কোষ যখন সুইসাইড করে

কোষেরও আত্মঘাতী হওয়ার প্রবণতা আছে; প্রয়োজনে এরাও স্বেচ্ছামৃত্যুর পথ বেছে নেয়। কথাটা অদ্ভুত শোনালেও এটা সত্যি। খোদ আমাদের শরীরেই প্রতিদিন মিলিয়ন মিলিয়ন কোষ এভাবে নিজের অস্তিত্ব বিলীন করে দিচ্ছে। কোষ জীবের মূল গাঠনিক উপাদান। ইটের পর ইট গেঁথে যেভাবে দেয়াল ও দালান গড়ে তোলা হয়, ঠিক সেভাবেই কোষের পর কোষ যুক্ত হয়ে বহুকোষী জীবগুলো তাদের স্বাভাবিক আকৃতিপ্রাপ্ত হয়। কোষগুলো একত্রে প্রথমে টিস্যু, এরপর অঙ্গ গঠন করে। সেই অঙ্গগুলোকে যখন একটা বাহ্যিক আকৃতি দিয়ে ঢেকে দেয়া হয় তখন আমরা সেটাকে বলি পূর্ণাঙ্গ দেহ। একটি জীব হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সকল নির্দেশনা থাকে কোষের ভেতরে। ফলে কোষীয় বিকলাঙ্গতা সামগ্রিক জীবের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। অকেজো ও প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোষগুলো দেহের জন্য উপদ্রব ছাড়া কিছুই নয়। সেক্ষেত্রে প্রকৃতি সেই অসুস্থ কোষকে ঝেড়ে ফেলে দেহকে উপদ্রবমুক্ত রাখতে সাহায্য করে।

একটি কোষযন্ত্র যখন অস্বাভাবিক পরিস্থিতির শিকার হয়, তখন আমাদের পক্ষে সেই যান্ত্রিক ত্রুটি মেরামত করার মতো সুযোগ বা ক্ষমতা কোনটাই থাকে না। এ জন্য প্রকৃতি নিজেই নিজের ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করে রেখেছে। এরকমই একটি ব্যবস্থা হচ্ছে কোষীয় সুইসাইড। সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটিকে সুইসাইড বলা হচ্ছে, কেননা এটা মূলত কোষের দিকনির্দেশনাভিত্তিক স্বয়ংক্রিয় মৃত্যু। বিশেষ সময়ে কোষ পরিকল্পনা করে নিয়ন্ত্রিত উপায়ে নিজেকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। বিষয়টি প্রথম জানা যায় ১৯৭২ সালে। কোষের এই স্বেচ্ছামৃত্যুকে কেতাবি ভাষায় বলা হয় অ্যাপোপটোসিস। গ্রীক Apo শব্দের অর্থ 'থেকে' এবং ptosis শব্দের অর্থ 'পতন'। বিজ্ঞানীরা যখন অ্যাপোপটোসিসকে প্রথম ব্যাখ্যা করছিলেন তখন তাঁদের কাছে বিষয়টিকে গাছের পাতা ঝরে পড়বার মতো মনে হয়েছে। দেহ থেকে একটি কোষের বিলুপ্তি যেন গাছ থেকে একটা পাতা ঝরে পড়ার সামিল। মজার বিষয় হচ্ছে গাছের ডাল থেকে পাতা ঝরে পড়বার ব্যাখ্যাও অ্যাপোপটোসিসে আছে।

প্রাণীজগতে কোষের আত্মহনন একটি অতি স্বাভাবিক ঘটনা। সমপূর্ণ ঘটনাটাই যেহেতু দিকনির্দেশনানির্ভর, সেহেতু কোষের সুইসাইড করার পেছনে অবশ্যই কিছু সুনির্দিষ্ট কারণ থাকবে। এই কারণগুলো প্রকাশিত হলেই কেবল কোষ এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারে। নয়ত এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ হবে প্রাণীর জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। কোষীয় সুইসাইডের যেমন কিছু নির্দিষ্ট কারণ রয়েছে, তেমনি এইসব কারণের ভিত্তিতে সুইসাইডেরও রয়েছে কিছু স্বতন্ত্র পদ্ধতি। কোন কোন ক্ষেত্রে কোষীয় মৃত্যুর সংকেত কোষের ভেতর থেকে আসে। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে সংকেত কোষের বাইরে প্রকাশিত হয়। সংকেত যেখান থেকেই আসুক না কেন সকল ক্ষেত্রে কোষের মূল মৃত্যু-প্রক্রিয়া অপরিবর্তিত থাকে। যেমন, কোষ ধ্বংসের সংকেত কোষের মধ্যে কিছু রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটায়। এই রাসায়নিক পরিবর্তন আবার কিছু ধারাবাহিক পর্যায়ের মধ্য দিয়ে যায়। এই ধারাবাহিক পর্যায়গুলোর কোনটা অণুর নিঃসরণ, কোনটা সক্রিয়করণ, আবার কোনটা সংযোজন। এই পর্যায়গুলোই মূলত কোষের প্রত্যাসন্ন মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করে। তবে এজন্য প্রথমে কোষকে সচল রাখতে সহায়ক অণুগুলোকে নিষ্ক্রিয় হওয়া চাই। তা না হলে কোষীয় মৃত্যুর স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়।

ডিঅক্সি-রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড বা ডিএনএ ঘনীভূত হয়ে নিউক্লিয়াস ঝিল্লির কাছাকাছি গিয়ে অবস্থান নেয়। সাইটোপ্লাজমের আকারও কমতে থাকে থাকে। সাইটোপ্লাজমের সর্বত্র ফোসকার মতো বুদবুদ তৈরি হয়।

ডিঅক্সি-রাইবোনিউক্লিয়েজ এনজাইম দ্বারা ডিএনএগুলো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়। একটা সময় সাইটোপ্লাজমের ভাঙন শুরু হয় এবং ছোট ছোট খন্ডে বিভক্ত হয়ে যায়। প্রত্যেকটা খন্ড ঝিল্লি দ্বারা আবৃত থাকে। ফলে কোষের ভেতর থেকে অযাচিত কোন রাসায়নিক উপাদান আন্তঃকোষীয় ফাঁকা স্থানে ছড়াতে পারে না। বিচ্ছিন্ন এই খন্ডগুলোকে বলা হয় অ্যাপোপটটিক বডি।

ধ্বংস হওয়া কোষগুলোর কাছাকাছি থাকা ম্যাক্রোফেইজ নামক এক ধরনের শ্বেত রক্তকণিকাগুলো এসময় সক্রিয় হয়ে ওঠে। এরা কোষের বিচ্ছিন্ন টুকরোগুলোকে গ্রাস করে টিস্যু-অঞ্চলকে আবর্জনামুক্ত রাখতে সাহায্য করে।

কোষ কেন সুইসাইড করে বা কোষের মৃত্যু না হলেই বা ক্ষতি কী? শরীরের স্বাভাবিক কর্মযজ্ঞের জন্য এমন মৃত্যু কি অত্যাবশ্যক? যদি অত্যাবশ্যকই হয়, তবে এই মৃত্যুতে কি দেহে কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে?

