আইনস্টাইন, আপেক্ষিকতা এবং মহাবিশ্বের রহস্য

মহাবিশ্বকে দেখার জন্য মানবজাতির চক্ষু উন্মীলন করে দিয়েছিলেন আলবার্ট আইনস্টাইন। আইনস্টাইনের মানসক্ষেত্র আমাদের মহাবিশ্বের স্থান ও কালকে পুনরাবিষ্কার করেছিল। সেই সাথে আমাদের জানিয়েছিল, এই মহাবিশ্ব এতোটাই বিশাল ও অভাবনীয় যে তা আমাদের কল্পনার জগৎকেও হার মানায়। সুইস পেটেন্ট অফিসে কর্মরত এক কেরানির মাথা থেকে ১৯০৫ সলে যে প্রাথমিক ধারণাটির জন্ম হয়েছিল, পরবর্তীতে তা বার্লিনে এসে পরিণত রূপ লাভ করে মহাবিশ্বের একটি নতুন বৈপ্লবিক ধারণার মাঝে। এটি মূলত মহাকর্ষ শক্তিকে গভীরভাবে বুঝে উঠতে পারার ফলেই সম্ভব হয়েছে। মহাকর্ষকে সঠিকভাবে বুঝে উঠার এই কাজটি করেছিলেন আইনস্টাইন। তাঁর আপেক্ষিকতার সাধারণ সূত্রের মাধ্যমে। এর ফলে আমাদের জানা জগৎটি এতোটাই বদলে গেল যে, ১৯৩৯ সালে লণ্ডনে অনুষ্ঠিত আইনস্টাইনের এক সংবর্ধনা সভায় বার্নাড শ বলেছিলেন, ‘টলেমি একটি জগৎ তৈরি করেছিলেন, যা টিকে ছিল প্রায় ১৪০০ বছর। এরপর নিউটন আর একটি জগৎ তৈরি করলেন, যা টিকে রইল ৩০০ বছর। আর এখন আইস্টাইন এসে নতুন একটি জগৎ তৈরি করেছেন, যা কতে বছর টিকে থাকবে তা আমরা কেউ জানি না।’

স্থান ও কাল সম্পর্কে নিউটনের চিরায়ত ধারণাকে বদলিয়ে আইনস্টাইন যে ধারণাটি প্রণয়ন করলেন, তাতে পদার্থের ভর ও শক্তি তাকে পরিবর্ত করতে সক্ষম—যেমনটা হচ্ছে একটি টান টান চাদরের উপর একটি ভারী ধাতব বল রেখে দিলে যেমনটা হবে। সহজভাবে বলতে গেলে এভাবেই মহাকর্ষকে ব্যাখ্যা করা হলো। বার্লিনে ১৯১৫ সালের শেষদিকে আইনস্টাইন তাঁর এই আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব প্রকাশ করলেন। অবশ্য ১৯১৯ সালে আর্থার এডিংটনের বিখ্যাত পরীক্ষাটি (যাতে সূর্যগ্রহণ চলাকালে পার্শ্ববর্তী তারাদের আলোকবিচ্যুতি পরীক্ষা করা হয়) করার আগে পর্যন্ত কেউই এটিকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। এডিংটনের পরীক্ষাটি আইনস্টাইনকৃত ভবিষ্যৎবানীকে সঠিকভাবেই প্রমাণ করে। ‘স্বর্গের আলোও বিচ্যুত হয়, বিজ্ঞান জগতের মানুষ উত্তেজিত’—এমনই একটি শিরোনাম করেছিল নিউইয়র্ক টাইমসটাইমস অব লন্ডন শিরোনাম করেছিল, ‘বিজ্ঞানে বিপ্লব; মহাবিশ্বের নতুন তত্ত্ব—নিউটনের আইডিয়াকে ছুড়ে ফেলা হয়েছে।’ আর সূর্যগ্রহণ চলাকালে আলোকবিচ্যুতি পরীক্ষার দলনেতা রাদারফোর্ড একটি লিমেরিক লিখে তার পরীক্ষার সাফল্যকে উদযাপন করেছিলেন—

