সিটি স্ক্যানের আদ্যোপান্ত

বিংশ শতাব্দীর পদার্থবিজ্ঞানের যে উদ্ভাবনগুলি রোগনির্ণয় ও চিকিৎসায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে কম্পিউটেড টমোগ্রাফি বা সিটি স্ক্যান এগুলোর অন্যতম। ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসে ব্রিটিশ ইনস্টিটিউট অব রেডিওলজির বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনে ব্রিটিশ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়র গডফ্রে হাউন্সফিল্ড সম্পূর্ণ নতুন পদ্ধতিতে ত্রিমাত্রিক এক্স রে ইমেজ তৈরি করার প্রক্রিয়া উদ্ভাবনের ঘোষণা দেন। তিনি নিজের উদ্ভাবিত পদ্ধতির নাম দিয়েছিলেন কম্পিউটারাইজড অ্যাক্সিয়েল ট্রান্সভার্স স্ক্যানিং বা ক্যাট স্ক্যানিং।

এক্স-রের মাধ্যমে মানুষের শরীরের ভেতরের যেসব ছবি তোলা হয়, সেগুলি সব দ্বিমাত্রিক। তাতে শরীরের ত্রিমাত্রিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের একটা সামগ্রিক দ্বিমাত্রিক চিত্র পাওয়া যায়, তবে তা সম্পূর্ণ চিত্র নয়। যেমন একজন রোগীর ফুসফুসের এক্স-রে দেখে ডাক্তার বুঝতে পারেন সেখানে কোন অস্বাভাবিকতা রয়েছে কি না। কিন্তু ফুসফুসের ঠিক কোন গভীরতায় অস্বাভাবিকতা আছে, তা একটিমাত্র চিত্র থেকে বোঝা যায় না। যেমন একটা বইয়ের শুধুমাত্র প্রচ্ছদের ছবি দেখে বোঝার উপায় নেই বইটি কত মোটা।

হাউন্সফিল্ড যে পদ্ধতিতে এক্স-রে চিত্র তৈরি করলেন, তা প্রচলিত এক্স-রে চিত্রের চেয়ে আলাদা। প্রচলিত পদ্ধতিতে রোগীর একটি এক্স-রে তৈরির জন্য একদিক থেকে এক্স-রে প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু সিটিতে রোগীর চারদিক থেকে এক্স-রে প্রয়োগ করে অনেকগুলি ছবি একসাথে তোলে, সেই ছবিগুলো থেকে কম্পিউটারের মাধ্যমে ত্রিমাত্রিক ছবি তৈরি করা হয়। কম্পিউটার প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে এই প্রযুক্তি সরাসরি যুক্ত। তাই এই প্রযুক্তির নাম কম্পিউটেড টমোগ্রাফি। গ্রিক শব্দ ‘টমোস’ অর্থ স্লাইস বা ফালি। এই পদ্ধতিতে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে এক্স-রের মাধ্যমে ফালি ফালি করে দেখা হয়। তারপর সবগুলি ফালির ছবি এক সাথে জোড়া দিয়ে ত্রিমাত্রিক ছবি তৈরি করা হয়।

পুরো প্রক্রিয়াটিতে খুবই উচ্চমাত্রার জটিল গাণিতিক সমীকরণ ব্যবহার করা হয়। কম্পিউটারের সফটওয়ার খুব সহজেই এই জটিল গণিতের সমাধান করতে পারে। কম্পিউটারের মাধ্যমে সবকিছু করা হয় বলে এই পদ্ধতির বেশ কয়েকটি নাম আছে। যেমন কম্পিউটারাইজড অ্যাক্সিয়েল টমোগ্রাফি বা ক্যাট, কম্পিউটারাইজড টমোগ্রাফি, কিংবা কম্পিউটেড টমোগ্রাফি। বর্তমানে সার্বিকভাবে কম্পিউটেড টমোগ্রাফি বা সিটি নামটাই ব্যবহৃত হয়।

টমোগ্রাফিক পদ্ধতি হঠাৎ করে একদিনে উদ্ভাবিত হয়নি। হাউন্সফিল্ডের উদ্ভাবনের পঞ্চাশ বছরেরও বেশি আগে ১৯১৭ সালে অস্ট্রিয়ান গণিতবিদ ইয়োহান র‍্যাডন প্রমাণ করেন যে দ্বিমাত্রিক বা ত্রিমাত্রিক কোন বস্তুর অসীম সংখ্যক প্রজেকশান (বা ফালি) থেকে গাণিতিকভাবে বস্তুটিকে পুনর্নির্মাণ করা যায়। পদার্থবিজ্ঞানীদের অনেকেই নিজের নিজের ক্ষেত্রে এই পুনর্নির্মাণের প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন বছরের পর বছর। অস্ট্রেলিয়ান পদার্থবিজ্ঞানী রোনাল্ড ব্রেসওয়েল বেতার-জ্যোতির্বিজ্ঞানে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে ১৯৫৬ সালে একটি সৌরম্যাপ তৈরি করেছিলেন। ১৯৬১ সালে নরম টিস্যুর ত্রিমাত্রিক ইমেজিংয়ের মডেল তৈরি করেছিলেন মার্কিন নিউরোলজিস্ট উইলিয়াম হেনরি ওলডেনডর্ফ। ১৯৬৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকান-মার্কিন পদার্থবিজ্ঞানী অ্যালান কোরম্যাক টমোগ্রাফির তত্ত্ব এবং ইমেজিংয়ের জন্য দরকারি গাণিতিক পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। তাঁর এই তত্ত্ব এবং গাণিতিক পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে গডফ্রে হাউন্সফিল্ড উদ্ভাবন করেন কম্পিউটেড টমোগ্রাফি। সিটি উদ্ভাবনের জন্য গডফ্রে হাউন্সফিল্ড ও অ্যালান কোরম্যাক যৌথভাবে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান ১৯৭৯ সালে।

