেন একাধিক পুরস্কার। শুরু হয়েছিল ২০১৯ সালে। ওই বছর বাংলাদেশ রোবট অলিম্পিয়াডে অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু নানা জটিলতায় শেষমেশ মূল পর্বে অংশ নিতে পারেননি। একই বছর নাসা স্পেস অ্যাপ চ্যালেঞ্জে চট্টগ্রাম থেকে প্রথম স্থান অর্জন করে জয় বড়ুয়া ও তাঁর দল। চ্যানেল আইয়ের ‘এসো রোবট বানাই’ টিভি শোতে অ্যাগ্রিকালচার রাউন্ড থেকে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন। ইলেকট্রনিকস সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের উদ্যোগে ‘আবিষ্কারের খোঁজে’ নামের প্রতিযোগিতাতেও প্রথম রানারআপের পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি। জয় বড়ুয়ার বাড়ি চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে। নিজের ছোট্ট একটা রোবোটিকস ল্যাব। শুধু রোবোটিক হাত নয়, হোম ক্লিনিং রোবট, উভচর রোবট, রোবোটিক থার্ড হ্যান্ড, ওয়্যারলেস হ্যান্ড, হেড মেসেজ ডিভাইস, এলিন ওয়ান ফিউচার কার, রোপ ক্যামেরা, ওয়্যারলেস ক্যামেরা, কথা বলা রোবটসহ আরও নানা কিছু নিয়ে কাজ করছেন এই তরুণ। কয়েক বছর আগের একটি ঘটনায় তাঁকে রোবোটিক হাত তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করে। এক লোক বৈদ্যুতিক শক পান। ফলে তাঁর এক হাত কাটা পড়ে। সেই লোক এরপর থেকে হাত লুকিয়ে চলাফেরা করতেন। তখন জয়ের মনে হয় কম দামে যদি কৃত্রিম হাতের ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে এ ধরনের ব্যক্তিকে আর হাত লুকিয়ে চলতে হবে না। এ ঘটনার পর থেকেই জয় কৃত্রিম হাত তৈরি করেন।

কয়েক বছর আগে বৈদ্যুতিক শক লেগে এক ব্যক্তির হাত কেটে ফেলতে হয়েছিল। তিনি তা নিয়ে খুব সংকোচে থাকতেন। তিনি হাত ঢেকে চলাফেরা করতেন। তাই দেখে জয় বড়ুয়ার মাথায় এসেছিল রোবোটিক হাত তৈরির চিন্তা। চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে ২০২০ সালে নিজেই কাজ শুরু করেন। গত বছরের শুরুতে পরীক্ষামূলকভাবে বান্দরবানের এক ব্যক্তিকে এ হাত দেন। ফেসবুকে ওই হাতের ভিডিও ভাইরাল হয়। পরে সরকারের তথ্য ও প্রযুক্তি বিভাগ থেকে জয় বড়ুয়া উদ্ভাবনী কাজের জন্য দুই লাখ টাকা পান।

নিজের এই উদ্যোগ সামনে এগিয়ে নিতে জয় গড়ে তুলেছেন ‘রোবোলাইফ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। সেটি ঢাকা থেকে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সেখানে সদস্য হিসেবে রয়েছেন জয়ের বড় ভাই বাবলু বড়ুয়া। দলের অন্য সদস্যরা ভার্চ্যুয়ালি কাজ করছেন। পৃষ্ঠপোষকতা পেলে কম খরচে আরও উন্নত রোবোটিক হাত তৈরি সম্ভব বলে মনে করেন জয়।

লেখক: সাংবাদিক