জ্ঞানীরা থাকুক ব্যস্ত আমাদের উপাত্ত বিশ্লেষণে

একটি সত্য অন্তত জেনে গেছি মোরা—আলোর রয়েছে ভার,

আর কিছু নিয়ে তর্ক হলেও দ্বিমত নেই আর এই জ্ঞানে

সূর্যের কাছে এলে আলোকরশ্মি সরলপথে চলে না আর।

এই ঘটনার এক দশক পরও সায়েন্স নিউজ লেটার্স শিরোনাম করেছিল—‘আইনস্টাইনের তত্ত্ব বোঝার জন্য দাঙ্গা’। এর পেছনের ঘটনাটি হচ্ছে, নিউইয়র্ক সিটির আমেরিকান মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রিতে আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব আলোচনা করতে এক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল। তাতে যোগদান করতে আসা ৪,৫০০ লোক প্রবেশপথে উশৃংখল হয়ে উঠলে তাদের নিরস্ত করতে শেষ পর্যন্ত দাঙ্গাপুলিশ ডাকতে হয়েছিল। হলঘরটিতে আসনসংখ্যা ছিল মাত্র দেড় হাজার। কিন্তু সে সম্মেলনে যোগ দিতে আসা মানুষ ছিল তার তিন গুণ। ফলে সম্মেলন কক্ষের প্রবেশপথে শুরু হয় শক্তিপ্রয়োগ। পত্রিকাটি অবশ্য বিস্ময় প্রকাশ করেছিল যে, এ ধরনের দাঙ্গা আমরা সাধারণত দেখি মুষ্টিযুদ্ধ, বেসবল, সার্কাসে যোগদানে ইচ্ছুক দর্শকদের মধ্যে। কিন্তু আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব বুঝতে ইচ্ছুক দর্শকদের মধ্যে এরকম দাঙ্গা সত্যি অভাবনীয়।

যাহোক, মূল প্রসঙ্গটিতে আবার ফিরে আসা যাক। প্রথম মার্কিন হিসেবে বিজ্ঞানে যিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, সেই পদার্থবিজ্ঞানী আলবার্ট মাইকেলসন ১৯৩১ সালে আপেক্ষিকতা তত্ত্ব সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘বিজ্ঞানের ইতিহাসে এটি একটি বৈপ্লবিক চিন্তা।’ তবে নানা মহল থেকে যতোই অভিনন্দন লাভ করুন না কেন, আইনস্টাইন নিজে ছিলেন এ বিষয়ে ‘নিরাসক্ত ভবিষ্যৎবক্তা’। আমরা এখন জানি, আইনস্টাইন নিজে তাঁর তত্ত্ব সম্পর্কে যতটা আশাবাদী হতে পেরেছিলেন, তিনি তার চেয়ে অনেক বেশি সাধুবাদ লাভ করেছেন।

আমরা যে মহাবিশ্বকে এতোদিন শান্ত, স্থির, সসীম জায়গা বলে জানতাম, পরে দেখা গেল যে তা একটি গতিশীল, ক্রম প্রসারমান রঙ্গমঞ্চ। সেখানে চলছে স্থান-কালকে দোমড়ানো-মোচড়ানো ‘পাশব’ দাঙ্গা-হাঙ্গামা। ছায়াপথ বা নীহারিকাগুলো সুপারক্লাস্টার হিসেবে এমনভাবে সমবেত, যে তাদের বিশালাকৃতি সম্পর্কে বিশ শতকের আগে আমাদের কোনো ধারণাই ছিল না। এই ছায়াপথগুলোর মধ্যে শুধু যে গ্রহ-তারকা রয়েছে তাই নয়, রয়েছে আরও কিছু অদ্ভুত বস্তু। যেমন নিউট্রন তারকা, যা একটি তারকার আয়তনকে শেষ পর্যন্ত নিয়ে আসে একটি শহরের আয়তনে। তাতে আরো রয়েছে কৃষ্ণবিবর, যার আকর্ষণ থেকে এমনকি আলো পর্যন্ত বের হয়ে আসতে পারে না। আর যখনই এ সমস্ত বস্তুপুঞ্জ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে, তারা স্থান-কালের বুকে কম্পন তুলে এবং নির্গত করে ধারণাতীত পরিমাণ শক্তি। কাজেই আমাদের মহাবিশ্ব শান্ত-শিষ্ট, গোবেচোরা কিছু নয়, বরং তা ভয়ানক রকম অস্থির, অশান্ত একটি রঙ্গমঞ্চ। বিজ্ঞান কল্পকাহিনীতে বর্ণিত গল্পের মতো এরকম একটি মহাবিশ্বকে আমরা বুঝতে পেরেছি সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বকে ব্যবহার করেই।

তবে মহাবিশ্বের অনেক কিছুই খুব সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করলেও বর্তমান মহাবিশ্বের সবকিছুই যে তা ব্যাখ্যা করতে পারছে, তা বোধহয় সঠিক নয়। মহাবিশ্বের উৎপত্তি লগ্ন, তার অন্তিম লগ্ন, রহস্যজনক কৃষ্ণবস্তু এবং শক্তি ইত্যাদির অনেক কিছুই এখনো পুরোপুরি আমরা রহস্যের জটমুক্ত করতে পারিনি। সেই সঙ্গে বৃহৎ মহাকর্ষের জগতের সঙ্গে ক্ষুদ্র কোয়ান্টাম জগতের সম্পর্কটিও এখন পর্যন্ত অনুদ্ঘটিত।

২.

সাধারণ আপেক্ষিকতা সম্বন্ধে বলতে গিয়ে ইয়েল বিশ্বব্যিালয়ের প্রিয়ম্বদা নটরাজন বলেছেন, এটি আমাদের মহাবিশ্ব সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রসারিত করেছে এবং মহাবিশ্বের দিকে আমাদের ফেরানো দৃষ্টিকে আরো সূক্ষ্ম করেছে। এখন আমরা আমাদের আরো উন্নত পরীক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে আরও সূক্ষ্মভাবে সাধারণ আপেক্ষিকতাকে অনুভব করতে পারি। আইনস্টাইন যখন সাধারণ আপেক্ষিকতার সূত্র উত্থাপন করেছিলেন, তার শত বছর পর বিজ্ঞানীরা তেমনই একটি দাবির সত্যতা দেখতে পেয়েছেন ২০১৯ সালে। বিশ্বব্যাপী দূরবিনের নেটওয়ার্ক থেকে বিজ্ঞানীরা একটি কৃষ্ণবিবরের ছবি পেয়েছেন, যা এম-৮৭ নামক ছায়াপথটির কেন্দ্রে অবস্থিত। এটিই কৃষ্ণগহ্বর বা কৃষ্ণবিবরে প্রথম তোলা ছবি।

কৃষ্ণবিবরের ইতিহাসটিকে একটু নতুন করে দেখা যাক। প্রুশিয়ান একাডেমি অব সায়েন্সের কাছে ১৯১৫ সালে আইনস্টাইন তার আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব সংক্রান্ত নিবন্ধনগুলো জমা দেওয়ার কয়েক সপ্তাহ পরেই প্রথম মহাযুদ্ধে রুশ ফ্রন্ট থেকে একজন জার্মান সেনা ও জ্যোতির্বিদ কার্ল শোয়ার্জশিল্ড কৃষ্ণবিবরের স্বপক্ষে প্রথম গাণিতিক প্রমাণ হাজির করেন। তিনি অবশ্য বিষয়টি নিয়ে আর বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেননি। কারণ এর কয়েকমাসের মধ্যেই তিনি মারাত্মক চর্মরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।

এরপর ১৯৩০ সালে জে রবার্ট ওপেনহাইমার এবং হার্টল্যান্ড স্নাইডার হিসেব করে বের করলেন, একটি নির্দিষ্ট আয়তনের (যাকে এখন শোয়ার্জশিল্ড ব্যাসার্ধ বলে ডাকা হয়) তারকা সংকুচিত হলে তার আকর্ষণে এমনকি আলোও আটকে পড়ে থাকবে। এরকম একটি বস্তুকেই পরে আখ্যা দেওয়া হলো কৃষ্ণবিবর বলে। অবশ্য আইনষ্টাইনসহ আরো বেশকিছু পদার্থবিদ এই যুক্তির বাস্তবতা নিয়ে সন্দিহান ছিলেন।

এরপর কৃষ্ণবিবর নিয়ে নতুন করে আগ্রহ তৈরি হয় বিশ শতকের ষাটের দশকে। কৃষ্ণবিবর কথাটি প্রথম ব্যবহার হয় সম্ভবত সায়েন্স নিউজ লেটার নামক সাময়িকীটিতে। এতে ১৯৬৪ সালে এ্যান ইউয়িং একটি প্রতিবেদন লিখেছিলেন আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন ফর অ্যাডভান্সমেট অব সায়েন্স-এর একটি সভা সম্পর্কে। এর কয়েকমাস পর এই ইউয়িং-ই আবার একই সাময়িকীতে রিপোর্ট করেন কোয়াসার আবিষ্কৃত হওয়ার খবর। যাতে লেখা হয়েছিল— ‘সবচেয়ে দূরবর্তী, সবচেয়ে উজ্জ্বল, সবচেয়ে অস্থির চিত্ত, ওজনদার এবং ধাঁধায় ফেলা আলোক ও বেতার তরঙ্গ।’ যদিও এটিকে তখন কৃষ্ণবিবর হিসেবে শনাক্ত করা হয়নি, কিন্তু তা একটি অপরিমেয় শক্তির জন্মদাতা মহাবৈশ্বিক শক্তিকেন্দ্র (Cosmic Powerhouse) বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল।

এরপর ষাটের দশকেই জ্যোতির্বিদ্যায় এক্সরের ব্যবহার মহাবিশ্বের নতুন কিছু বৈশিষ্ট চিহ্নিত করে, যাকে কোনো সহযোগী তারকার সঙ্গে জুড়ে থাকা কৃষ্ণবিবর বলে মনে করা হয়। একইভাবে ছায়াপথগুলোর কেন্দ্রে গ্যাসমেঘের ও তারাদের গতি থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ওখানে খুবই ঘনত্বসম্পন্ন কিছু একটার উপস্থিতি রয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বড় যেটি, তার স্তর আমাদের সূর্যস্তরের অনেক বিলিয়নগুণ বেশি এবং তা একটি তারকাকে গিলে ফেলে ২০০ ট্রিলিয়ন ইলেক্ট্রন ভোল্ট শক্তি উৎপাদন করতে পারে। এই শক্তির পরিমাণ আমাদের বর্তমান লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার (LHC) নামক সবচেযে শক্তিশালী কণাত্বরক থেকেও ৩০ গুণ বেশি।

গত শতকের নব্বইরে দশক থেকেই জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেন যে, হিংস্র, বিশালাকায় জন্তুর মতো এমন কৃষ্ণবিবরের শুধু যে অস্তিত্ব রয়েছে, তাই নয়, সেগুলো মহাবিশ্বের গড়ন বা কাঠামোকে ভিন্নরূপ দিতেও ভূমিকা রাখে। ‘একসময়ে সাধারণ আপেক্ষিতা তত্ত্ব ভবিষ্যদ্বানী করেছিল, যা ছিল গাণিতিক অনুসন্ধিৎসার বস্তু—তা-ই এক সময়ে হয়ে দাঁড়াল বাস্তব এবং সেগুলোর অবস্থান ছায়াপথের কেন্দ্রে। আমরা জানি যে, বিশালাকৃতি কৃষ্ণবিবরগুলো অধিকাংশ ছায়াপথগুলোর কেন্দ্রে অবস্থান করছে, যেখানে তাদের শক্তি তারকাদের গঠনে ভূমিকা রাখে। ছায়াপথের কেন্দ্রের সবকিছু তাদের দিয়েই নিয়ন্ত্রিত হয়।’— এমনটা বলেছেন প্রিয়ম্বদা নটরাজন।

৩.

সরাসরি চোখে দেখা কৃষ্ণবিবর অতি সাম্প্রতিক ঘটনা হলেও তার ধারণা শতাব্দীপ্রাচীন। প্রকৃত কৃষ্ণবিবরের বাস্তবতা আমাদেরকে অনেক কিছুতেই সাহাঘ্য করে। তা আমাদের মহাবিশ্বকে ব্যাখ্যা করতে যেমন প্রয়োজন, তেমনি তাকে নিয়ে অনেক কিছু কল্পবিজ্ঞান কাহিনীগুলোতেও দেখা যায়। যেমনটা রয়েছে ইন্টারস্টেলার-এর মতো হলিউড ব্লকবাস্টার সিনেমাগুলোতে। ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ নিকোলাস ইউনেস বলেছেন, ‘এ সমস্ত বস্তুপুঞ্জ কতোটা বৃহৎ, কতোটা ভারী, কতটা ঘন- তা চিন্তা করাটাই আমাদের জন্য শ্বাসরোধী। এই বস্তুগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ হলে মহাবিশ্বের স্থান-কাল নামক চাদরটি ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। এর ফলে যে মহাকর্ষ তরঙ্গ (Gravitational wave) তৈরি হয়, তা বাইরের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। আর তার প্রচণ্ড শক্তিশালীও বিশৃংখলাপূর্ণ উপস্থিতি চোখে পড়ে।

আইনস্টাইনের গণিত এরকম তরঙ্গের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল, যা দীর্ঘদিন যাবত শুধু পদার্থবিদদের কাছে স্বপ্ন হয়েই ছিল। জার্মান ভাষায় এ তরঙ্গকে গ্রাভিটেশনস্যুলেন (Gravitation swellen) বলে ডাকতেন আইনস্টাইন। কিন্তু তিনিও এদের অস্তিত্ব সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলেন না। মহাকর্ষ তরঙ্গ বলে সত্যিই কিছু রয়েছে কিনা, তা নিয়ে পঞ্চাশের দশকেও বিজ্ঞানীমহলে বিতর্ক চলছিল। অন্ততপক্ষে একজন পদার্থবিদ জোসেফ ওয়েবার এই মহাকর্ষ তরঙ্গ আবিষ্কার করতে গিয়েই পদার্থবিজ্ঞনী হিসেবে তার ভবিষ্যৎ নষ্ট করেছেন। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চেষ্টার পর অবশেষে ১৯৬৯ সনে তিনি এমন একটি সংকেত শনাক্ত করেন, যা সম্ভবত ছিল সুপারনোভা বা পালসার তারকা। পরবর্তী কয়েক বছরে এরকম আরো কিছু ঘটনা দেখা যায়, যাকে নাম দেওয়া হয় ‘ওয়েবার সমস্যা’ বলে। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরও নিশ্চিত হওয়া যায়নি বলে সায়েন্স নিউজ শিরোনাম করে: ‘ওয়েবারের তরঙ্গ নিয়ে সন্দেহ ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে।’

ওয়েবার তাঁর দাবি ২০০০ সালে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত অব্যাহত রাখেন, যদিও তা নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়নি। তবে বিজ্ঞানীমহলে আশাবাদ ক্রমাগত বাড়তে থকে যে তা অচিরেই আবিষ্কৃত এই মহাকর্ষ তরঙ্গের উপস্থিতি নিশ্চিত Laser Interferometer Gravitational-Wave Observatory বা লাইগো প্রথমবারের মতো ২০১৬ সনে। এর জন্য প্রয়োজন হয়েছিল দুটো ডিটেক্টরের একটি অবস্থিত ওয়াশিংটনের হ্যানফোর্ডে, অন্যটি লুইজিয়ানার লিভিংস্টোনে। এ আবিষ্কারের কথা ঘোষিত হওয়ার পর জ্যোতির্বিদ্যার জতে তা একটি নতুন যুগ বয়ে নিয়ে আসে। এ খবরটিকে সায়েন্স নিউজ করে ‘স্টোরি অব দি ইয়ার’। আর এ আবিষ্কার পরের বছর আবিষ্কর্তাদের জন্য নোবেল পুরস্কারের সম্মান বয়ে নিয়ে আসে।

লাইগো এবং এরকম আরো একটি বিজ্ঞানীদল VIRGO-এ দুটো প্রকল্পের বিজ্ঞানীরা মিলে একই রকম ডজনখানেক মহাকর্ষ তরঙ্গের উপস্থিতি শনাক্ত করতে পেরেছেন। এগুলোর বেশিরভাগই সম্পর্কিত বিভিন্ন কৃষ্ণবিবরের একত্রীকরণ থেকে উদ্ভুত, কয়েকটি নিউট্রন তারকা থেকেও উদ্ভুত। কৃষ্ণবিবরগুলোর আয়তন মাঝারি আকারের, ১০০ থেকে ১ লাখ গুণ সূর্যভরের সমান। এর মধ্যে নতুন একটি খবর দিয়েছেন পতুর্গালের লিসবনস্থ সুপিরিয়র টেকনিকো ইনস্টিটিউটের পদার্থবিজ্ঞানী ভিটর কার্ডোসো, যিনি মহাকর্ষ তরঙ্গের মাধ্যমে প্রমাণ পেয়েছেন যে, একটি কৃষ্ণবিবর আবর্তন করছে একটি ওয়ার্মহোলকে।

মহাকর্ষ তরঙ্গের এই নতুন জোতির্বিদ্যা সবেমাত্র শুরু হয়েছে। শীঘ্রই এর সঙ্গে সম্পর্কিত যন্ত্রপাতির উন্নতি সাধিত হলে আরো দূর ও আরো ক্ষীণ উৎস থেকে আসা মহাকর্ষ তরঙ্গও শনাক্ত করা সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে। মহাকাশে থেকে কাজ করার জন্য এরকম একটি কেন্দ্র LISA আগামী ২০৩০ সালে উৎক্ষেপণ করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে। সেটা উৎক্ষিপ্ত হলে পৃথিবীর অনাকাঙ্খিত শব্দ তরঙ্গ ও অন্যান্য দূষণ এড়ানো সমভব হবে আমরা আশাবাদী।

৪.

আইনস্টাইনের যুগ শুরু হওয়ার আগে স্থান ও কালকে ধরা হতো পরিবর্তনহীন, চিরন্তন এক সত্ত্বা- যেমনটা ছিল গ্যালিলিও এবং নিউটনের চিন্তায়। কিন্তু আইনস্টাইন এ দুটো সত্ত্বাকে একসঙ্গে মিশিয়ে করলেন স্থান-কাল। তিনি বললেন, এটি পরিবর্তিত হয় মহাকর্ষ বলের মর্জিমাফিক। অর্থাৎ মহাকর্ষ বলই মহাবিশ্বের ‘নাচের মুদ্রা’ তৈরি করে দেয়। আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব প্রকাশের একদশক আগেই আইনস্টাইন প্রণয়ন করেছিলেন আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব, যার মাধ্যমে তিনি বস্তু ও শক্তিকে এক করেছিলেন। এরপর আরো একদশক চেষ্টা করে তিনি বস্তু ও স্থান কালের রহস্য উন্মোচন করলেন। কয়ক দশক পরে খ্যাতনামা পদার্থবিদ ও প্রিন্সটনে আইনস্টাইনের জুনিয়র সহকর্মী আর্চিবন্ড হুইলার বলেছেন- ‘বস্তু আকড়ে ধরে স্থান-কালকে এবং বলে দেয় কীভাবে বাঁকতে হবে; আর স্থান-কাল পদার্থকে জড়িয়ে ধরে বলে কীভাবে চলতে হবে।’

কিন্তু আপেক্ষিকতার সাধারণ সূত্র শুধু মহাকর্ষ বলকে বোঝা নয়, এটি আমাদের অস্তিত্বেরও একটি সার্বিক ব্যাখ্যা। সাধারণ আপেক্ষিকতা মহাবিশ্বের সামগ্রিক কাঠামোরই একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করেছে। এর মাধ্যমেই আমরা জানতে পেরেছি যে মহাবিশ্ব প্রসারমান, যার মাঝে রয়েছে কৃষ্ণবিবর নামের বিশাল গর্ত এবং তা স্থানকালের বুকে মহাকর্ষ তরঙ্গ তৈরি করে। এটি প্রণয়ন করার সময় আইনস্টাইন একে যতোটা বিস্ময়কর বলে ভাবতে পেরেছিলেন, পরবর্তীতে তা তারো চেয়ে বিস্ময়কর বলে প্রমাণিত হয়েছে—এমনটাই বলেছেন তাত্ত্বিক পদার্থবিদ ও জনপ্রিয় লেখক স্টিফেন হকিং। আর এটি শুধু মহাবিশ্বের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার জন্যই নয়, আমাদের দৈনন্দিন জীবন-যাপনের জনও এ তত্ত্ব কার্যকর ভূমিকা রাখছে। যেমন এটি ছাড়া আমরা এখন গাড়ি চালাতে গিয়ে যে জিপিএস যন্ত্র ব্যবহার করি, তা একেবারেই অচল হয়ে পড়বে।

আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব প্রণয়ন করতে গিয়ে আইনস্টাইনকেও যেভাবে কার্যকর বাঁকবদল করতে হয়েছে, সে গল্পটিও চমৎকার। ১৯০৭ থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত তাঁর এই পরিশ্রমকে পদার্থবিদ আব্রাহাম পাইস বলেছেন, ‘শতাব্দীর সবচেয়ে বড় সমস্যাকে মোকাবেলা করা’। এ সময়ে আইনস্টাইনকে শিখতে হয়েছেন নতুন ধরনের গণিত (আর আইনস্টাইন নিজের মুখেই স্বীকার করেছিলেন যে, স্কুলে গণিতকে অবহেলা করায় তিনি গণিতে দুর্বল ছিলেন)। তাকে বেরিয়ে আসতে হয়েছে প্রচলিত সংস্কার থেকে, তেমন ইউক্লিডিয়ান জ্যামিতিই বাস্তবতাকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে। এর মধ্যেই তাঁকে মোকাবেলা করতে হয়েছে তাঁর ব্যক্তিজীবনের টানাপোড়েন। বেশ কয়েক বছর চেষ্টা করার পরও ১৯১৪ সাল পর্যন্ত এসে তিনি দেখলেন, প্রকৃতি কিছুতেই তাঁর কথা শুনতে চাচ্ছে না—তখন তিনি হতাশ হয়ে প্রায় হাল ছেড়ে দেন। তিনি ভাবলেন, এতে তিনি বড়জোর আংশিকভাবে সফল হয়েছেন। কিন্তু এরপর তাঁর মস্তিষ্ক আবার নতুন উদ্যম ফিরে পেল এবং তিনি দ্রুতই, ১৯১৫ সালের নভেম্বরে এ সংক্রান্ত ৪টি নিবন্ধ লিখে ফেললেন। এ চারটি প্রবন্ধের মাধ্যমেই তিনি মহাকর্ষ সংক্রান্ত তাঁর চূড়ান্ত সমীকরণটি পেয়ে যান। এর ফলে মহাকর্ষ নিয়ে তাঁর বৈপ্লবিক ধারণা বাস্তব রূপ লাভ করে। সাধারণ লোক এ সময়ে তাঁর অবদান বুঝতে না পারলেও এর চারবছর পর সূর্যগ্রহণ সংক্রান্ত আর্থার এডিংটনের বিখ্যাত পরীক্ষাটির পর থেকে সারা বিশ্বব্যাপী আইনস্টাইন হয়ে উঠেন সেলিব্রেটি।

৫.

এডিংটন তাঁর পরীক্ষাতে সূর্যগ্রহণ চলাকালে তারকার যে আলোকবিচ্যুতির প্রমাণ পেয়েছিলেন, যে আলোকবিচ্যুতির কথা অবশ্য এক শতাব্দী আগেই নিউটনিয়ান মহাকর্ষ ধারণার উপর ভিত্তি করে জোহানভন সল্ডনার হিসেব করেছিলেন। তবে আইনস্টাইনের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী এই বিচ্যুতির পরিমাণ সল্ডনারের হিসেবের চেয়ে দ্বিগুন—এডিংটনের পরীক্ষাতে হুবহু তাই প্রমাণিত হয়। এরপরে আরো অনেক পরীক্ষাই নিঃসংশয়ভাবে আইনস্টাইন তত্ত্বের যথার্থতা প্রমাণ করেছে। তাই পদার্থবিদ ব্লিফোর্ড উইল বলেছেন, ‘আপেক্ষিকতার উপর ভিত্তি করে মহাকর্ষীয় লেন্স আবিষ্কার করা হয়, গুপ্তবস্তু, গুপ্তশক্তি, বহিসৌরজাগতিক গ্রহ- ইত্যাদি আবিষ্কারের সাহায্য করেছে।’

মহাকর্ষীয় লেন্সিং প্রথম আবিষ্কৃত হয় ১৯৭১ সালে, যদিও আইনস্টাইন ১৯১২ সালেই তার অস্তিত্ব অনুমান করেছিলেন। তাঁর আপেক্ষকতার সাধারণ সূত্র সমাপ্তির মুখ দেখার আগেই। এর অনেক পরে ১৯৩৩ সালে এ সম্পর্কে তিনি একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন। নাথান রোজ ও আইনস্টাইন লিখিত এ নিবন্ধটিতে এ বিষয়ে একজন উৎসাহী, চেক বিদ্যুৎ প্রকৌশলী রুডি ম্যানভেলকে নিরস্ত করেছিলেন যে, এরকম একটি প্রতিক্রিয়া শনাক্ত করা আমাদের সাধ্যের বাইরে। অবশ্য বর্তমানে আধুনিক জ্যোতির্বিদ্যার অগ্রযাত্রা আইনস্টাইনের ধারণাকেও ছাড়িয়ে গেছে। পরে ষাটের দশকের জ্যোতির্বিদরা সাধারণ আপেক্ষিকতারই আরো এক মানসসন্তান আবিষ্কার করেন। যার নাম কৃষ্ণবিবর। সেটির অস্তিত্ব নিয়েও আইনস্টাইন কিছুটা চিন্তাভাবনা করেছিলেন বলে আমরা জানি, তবে তিনি তাতেও নিঃসন্দেহ হতে পারেননি। বিষয়টি নিয়ে নতুন করে যখন আগ্রহ শুরু হয়, আইনস্টাইন তখন আর পৃথিবীতে নেই।

আইনস্টাইন ১৯১২ সালেই টের পান যে, তাঁকে সফল হতে হলে ইউক্লিডিয়ান জ্যামিতির বাইরে গিয়ে ভাবতে হবে। কারণ মহাকর্ষ স্থান-কালকে এমনভাবে বাঁকিয়ে দেয়, যেমনটা একটি রাবার শিটের উপর একটি লোহার গোলা করে থাকে। কিন্তু এজন্য প্রয়োজনীয় বক্রতার জ্যামিতি বা রিম্যানের জ্যামিতি আইনস্টাইনের জানা ছিল না। এ সময়েই তাঁর জন্য আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেন আইনস্টাইনের কলেজ জীবনের বন্ধু, মার্সেল গ্রসম্যান। তিনি উনিশ শতকের গণিতবিদ রিম্যানের বক্র অবতলের জ্যামিতিতে দক্ষ ছিলেন। তাঁর সাহায্য নিয়েই আইনস্টাইন প্রণয়ন করলেন মহাকর্ষের নতুন তত্ত্ব।

সুইজারল্যান্ডের জুরিখে কর্মরত অবস্থায় ১৯০৫ সালেই তিনি আপেক্ষিকতার বিশেষ সূত্র এবং কোয়ান্টাম বলবিদ্যা নিয়ে কিছু কাজ করেছিলেন, যা তাঁকে পরবর্তীতে ১৯২১ সালে এনে দেয় নোবেল পুরস্কার। জুরিখ থেকে তিনি বার্লিনে আসেন একটি রিসার্চ জব পেয়ে, যে কাজে তাঁর ছাত্র পড়ানোর কোনো দায়িত্ব ছিল না। এতে আইনস্টাইন খুব খুশি হয়ে লরেঞ্জকে চিঠি লিখে তাঁর খুশির কথা জানান। কিন্তু এই খুশির মাঝেই তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে নেমে আসে দুর্যোগ, তাঁর কাজিন এলসার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক গড়ে ওঠায় স্ত্রী মিলেভা তাকে ত্যাগ করে দুই সন্তানসহ জুরিখ ফিরে যান। অবশ্য সাংসারিক ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়ে আইনস্টাইন খুশি মনেই মহাকর্ষ বলের সমস্যা সমাধানে পূর্ণশক্তি নিয়োগ করার সুযোগ পান। এক মাসের মধ্যে ৪টি নিবন্ধ প্রস্তুত করে আইনস্টাইন তার শক্তির চমক দেখান এবং বিজয় খুঁজে পায়।

৬.

আইনস্টাইন অবশ্যই বুঝতে পেরেছিলেন যে, তার মহাকর্ষ তত্ত্ব নিশ্চিতভাবেই সমগ্র মহাবিশ্বের জন্য প্রযোজ্য। তাই ১৯১৭ সালেই তিনি একটি নিবন্ধে সাধারণ আপেক্ষিকতাকে সারা মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেন। পরে এটাই হয়ে দাঁড়ায় আধুনিক মহাবিশ্বতত্ত্ব সম্পর্কে মূল ভিত্তি। কিন্তু এটি করতে গিয়ে আইনস্টাইন বিচলিত হয়ে লক্ষ্য করলেন যে তাঁর মহাবিশ্ব স্থির নয়—হয় তা প্রসারমান, অন্যথায় তা স্থিতিশীল। সে সময়ে সবাই যেহেতু জানতেন যে মহাবিশ্ব স্থির এবং অপরিবর্তনশীল। কাজেই আইনস্টাইন এখানে আনলেন মহাজাগতিক ধ্রুবকের ধারণা। এর মাধ্যমে স্থির মহাবিশ্বের ধারণাটি বজায় রইল। কিন্তু রাশিয়ান আবহাওয়াবিদ ও গণিতবিদ আলেকজান্ডার ফ্রিডম্যান একথা আগেই বলেছিলেন যে মহাবিশ্ব হয় প্রসারমান, না হয় সংকোচনশীল। আইনস্টাইন এমন ধারণা উড়িয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে এডউইন হাবল যখন দূরবিনের মাধ্যমে সরাসরি তা প্রত্যক্ষ করলেন, তখন আইনস্টাইন হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু পরে তার গুরুত্ব নিজেই উপলব্ধি করতে পারলেন। এজন্যই জন হুইলার বলেছিলেন, ‘আইনস্টাইন তাঁর সমীকরণের মাধ্যমেই বিশ শতকের বিজ্ঞানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারটি করেছিলেন—সেটি হচ্ছে মহাবিশ্বের প্রসারণ।’

এখন এই মহাজাগতিক ধ্রুবক অন্যভাবে নতুন করে কাজে লাগছে—এটি এখন ব্যবহৃত হচ্ছে তা ব্যাখ্যা করতে, কেন মহাবিশ্ব আগের চেয়ে দ্রুত গতিতে প্রসারিত হচ্ছে? সাধারণ আপেক্ষিকতা, মহাজাগতিক ধ্রুবক—এগুলো মিলেয়ে মহাবিশ্বের অতীত ইতিহাস ও অনাগত ভবিষ্যৎকে বর্ণনা করতে তা কাজে লাগছে। তবে প্রথম চারটি দশক এটি নিয়ে গণিতবিদেরা যতোটা চর্চা করেছেন, ততোটা চর্চা পদার্থবিদেরা করেননি।

সাধারণ আপেক্ষিকতা পদার্থবিদদের জন্য আবার আগ্রহের বিষয় হয়ে দাঁড়াল ১৯৫৫ সালে আইনস্টাইনের মৃত্যুর পর। এ বিষয়টি নিয়ে গবেষণাকে নেতৃত্ব দেন আইনস্টাইনের এককালীন সহকর্মী জন আর্চিবন্ড হুইলার। তিনি তাঁর ছাত্রদেরকে এ বিষয়ে উৎসাহী করে তোলেন। নিউটনের পদার্থবিদ্যা যে সমস্ত বিষয়গুলোকে ব্যাখ্যা করতে পারছিল না, সেগুলো ব্যাখ্যা করতে আপেক্ষিকতা হয়ে দাঁড়াল অপরিহার্য। এই সঙ্গে নতুন নতুন বেশ কিছু পরীক্ষার সবগুলোতেই আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব ভালোভাবে উৎরে গেছে। পদার্থবিদ উইল তাই সঠিকভাবেই বলেছেন, ‘১০০ বছর আগে শুধু মস্তিষ্কের চিন্তা থেকে জন্ম নেওয়া এই তত্ত্বটি প্রতিটি বাস্তব পরীক্ষাতেই সফলভাবে উৎরে গেছে। এটি সত্যি একটি অবিশ্বাস্য ঘটনা।’ আইনস্টাইন নিজেও একবার এরকমটি বলেছিলেন, এই আবিস্কার সফল হয়েছে একটাই কারণে—ভৌত জগৎ এবং গণিতের মাঝে একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে বলে।

অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় আগে প্রখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী ও আইনস্টাইনের বন্ধু ম্যাক্স বর্ন লিখেছিলেন—‘আইনস্টাইনের আইডিয়াসমূহ ভৌত বিজ্ঞানকে গতিবেগ দিয়েছে, যাতে পুরানো দিনের অচল দার্শনিক মতবাদ থেকে বিজ্ঞান বের হয়ে এসে আমাদের আধুনিক জগতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে দাঁড়িয়েছে।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত চিকিৎসক

সূত্র: আইনস্টাইন: দ্য লাইফ অ্যান্ড টাইমস/ রোনাল্ড ডব্লিউ ক্লার্ক