এশিয়ার প্রথম নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী

চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রমণ

১৯২১ সাল। প্রথমবার বিদেশ ভ্রমণ করছেন এক বাঙালি প্রফেসর। যাচ্ছেন লন্ডনে। সে সময় আকাশপথে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। দূরযাত্রার একমাত্র উপায় সমুদ্রপথ। তাই যাচ্ছেন জাহাজে চড়েই। জাহাজে যাওয়ার পথে বিশাল সমুদ্রের নীল পানি দেখে অবাক হলেন প্রফেসর। মনে প্রশ্ন জাগল, পানির ঘন নীল রঙের রহস্য কী? নীল রঙের রহস্য ইতিমধ্যে লর্ড র‍্যালেই প্রকাশ করেছেন। পেয়েছেন নোবেল পুরস্কারও। র‍্যালেই প্রথম দেখিয়েছেন, আলোর বিক্ষেপণের কারণে আকাশকে নীল দেখায়। সমুদ্রের নীল রঙের ব্যাপারেও র‍্যালের সহজ–সরল যুক্তি, আকাশের নীল রং প্রতিফলিত হয়ে সমুদ্রের পানিতে পড়ে। তাই সমুদ্রের পানিও নীল দেখায়। এই যুক্তিই বাঙালি অধ্যাপকে কাছে খটকা লাগে। খটকা মাথায় নিয়েই লন্ডনে পৌঁছালেন। লন্ডনে দেখা হলো থমসন, রাদারফোর্ডদের মতো বিজ্ঞানীদের সঙ্গে। কিন্তু র‍্যালের দেওয়া তত্ত্ব এখনো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। সে বছরই সেপ্টেম্বর মাসে লন্ডন থেকে বাড়ির উদ্দেশে জাহাজে উঠবেন অধ্যাপক সাহেব। জাহাজে ওঠার আগে একটি প্রিজম, বর্ণালি এবং বিচ্ছুরণ যন্ত্র কিনে নেন। উদ্দেশ্য জাহাজে বসে পানির নীল রঙের রহস্য খোঁজা। যাওয়ার পথে জাহাজের ডেকে বসেই একটি ছোট পরীক্ষা করলেন। সমুদ্র থেকে কিছু পানি নিয়ে প্রিজমের মাধ্যমে দেখলেন। বাঙালিবাবু তো রীতিমতো অবাক! মাথার ওপর জাহাজের ছাদ। ফলে, নীল আকাশ দেখা যাচ্ছে না। তবু পানি কেন নীল দেখাচ্ছে? এখানে তো আকাশের নীল আলো প্রতিফলিত হতে পারে না। তিনি বুঝতে পারলেন র‍্যালের তত্ত্বে ভুল আছে। নোবলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী র‍্যালের ভুল ধরা সেই অধ্যাপকের নাম চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রমণ। এশিয়ার প্রথম নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী।

র‍্যালে আগেও একটা মজার ভুল করেছেন। সেই ভুলের সঙ্গেও রমণ জড়িত। ১৯০৬ সাল। রমণ এমএ ক্লাসে ভর্তি হয়েছেন পদার্থবিজ্ঞানে। স্পেকট্রোমিটারের সাহায্যে প্রিজমের কোণের পরিমাপ করতে গিয়ে রমণ আলোর কিছু ব্যতিক্রমী বর্ণালি লক্ষ করলেন। এই বর্ণালি সম্পর্কে জানার জন্য বইয়ের খোঁজ করলেন। লাভ হলো না। কোনো বইয়ে এ ব্যাপারে কিছু লেখা নেই। নিজেই লিখলেন একটি প্রবন্ধ। প্রথমে নিজের এক শিক্ষকে দেখালেন। তিনি কোনো পাত্তাই দিলেন না। বাধ্য হয়ে রমণ প্রবন্ধটি পাঠিয়ে দিলেন লন্ডনে ফিলোসফিক্যাল ম্যাগাজিনে। সেটা প্রকাশিত হলে বিজ্ঞানীমহলে বেশ প্রশংসা পান রমণ। এরপর দ্বিতীয় গবেষণা পত্রটিও প্রকাশিত হয়। এই প্রবন্ধ লর্ড র‍্যালের চোখে পড়ে। তিনি ভেবেছিলেন, এত সুন্দর করে যিনি প্রবন্ধটি লিখেছেন, তিনি হয়তো কোনো অধ্যাপক। কিন্তু রমণ যে ১৮ বছরের তরুণ, তা র‍্যালে বুঝতেই পারেননি। তিনি রমণকে চিঠি লিখলেন ‘প্রফেসর রমণ’ সম্বোধন করে। রমণের সুযোগ এল বিদেশে গবেষণা করার। কিন্তু বাদ সাধল রমণের রুগ্‌ণ স্বাস্থ্য। মাদ্রাজের সিভিল সার্জন জানালেন, এ স্বাস্থ্য নিয়ে বিলেতে গিয়ে আবহাওয়ার সঙ্গে তাল মেলাতে পারবেন না। তাই বিলেতে গবেষণা করার সুযোগ হাতছাড়া হলো রমণের।

রমণ ১৮৮৮ সালের ৭ নভেম্বর তামিলনাডুর তিরুচিরাপল্লির কাছে তিরুভানাইকাভাল নামের একটি ছোট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা রামানাথন চন্দ্রশেখর পদার্থবিজ্ঞান ও গণিতের শিক্ষক ছিলেন। মা পার্বতী আম্মাল ছিলেন গৃহিণী। আট ভাইবোনের মধ্যে রমণ দ্বিতীয়। ছোটবেলা থেকেই তিনি পড়ালেখায় ভালো। বাবা বিজ্ঞানের শিক্ষক হওয়ায় শৈশবেই বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত হয় রমণের। ১১ বছর বয়সে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ১৩ বছর বয়সে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে চলে যান মাদ্রাজে প্রেসিডেন্সি কলেজে। সেখানকার কলেজের হোস্টেলেই থাকতেন রমণ। হোস্টেলের পরিবেশ ভালো ছিল না। এক বছরের মাথায় স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। রমণের বাবা তাঁকে দাদা-দাদির কাছে রেখে আসেন। সুস্থ হয়ে ভালোভাবে জোরকদমে শুরু হলো পড়াশোনা। পদার্থবিদ্যা ও ইংরেজিতে লেটার নিয়ে ব্যাচেলর ডিগ্রি লাভ করলেন। পেলেন স্বর্ণপদক। শিক্ষকেরা বিলেতে পড়ার উপদেশ দিলেন। রমণও ঠিক করলেন বিলেতে পড়বেন। কিন্তু এবার বাধা হয়ে দাঁড়াল ভগ্ন স্বাস্থ্য। তাই আবার দেশেই শুরু করলেন পড়ালেখা।

প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে এমএ পাস করলেন। এ বছরেই বিয়ে করলেন ১৩ বছরের লোকসুন্দরীকে। সংসার চালাতে হলে চাকরি করতে হবে। অধ্যাপকেরা সরকারি চাকরি করার উপদেশ দিলেন। কিন্তু প্রথম শ্রেণির চাকরি করতে হলে বিদেশে গিয়ে পড়তে হবে। রমণের পক্ষে বিদেশ যাওয়া সম্ভব নয়। অনেকটা বাধ্য হয়েই সরকারের অর্থ বিভাগের অফিসার হিসেবে যোগ দিলেন। অফিস কলকাতায়।

স্ত্রীকে নিয়ে কলকাতার একটি বাসায় উঠলেন। চাকরি করার পাশাপাশি করেন গবেষণাও। কিন্তু চাকরির কারণে গবেষণায় শতভাগ মনোযোগ দিতে পারছেন না। ১৯১৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান কলেজ চালু হয়। সেখানে পদার্থেবিজ্ঞানে খণ্ডকালীন প্রফেসর হিসেবে রমণকে যোগ দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। কিন্তু প্রফেসর পদের বেতন চাকরির তুলনায় অর্ধেকেরও কম। গবেষণার কথা মাথায় রেখে চাকরি ছেড়ে বিজ্ঞান কলেজে যোগ দিলেন। জীবনের নতুন মোড় নিল। টানা ১০ বছর গবেষণা করেছেন আলোক তরঙ্গ, শব্দ তরঙ্গ, পদার্থের পৃষ্ঠটান ইত্যাদি নিয়ে। ১৯২১ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সেমিনারে অংশ নিতে লন্ডনে যান রমণ। এ ব্যাপারে প্রথমেই বলা হয়েছে। লন্ডন থেকে ফেরার পথে তিনি সমুদ্রের বিভিন্ন গভীরতা থেকে পানি সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন কলকাতায়। গবেষণা করে দেখলেন নোবেলজয়ী র‍্যালের তত্ত্ব ভুল। আলোর বিক্ষিপ্ত কণাগুলো গ্যাসের অণুর ওপর ক্রিয়া করার সময় কোনো শক্তি হারায় না। এ জন্য তাদের বর্ণও পরিবর্তন হয় না। সমুদ্রের পানির নীল রং আকাশের রঙের প্রতিফলন নয়, বরং পানিতে আলোর বিক্ষেপণের কারণেই এটা ঘটে। রমণ গবেষণাটি প্রবন্ধ আকারে লিখে নেচার জার্নালে পাঠিয়ে দেন। সেটা ছাপা হলো। স্বীকৃতিস্বরূপ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এ জন্য তাঁকে ডিএসসি ডিগ্রি প্রদান করে। এর মধ্যে রমণ রয়্যাল সোসাইটির থেকে ফেলোশিপ পেলেন।

১৯২৮ সাল। দিনরাত এক করে গবেষণা শুরু করলেন রমণ। ছাত্রদের সঙ্গে নিয়ে। এ ছাড়া বিশেষভাবে সাহায্য করছেন আশু দে নামের এক ভদ্রলোক। তিনি কোনো দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের উঠানেও যাননি। অবশ্য গবেষণার ক্ষেত্রে রমণেরও কোনো ডিগ্রি ছিল না। ২৮ ফেব্রুয়ারি সকালে সূর্যের আলোয় শুরু হলো পরীক্ষা। হঠাৎ দেখা গেল নির্দিষ্ট আলোক বর্ণালির পাশে আরেকটি ভিন্ন বর্ণের রেখা। এই রেখার নাম দিল ‘রমণ রেখা’। এক মাসের মাথায় গবেষণার ফলাফল প্রবন্ধ আকারে লিখে পাঠানো হলো নেচার জার্নালে। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল রমণের নাম।

১৯২৯ সালে ব্রিটিশ সরকার রমণকে নাইট উপাধি দেয়। ‘রমণ রেখা’ আবিষ্কারের জন্য ১৯৩০ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল দেওয়া হয় তাঁকে। এরপর রমণ আরও অনেক গবেষণা করেছেন। তিন বছরের মধ্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সে যান পরিচালক হয়ে। অবশ্য এ পদের জন্য রাদারফোর্ডকে অনুরোধ করা হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘সি ভি রমণের মতো যোগ্য লোক যেখানে আছে, সেখানে আমি না গেলেও চলবে।’ এরপর প্রতিষ্ঠা করলেন নিজের গবেষণাগার। সেখান থেকে প্রায় ২০০ গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় তাঁর। ১৯৫৪ সালে ভারত সরকার রমণকে ভারতরত্ন উপাধি দেয়। তিন বছর পর পান লেনিন শান্তি পুরস্কার। রমণ ক্রিয়া আবিষ্কারের জন্য ২৮ ফেব্রুয়ারি ভারত বিজ্ঞান দিবস হিসেবে পালন করে।

১৯৭০ সালের ২১ নভেম্বর রমণের মৃত্যু হয়। এই বিজ্ঞানীর প্রতি বিজ্ঞানচিন্তার পক্ষ থেকে রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক: শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ, সরকারী তিতুমীর কলেজ, ঢাকা

সূত্র: ফেমাস সায়েনটিস্ট ডট ওআরজি, উপমহাদেশের ১১ জন পদার্থবিজ্ঞানী

*লেখাটি ২০১৯ সালে বিজ্ঞানচিন্তার নভেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত