করোনার ডেলটা ভেরিয়েন্ট: নিয়ন্ত্রণের উপায়

রাজশাহী, খুলনা প্রভৃতি সীমান্তবর্তী জেলা ও তার পাশের জেলাগুলোতে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ও মৃত্যুহার আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। এক গবেষণায় প্রায় ৬৮ শতাংশ করোনা রোগী ডেলটা ভাইরাসে আক্রান্ত বলে জানা গেছে। এটা করোনার ভারতীয় ধরন হিসেবে পরিচিত। সম্প্রতি আরও বেশি সংক্রামক ডেলটা প্লাস ধরনের নতুন করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। ফলে বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতি ক্রমেই উদ্বেগজনক হয়ে উঠছে।

ভাইরাস ক্রমাগত নিজের রূপান্তর ঘটায়। এটাই হলো নতুন ভেরিয়েন্ট বা ধরন। সাধারণত ভাইরাসের এ ধরনের পরিবর্তন প্রক্রিয়া বেশি সমস্যা সৃষ্টি করে না। কারণ, করোনার ক্ষেত্রে দেখা গেছে পরিবর্তিত নতুন ধরনে মূল ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনে পরিবর্তন হয় না, ফলে নতুন সৃষ্ট অনেক ভেরিয়েন্ট হয়তো সহজে ও বেশি দ্রুত ছড়ায়, বেশি তীব্র হয় কিন্তু এর সংক্রমণ প্রক্রিয়া মূল ভাইরাসের মতোই। টিকা নেওয়া থাকলে দেহের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা এই ভাইরাস চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়। ভাইরাস রোধ সহজ হয়।

কিন্তু করোনাভাইরাসের কিছু ভেরিয়েন্ট, বিশেষত ডেলটা ভেরিয়েন্ট একটু ভিন্ন। খুব সহজে ও দ্রুত তীব্রতর সংক্রমণ ঘটায় তো বটেই, উপরন্তু এই ধরনটির বৈশিষ্ট্য এমন যে এটি দেহে রোগ প্রতিরোধব্যবস্থায় তৈরি অ্যান্টিবডিকেও এড়িয়ে যেতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। তাই ডেলটা ও ডেলটা প্লাস ভেরিয়েন্ট বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে।

ডেলটা ধরনটি রোগীকে খুব দ্রুত কাবু করে ফেলে। তাদের জন্য দ্রুত চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। আক্রান্তদের সংখ্যা এত দ্রুত বাড়তে থাকে যে তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা কঠিন হয়ে ওঠে। হাসপাতালে প্রয়োজনীয় বেড, আইসিইউ, অক্সিজেনের অভাব দেখা দেয়। চিকিৎসার অভাবে অনেক রোগী মৃত্যুবরণ করেন। বাংলাদেশে এখন এই আশঙ্কাজনক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। প্রায় প্রতিদিন সংক্রমণ ও মৃত্যুহার বাড়ছে।

কিন্তু এটা ঠিক যে টিকা নেওয়া থাকলে রোগের তীব্রতা নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ হয়। হয়তো আক্রান্তের হার বাড়বে, কিন্তু সবার জন্য আইসিইউ বা অক্সিজেনের দরকার না-ও হতে পারে। এমনকি মৃত্যুহারও কমবে।

সুতরাং এখন আমাদের দরকার দ্রুত টিকার ব্যবস্থা করা। সরকার চেষ্টা করছে। সবার জন্য টিকা—এটাই এখন আমাদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। ডেলটা বা এ ধরনের মারাত্মক ধরন রোধে টিকার কোনো বিকল্প নেই। এটা অন্যতম একটি শর্ত।

টি–সেলের কার্যকর ভূমিকা
বিজ্ঞান সাময়িকী কসমস-এর অনলাইন সংস্করণে (১৭ জুন ২০২১) প্রকাশিত গুরুত্বপূর্ণ একটি নিবন্ধে করোনাভাইরাসের কোনো ক্ষতিকর ধরন নিষ্ক্রিয় করার ক্ষেত্রে টি–সেলের ভূমিকা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়।

