কোনো টিকা একবার নিলেই চলে আবার কোনো টিকা প্রতিবছর নিতে হয় কেন

করোনার টিকাছবি: রয়টার্স

প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। আমাদের অভিজ্ঞতায়ই দেখছি, হাম বা পোলিও প্রভৃতি ভয়াবহ কিছু রোগ টিকার মাধ্যমে প্রায় নির্মূল করা সম্ভব হয়েছে। বসন্ত তো পুরো নির্মূল। অথচ করোনার টিকা দুবার তো বটেই, এরপর বুস্টার ডোজ নিতে হচ্ছে। এখন অনেকে বলছেন, হয়তো আরেক ডোজ টিকা নিতে হবে। তারপর আরও প্রশ্ন উঠছে। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বলছেন, করোনার টিকা প্রতিবছরই নিতে হবে কি না, তা এখনই বলা সম্ভব নয়। বিভিন্ন ভাইরাস রোধে টিকার ডোজের এই পার্থক্য কেন?

বিষয়টি এখন খুব আলোচিত। দ্য নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় এ বিষয়ে সম্প্রতি বেশ কিছু লেখা ছাপা হয়েছে। ১৫ ফেব্রুয়ারি তাদের বিজ্ঞান ও রোগ প্রতিরোধবিষয়ক প্রতিবেদক জিনা কোলাটা লিখেছেন, কোভিড ধরনের রোগ, বিশেষভাবে কয়েক ধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জা বা ফ্লু গত এক শ-দেড় শ বছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বেশ কয়েকবার ছড়িয়ে পড়েছে। তারপর ধীরে ধীরে চলে গেছে। কিন্তু ২০-৩০ বছর পর আবার ফিরে আসতেও দেখা গেছে। এখন যুক্তরাষ্ট্র ও শীতপ্রধান কিছু দেশে ফ্লু রোধে টিকা প্রতিবছর নিতে হয়। কারণ প্রতিরোধক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে যায়। যুক্তরাজ্যে গবেষণায় দেখা গেছে, সাধারণ ঠান্ডা জ্বর, সর্দি-কাশি ধরনের করোনাভাইরাস হলে সৃষ্ট রোগ প্রতিরোধক্ষমতা প্রায় বছরখানেকের মধ্যে কমে যায়। এখানেই সমস্যা।

ফাইল ছবি

ভাইরাস বিশেষজ্ঞরা বলেন, টিকা নিলে দেহে যে প্রতিরোধব্যবস্থা সৃষ্টি হয়, তা কত দিন কার্যকর থাকবে, তা নির্ভর করে বেশ কয়েকটি বিষয়ের ওপর। যদি ভাইরাস দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে এবং বারবার এর ধরন (ভেরিয়েন্ট) বদলায়, তাহলে দীর্ঘ মেয়াদে কার্যকর টিকা তৈরি কঠিন। কারণ, নতুন নতুন ধরনের কারণে ভাইরাস নতুন কিছু বৈশিষ্ট্য অর্জন করে, যা প্রতিরোধের জন্য আবার নতুন করে প্রতিরোধক্ষমতা সৃষ্টির প্রয়োজন হয়। তবে টিকা নেওয়া থাকলে নতুন ধরনের কোভিডের সংক্রমণ ঘটলেও এর তীব্রতা বেশি হয় না। হয়তো সামান্য কিছু উপসর্গ দেখা দেয়। কিন্তু বেশি বয়সের ব্যক্তি এবং কিডনি, লিভার, উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিস রোগীদের ঝুঁকি বেশি থেকেই যায়। টিকা নেওয়ার পরও এদের অনেকে নতুন ধরনের কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মারাত্মক পরিণতির শিকার হতে পারেন।

আরও পড়ুন

বসন্ত, হাম বা পোলিও রোগের ভাইরাস একই ধরনে (ভেরিয়েন্ট) প্রায় স্থিতিশীল থাকে এবং এর টিকা দেহে দীর্ঘস্থায়ী প্রতিরোধক্ষমতা সৃষ্টি করে। তাই এসব ক্ষেত্রে একবার টিকা নিলে বহু বছর হয়তো আর টিকার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু কোভিডের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, ধরন পরিবর্তিত হয় দ্রুত। ফলে সে অনুযায়ী হয়তো টিকা নিতে হবে অন্তত আরও বেশ কিছুদিন।

কোভিডে সংক্রমিত হলে বা টিকা নিলে দেহে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। পাশাপাশি টিকা বি-সেল এবং টি-সেলকে শক্তিশালী করে। পরবর্তীকালে রোগাক্রান্ত হলে সেই ভাইরাসকে বি-সেল চট করে চিনতে পারে ও দ্রুত প্রতিরোধে সক্রিয় হয়। এগুলো মূলত স্মৃতিধারণে সক্ষম সেল। রোগ প্রতিরোধে অ্যান্টিবডি কোনো সমস্যায় পড়লে টি-সেল এগিয়ে আসে এবং আক্রান্ত ও বিধ্বস্ত দেহকোষগুলোকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে।
বর্তমানে অমিক্রন ধরনের কোভিড দ্রুত সংক্রমণ ঘটাতে সক্ষম। ফলে খুব অল্প সময়ে বেশি মানুষকে আক্রান্ত করছে। যেহেতু এর তীব্রতা কম, তাই অনেকে সামান্য সর্দি-জ্বরের পর পাঁচ-সাত দিনের মধ্যেই সুস্থ হয়ে ওঠেন। এ অবস্থায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, সবাইকে টিকা দেওয়া সম্ভব হলে চলতি ২০২২ সালের মধ্যেই কোভিড নির্মূল হতে পারে। তবে মাস্ক ব্যবহার, জনসমাগম এড়িয়ে চলা, কিছু সময় পরপর সাবানপানি দিয়ে হাত ধোয়াসহ স্বাস্থ্যবিধিগুলো মেনে চলতে হবে। তাহলে হয়তো আর বুস্টার ডোজ নিতে হবে না।

পাশাপাশি মনে রাখতে হবে, শাকসবজি, মাছ-মাংস, ফলমূলসহ পুষ্টিকর খাবার সাধ্য অনুযায়ী খেতে হবে। শারীরিক শ্রম খুব দরকার। যাঁদের অফিসে বসে বসে কাজ করতে হয়, হাঁটা-চলাফেরা প্রায় হয়ই না, তাঁদের নিয়মিত ব্যায়াম করা দরকার। সময়াভাব থাকলে প্রতিদিন ১৫-২০ মিনিটের ব্যায়ামও অনেক সুফল দেয়। কী ব্যায়াম করবেন? খুব সহজ। মিনিট পাঁচেক বুক ভরে শ্বাস নিন ও ধীরে ধীরে শ্বাস ছাড়ুন। পাঁচ মিনিট শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, বিশেষভাবে হাতের কবজি, কনুই, ঘাড়, পায়ের পাতা, হাঁটু, অর্থাৎ সব অস্থিসন্ধি কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করুন। চোখের মণি এদিক-ওদিক ঘোরানোও দরকার। বাকি পাঁচ মিনিট হালকা দৌড়। এটা অভ্যাসে পরিণত করলে সারা বছর শরীর ঠিক রাখা সম্ভব। বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেছেন, ব্যায়ামে শরীরে রক্তসঞ্চালন বাড়ে। ফুসফুসের বায়ুথলিগুলো (আলভিওলি) সক্রিয় থাকে। তাই কোভিড ভাইরাস সহজে ফুসফুসের কোষগুলোকে ঘায়েল করতে পারে না। উপরন্তু মস্তিষ্কে নতুন নতুন নিউরন সংযোগ সৃষ্টি হয়। এর ফলে সব সময় শরীর সতেজ ও সক্রিয় থাকে।

*লেখক: আব্দুল কাইয়ুম, বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদক ও প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক