আদিম যুগে মানুষ কীভাবে আফ্রিকা থেকে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল

ছবি: সংগৃহীত

বিজ্ঞানীরা বলেন, মানুষের আবাস প্রথমে আফ্রিকার দক্ষিণ অংশে সীমাবদ্ধ ছিল। সেখানে লাখখানেক বছর থাকার পর ধীরে ধীরে এশিয়া, উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়াসহ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় তো আর গাড়িঘোড়া ছিল না। হেঁটেই চলতে হতো। কীভাবে এটা সম্ভব হয়েছিল? আর কত দিনইবা লেগেছিল? আফ্রিকা থেকে কেনইবা মানুষ হাঁটা ধরল অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়তে? এসব প্রশ্ন নিয়ে বিজ্ঞানীরা অনেক গবেষণা করেছেন। এখনো করছেন। বিভিন্ন স্থানে মানুষের ফসিল বিশ্লেষণ করে অনেক কিছু জানা সম্ভব হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছাতে শেষ পর্যন্ত প্রায় দুই লাখ বছর লেগেছে। অবশ্য বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত মানুষের দল একটানা কখনো হেঁটে চলেনি। হয়তো সুবিধাজনক কোনো স্থানে কয়েক শ বা কয়েক হাজার বছর থেকে তাদের এক দল আবার স্থানান্তর হতে শুরু করে। হাঁটতে হাঁটতে অন্য কোনো স্থানে গিয়ে হয়তো আবার কয়েক হাজার বছর বসবাস করে। এভাবেই সারা বিশ্বে মানুষ ছড়িয়ে পড়ে। আজ তো বিশ্বের আনাচকানাচে মানুষ পৌঁছে গেছে।

প্রথমে কোন দিকে গেল

ধারণা করা হয়, ৭০ হাজার বছর থেকে ১ লাখ বছর আগে আধুনিক মানুষ আফ্রিকা মহাদেশ থেকে এশিয়া ও ইউরোপের দিকে যাত্রা শুরু করে। ৩৫ হাজার থেকে ৭০ হাজার বছর আগে অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছায়। এ বিষয়ে খান একাডেমির ‘হোমোসেপিয়েনস অ্যান্ড আর্লি হিউম্যান মাইগ্রেশন’-এ বিস্তৃত জানা যাবে।

মানুষ প্রায় ৩০ হাজার বছর আগে রেড সির ওপরের অংশ ঘুরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পৌঁছায়। এরপর এশিয়ার ব্যারিং প্রণালি পার হয়ে চলে যায় উত্তর আমেরিকার দিকে। আবার আরেক দল দক্ষিণ এশিয়া হয়ে অস্ট্রেলিয়ার দিকে যায়। আমেরিকায় পৌঁছানোটা কঠিন ছিল। ধারণা করা হয়, ব্যারিং প্রণালির অংশবিশেষে কোনো এক সময় পানি কম ছিল। সেই সময় হয়তো জমাট বরফে ঢাকা অংশ পার হয়ে মানুষ আমেরিকায় যায়। আবার অস্ট্রেলিয়ায় যাওয়াও কঠিন ছিল। কারও কারও মতে ক্যানু (একধরনের নৌকা) দিয়ে সেটা সম্ভব হয়েছিল। মানুষের কোনো দল কীভাবে বিভিন্ন মহাদেশে গেছে, তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। তবে মোটামুটি বলা যায়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হেঁটেই মানুষ বিভিন্ন মহাদেশে স্থানান্তরিত হয়।

কেন বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ল

এটা একটা বড় প্রশ্ন। বিজ্ঞানীদের ধারণা, মূলত এক স্থানে হাজার হাজার বছর থাকার ফলে খাদ্যসংকট দেখা দিলে স্থানান্তরের বিষয়টি মানুষ চিন্তা করে। অন্য একটি সমস্যা ছিল জলবায়ুর পরিবর্তন। মূলত, এ কারণে অনেক এলাকা বিভিন্ন সময় বরফাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। অথবা দেখা দেয় প্রচণ্ড খরা। গাছপালা মরে যায়। খেয়েপরে বাঁচার মতো অবস্থা থাকে না। তখন এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়ার প্রয়োজন দেখা দেয়।

বিজ্ঞানীরা গবেষণায় জেনেছেন, আদিম যুগে মানুষ ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে বাস করত। এসব দল কমবেশি শ দেড়েক মানুষ নিয়ে গঠিত হতো। এর কারণ হলো, দেখা গেছে প্রয়োজনীয় খাদ্য সংগ্রহ, শিকার করা বা বনের হিংস্র প্রাণীর আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য শ দেড়েক মানুষের দল সবচেয়ে উপযোগী। এটা অভিজ্ঞতা থেকে মানুষ শিখেছে। দলে জনসংখ্যা বেড়ে গেলে আবার দুই দলে বিভক্ত হয়ে আলাদা হয়ে যায়। এ রকম ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত মানুষের দল বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে বিভিন্ন মহাদেশ ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

কত সময় লেগেছে

শুধু হেঁটে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া তো যে-সে কথা নয়। এটা কীভাবে সম্ভব হলো। সে এক বিরাট ইতিহাস। সম্প্রতি কোরা ডাইজেস্ট ওয়েব পেজে এ বিষয়ে জন নারসে চমৎকার একটি বিবরণ দিয়েছেন। তিনি একাধারে প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও চিন্তাবিদ। একটি হিসাব বের করে তিনি দেখিয়েছেন, আফ্রিকা থেকে রেড সি ঘুরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় স্থানান্তর চলেছে প্রায় ৩০ হাজার বছর। মোট পথ পরিভ্রমণ করেছে মাত্র সাড়ে সাত হাজার কিলোমিটার। তাই এক হিসাবে বলা যায়, এই স্থানান্তরের গতি ছিল গড়ে বছরে মাত্র এক কিলোমিটারের চার ভাগের এক ভাগ। অর্থাৎ, ধরুন কারওয়ান বাজার থেকে ফার্মগেট! এই পিঁপড়ার গতিতে মানুষ লাখ লাখ বছর ধরে বৈশ্বিক অভিবাসন করেছে। আসলে মানুষ কিছু দূর যাওয়ার পর সেখানে হয়তো কয়েক শ বছর থেকেছে। তারপর আবার কোনো দুর্যোগের কারণে স্থানান্তরিত হয়েছে।

পরবর্তী স্থানান্তর কোথায়

এটা বিস্ময়কর যে মানুষ লাখ লাখ বছর ধরে হেঁটে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন আমাদের সামনে চ্যালেঞ্জ, যেভাবে বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে চলেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের যে হুমকি সৃষ্টি হয়েছে, এখন মানুষ কোথায় যাবে? আদি যুগে তো মানুষ এক মহাদেশ পার হয়ে অনুকূল কোনো মহাদেশে আস্তানা গেড়েছে। কিন্তু বিশ্বে তো আর কোনো স্থানান্তরের উপায় নেই। অন্য কোনো গ্রহে যাওয়ার সম্ভাবনাও বিজ্ঞানীরা দেখছেন না। এ পৃথিবীতেই আমাদের থাকতে হবে। পৃথিবীকে বাঁচাতে হবে। তাহলেই কেবল মানুষ বাঁচবে।

*লেখক: আব্দুল কাইয়ুম, বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদক ও প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক। [email protected]