টি-সেল হলো একধরনের শ্বেত রক্তকণিকা (হোয়াইট ব্লাড সেল) যা দেহের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থার অংশ। বোনম্যারো বা অস্থিমজ্জার স্টেম সেল থেকে টি-সেল তৈরি হয়। বাইরের কোনো রোগজীবাণু শরীরে প্রবেশ করলে এরা রোগ প্রতিরোধব্যবস্থাকে গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা দেয়। টিকা দেহে অ্যান্টিবডি তৈরি করে। এই প্রক্রিয়ায় টি-সেলও তৈরি হয়। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঘটলে এরা সঙ্গে সঙ্গে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে এবং ভাইরাস নির্মূল করে। অ্যান্টিবডি করোনাভাইরাসের উপস্থিতি শনাক্ত করতে পারে ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের অস্তিত্ব দেখে। কিন্তু ভাইরাসের কোনো ধরন যদি মূল ভাইরাসের এমন কোনো পরিবর্তন ঘটায় যে অ্যান্টিবডির পক্ষে তাকে সঠিকভাবে শনাক্ত করা কঠিন হয়, তাহলে ভাইরাসটি অ্যান্টিবডি এড়িয়ে দেহে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। বিশেষজ্ঞদের অনেকে আশঙ্কা করেন, করোনার কোনো কোনো ধরন হয়তো করোনার স্পাইক প্রোটিনে সামান্য কিছু পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। অবশ্য বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে এখনো কোনো স্থির সিদ্ধান্তে আসেননি। কিন্তু যদি সে রকম কিছু হয়ে থাকে, তাহলে অ্যান্টিবডির পক্ষে করোনাভাইরাস শনাক্ত করা কঠিন হতে পারে। করোনার ডেলটা ধরনে সে রকম কিছু হয়েছে কি না, সে সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা এখনো নিশ্চিত নয়। কিন্তু তাঁরা বলছেন, যদি করোনার স্পাইক প্রোটিনে সামান্য পরিবর্তন ঘটেও থাকে, তাহলে টি-সেল সেখানে ভূমিকা পালন করতে পারে।

টিকা গ্রহণের ফলে রোগ প্রতিরোধব্যবস্থায় যে টি-সেল সৃষ্টি হয়, বুস্টার ডোজে তার সংখ্যা ও সক্রিয়তা বাড়ে। টি-সেল করোনার স্পাইক প্রোটিনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশকেও চিনে রাখতে পারে। এখানেই টি-সেলের বাড়তি গুরুত্ব। যদি করোনার নতুন কোনো ধরন কোনো কারণে অ্যান্টিবডি এড়িয়ে যায়, তাহলেও টি-সেল করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের অংশ বিশেষ চিহ্নিত করে করোনায় আক্রান্ত দেহকোষগুলো নিষ্ক্রিয় করে এবং করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধ করে। টিকার সুবিধা এখানেই। টিকা শুধু কোভিড-১৯ নিষ্ক্রিয় করে না, এর কোনো ধরনের বিরুদ্ধেও কাজ করে।

খোলামেলা পরিবেশ দরকার
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের কোনো কোনো দেশ বা দেশের কিছু অঞ্চল পরিস্থিতি বিবেচনায় লকডাউন উঠিয়ে নিচ্ছে বা শিথিল করছে। ওই সব দেশের বেশির ভাগ মানুষকে অন্তত এক ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে বলেই ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনছে। আমাদের দেশেও একই পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। টিকা দিতে দেরি হলে অন্তত একটি কাজ আমরা করতে পারি। সব মানুষ যদি বাইরে চলাফেরায় মুখে মাস্ক পরে, আর ঘরে, কাজের ক্ষেত্রে ও বড় বড় শপিং মলে যদি অবাধে আলো-বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে করোনা সংক্রমণ আমরা অনায়াসে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারব। অন্তত হাসপাতালে শয্যা, আইসিইউ বা অক্সিজেন সংকট কমে যাবে। মৃত্যুহারও কমবে। করোনার আমলে অন্তত এসি বন্ধ রাখাই ভালো। ফ্যান চলবে। ঘর যদি কাচে ঘেরা থাকে তাহলে অন্তত বড় বড় কিছু জানালার ব্যবস্থা করে অবাধ বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ব্যবস্থায় হয়তো গরমে কষ্ট হবে, কিন্তু জীবন-জীবিকা দুটিই রক্ষা পাবে। বড় বড় শহরে কাঁচাবাজারগুলো অন্তত খোলা আকাশের নিচে থাকা ভালো। একইভাবে বৃষ্টি না থাকলে খোলা আকাশের নিচে স্কুল–কলেজের কিছু ক্লাসের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তাহলে শিশু-কিশোরদের সংক্রমণের আশঙ্কা অনেকটা কমবে।


আব্দুল কাইুয়ম: মাসিক ম্যাগাজিন বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদক
[email protected]