এক্স-রে রেডিওগ্রাফির সাথে সিটির আরেকটি প্রধান পার্থক্য হলো সিটির হাউন্সফিল্ড নাম্বার বা সিটি নাম্বার। শরীরের রক্ত, চর্বি, পেশী, ফুসফুস ইত্যাদির ঘনত্ব খুবই কাছাকাছি। এগুলি প্রায় একই পরিমাণ এক্স-রে শোষণ করে এবং তাই এক্স-রে রেডিওগ্রাফ দেখে এদেরকে পরস্পর থেকে আলাদা করা যায় না। তাই রোগীর শরীরে কোনো অস্বাভাবিকতা থাকলে তা আসলে কোন জায়গায় তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। এই সমস্যার সমাধানে হাউন্সফিল্ড সিটি নাম্বার প্রচলন করলেন, যেখানে তিনি শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ঘনত্বের একটা তুলনামূলক নাম্বার দিয়েছেন পানির সাথে তুলনা করে। পানির সিটি নম্বর ধরা হলো শূন্য। পানির চেয়ে ঘনত্ব যাদের যত বেশি তাদের নম্বর হবে ততো বেশি পজিটিভ নাম্বার। যেমন, টিউমার +৫ থেকে +৩৫, মাংসপেশী +৫০, শক্ত হাড় +১০০০। আবার যাদের ঘনত্ব পানির ঘনত্বের চেয়ে যত কম তাদের নম্বর হবে ততো নেগেটিভ নাম্বার। যেমন, বাতাস -১০০০, ফুসফুস -১৫০ থেকে -৪০০, চর্বি -১০০। সিটি ইমেজ পুনর্নির্মাণের সময় সুনির্দিষ্ট সিটি নাম্বারের প্রয়োগ করা হয়, ফলে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের প্রতিটি উপাদান স্পষ্টভাবে দেখা যায়।

উদ্ভাবনের পর থেকে কম্পিউটার প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে সিটি সিস্টেমও অনেক উন্নত হয়েছে। ১৯৭৩ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে সপ্তম প্রজন্মের সিটি মেশিন উদ্ভাবিত হয়ে গেছে। এখন এই অত্যাধুনিক সিটি মেশিনের সাহায্যে কিছু কিছু জটিল রোগনির্ণয় অনেক সহজ হয়ে গেছে। ক্যানসার টিউমার শনাক্তকরণ ছাড়াও টিউমারের আকার, আকৃতি ও অবস্থান নির্ণয় করে রেডিওথেরাপির ট্রিটমেন্ট প্ল্যান তৈরি করার জন্য রোগীর সিটি স্ক্যান করা হয়।

সিটি স্ক্যানারে এক্স-রে টিউব থেকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এক্স-রে তৈরি হয়। কিন্তু এক্স-রে টিউবটি একটি বৃত্তাকার পথে ৩৬০ ডিগ্রি কোণে ঘুরতে পারে। বৃত্তাকার পথে অনেকগুলি ডিজিটাল ডিটেক্টর লাগানো থাকে। এক্স-রে টিউবের যে কোন অবস্থান থেকেই এই ডিজিটাল ডিটেক্টরগুলি এক্স-রে ডিটেক্ট করতে পারে। সিটি স্ক্যান করার সময় রোগীকে যে বিছানায় শোয়ানো হয়, সেই বেডটিসহ রোগীকে সিটি মেশিনের মাঝখানের বড় বৃত্তাকার পথে ঢুকিয়ে দেয়া যায়। তারপর পরিকল্পনা অনুযায়ী এক্স-রে প্রয়োগ করা হয়। এক্স-রে টিউব রোগীর চারপাশে বৃত্তাকার পথে ঘুরতে ঘুরতে রোগীর শরীরে এক্স-রে প্রয়োগ করে। এই এক্স-রে রোগীর শরীর ভেদ করে বিপরীত দিকের ডিটেক্টরে গিয়ে পড়ে। ডিটেক্টর এক্স-রে থেকে রোগীর শরীরের উপাদানের তথ্য আলাদা করে কম্পিউটারের সফটওয়ারে পাঠায় প্রসেসিংয়ের জন্য। রোগীর চারপাশের সবগুলি ডিটেক্টরের পাঠানো তথ্য থেকে কম্পিউটার ত্রিমাত্রিক ছবি তৈরি করে। সবগুলি প্রজেকশান একের পর এক যোগ করে এক সাথে ভিডিও ফরম্যাটে উপস্থাপন করা হয় রোগীর সিটি রিপোর্ট।

সিটি স্ক্যানিংয়ে রোগীর শরীরে জেনারেল রেডিওগ্রাফির চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে রেডিয়েশন প্রবেশ করে। বিজ্ঞানীরা প্রমাণ পেয়েছেন, সিটি স্ক্যানিং থেকে যে রেডিয়েশন শরীরে প্রবেশ করে তা শরীরে ক্যানসারের সম্ভাবনা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। তাই খুব বেশি দরকার না হলে সিটি স্ক্যান করার পরামর্শ দেয়া উচিত নয়।