এসব প্রশ্নের উত্তর বিজ্ঞানীরা খুব ভালোভাবেই জানতে পেরেছেন। এর উত্তর পেতে হলেস প্রথমেই যে বিষয়টিকে আলোচনায় আনা জরুরি সেটা হচ্ছে ক্যান্সার। অনিয়ন্ত্রিত কোষ বিভাজন ক্যান্সারের একটি পূর্ব শর্ত। সমস্যা হচ্ছে এ ধরনের কোষগুলো যেন বিভাজিত হতে না পারে সেজন্য কোষ বিভাজনের আগে কোষগুলোকে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। সমপূর্ণ সুস্থ-সবল ও স্বাভাবিক কোষগুলোই যেন কেবল বিভাজন প্রক্রিয়ায় ঢুকতে পারে, সেটা নিশ্চিত করাই এই চেকপয়েন্টের কাজ। চেকপয়েন্টে যদি বিভাজনে অক্ষম অস্বাভাবিক রকমের ছোট কোষ বা ক্ষতিগ্রস্ত ডিএনএর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় তবে কোষগুলোকে বিভাজন প্রক্রিয়ার মধ্যে ঢুকতে না দিয়ে সেগুলোকে সুইসাইড করতে বাধ্য করা হয়। এতে অনাকাঙ্ক্ষিত কোষের বৃদ্ধিসংক্রান্ত জটিলতা থেকে মুক্ত হওয়া যায়। সমপূর্ণ এই প্রক্রিয়াটাকে তাদারকি করে P53 নামে একটি জিন। ওই জিনে মিউটেশন অ্যাপোপটোসিসের সংকেত প্রদানে বাধা দেয়। আর তখনই ক্যান্সারের মতো রোগের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। কোষ সুইসাইডের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান প্রাণীর ভ্রুণ অবস্থা। ভ্রুণ অবস্থা থেকে পূর্ণাঙ্গ দেহে পরিণত হওয়ার আগে প্রত্যেক প্রাণীকে কতগুলো পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। পর্যায়ক্রমিক এই পরিবর্তনগুলোর একটি এই কোষীয় সুইসাইড। এর একটি চমত্কার উদাহরণ হতে পারে হাত ও পায়ের আঙুল। আমরা আমাদের হাত ও পায়ের আঙুলগুলোকে যেরূপ একটি অপরটির থেকে পৃথক দেখি, মাতৃগর্ভে বিকাশের প্রাথমিক অবস্থায় তেমনটা ছিল না। আঙুলগুলো মধ্যবর্তী মাংসল পিণ্ড দ্বারা পরস্পরের সঙ্গে লাগানো ছিল। জন্মের আগে এই টিস্যুগুলো অ্যাপোপটোসিসের মাধ্যমে বিলুপ্ত হয়। যেমনটা ব্যাঙাচির লেজের ক্ষেত্রে দেখা যায়। ব্যাঙের জীবনপর্বের প্রথম অংশে লেজ থাকে। পরে কোষীয় আত্মহনন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সেই লেজ বিলুপ্ত হয়।

কোষের এই স্বেচ্ছামৃত্যুর কারণেই দৈহিক বিকাশের একটা পর্যায়ে মস্তিষ্কের অতিরিক্ত স্নায়ু কোষগুলো অপসৃত হয়ে মস্তিষ্ককে ভারমুক্ত হতে সাহায্য করে। একজন ভাস্কর যেমন ভাস্কর্যের বাড়তি অংশগুলো ছেটে ফেলে নিখুঁত একটি আকৃতি ফুটিয়ে তোলেন, ঠিক তেমনি কোষীয় সুইসাইডের মাধ্যমে একটি ভ্রুণ ধীরে ধীরে আমাদের অতি পরিচিত দৈহিক গঠনে পরিণত হয়। জীবাণুর সংক্রমণেও অ্যাপোপটোসিসের ভূমিকা আছে। সংক্রমিত কোষ টিস্যু এবং দেহের অন্যান্য অঙ্গের জন্য হুমকিস্বরূপ। তাই এই কোষগুলোকেও অনেক সময় আত্মহননের পথ বেছে নিতে হয়।

অনেক ভাইরাস আছে যারা কোষের মধ্যে বংশবৃদ্ধির পথ সুগম করার জন্য কোষের নিয়ন্ত্রিত মৃত্যু-প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে। এ জন্য এদেরকে প্রয়োজনীয় প্রোটিন সংশ্লেষ করতে হয় যা কোষের সুইসাইডাল প্রক্রিয়ার সাথে সংঘাতময় সম্পর্ক তৈরি করে। জীবাণু সংক্রমণের সময় শরীরে শ্বেত রক্তকণিকার পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়। এটা শরীর থেকে অণুজীব নির্মুলের একটা প্রচেষ্টা। সংক্রমণ কমে গেলে অতিরিক্ত শ্বেত রক্তকণিকার আর কোন উপযোগিতা থাকে না, সেগুলো তখন দেহের জন্য বোঝা হয়ে ওঠে। তখন এই অতিরিক্ত শ্বেত কণিকাগুলো অ্যাপোপটোসিসের মাধ্যমে অপসারিত হয়। একজন নারীর গর্ভাবস্থার একেবারে অন্তিম পর্যায়ে জরায়ুর ওজন থাকে প্রায় ৯০০ গ্রাম। বাচ্চা প্রসবের ৫ থেকে ৬ সপ্তাহ পর জরায়ু এর স্বাভাবিক ওজন ৬০ গ্রামে চলে আসে। এটার কারণও সেই অ্যাপোপটোসিস।

আমাদের দেহের বিভাজনক্ষম কোষগুলো কোষ বিভাজনের মাধ্যমে কোষের সংখ্যা বৃদ্ধি করে। এদিকে আমাদের দেহ প্রতিনিয়ত কোষের পরিকল্পিত মৃত্যুর মাধ্যমে কোষের সংখ্যা স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করছে। প্রাণীদেহ ছাড়াও উদ্ভিদের জাইলেম এবং ফ্লোয়েম টিস্যুকে কোষমুক্ত করে নলাকার গঠন দানে অ্যাপোপটোসিসের ভূমিকা আছে। আবার উদ্ভিদ অণুজীব দ্বারা আক্রান্ত হলে রোগের বিস্তৃতি রোধে আক্রান্ত অংশের বেশ খানিকটা জায়গাজুড়ে কোষগুলোর পরিকল্পিত মৃত্যু ঘটায়।

অপ্রয়োজনীয় কোষের আত্মহনন বা স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে অ্যাপোপটোসিস বলা হচ্ছে। কোষীয় মৃত্যুর এটাই একমাত্র কৌশল নয়। আরও একভাবে কোষের অবলুপ্তি ঘটে, অ্যাপোপটোসিসের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। এটাকে বলা হয় নেক্রোসিস। অ্যাপোপটোসিসের সাথে নেক্রোসিসের মূল পার্থক্য হচ্ছে- অ্যাপোপটোসিস যেখানে কোষের স্বতঃপ্রণোদিত মৃত্যু, নেক্রোসিসের ক্ষেত্রে সেখানে তুলনামূলক বড় পরিসরে কোষের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু ঘটে। এ কারণে নেক্রোসিসে কোষের মৃত্যুটাও হয় বিশৃঙ্খলভাবে।

নেক্রোসিস হয় দেহে আঘাতজনিত কারণে, জীবাণুর সংক্রমণে, টিস্যুতে রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে অক্সিজেনের অভাবে বা বিষাক্ত বস্তুর সংসপর্শে। এ ক্ষেত্রে কোষীয় উপাদানগুলো টিস্যুর সর্বত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে, অ্যাপোপটোসিসের মতো ঝিল্লিবদ্ধ অবস্থায় থাকে না। অ্যাপোপটোসিসের ন্যায় সাইটোপ্লাজমের এখানে-সেখানে ফোসকার মতো বুদবুদ তৈরি না হয়ে সম্পূর্ণ কোষ ফুলে-ফেঁপে ওঠে এবং একসময় ফেটে যায়। নেক্রোসিসের ফলে টিস্যু সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত অবস্থায় থাকে, আশপাশের কোষগুলো নষ্ট হয় এবং এক সময় প্রদাহ সৃষ্টি করে। এসব কারণে নিয়ন্ত্রণহীন নেক্রোসিসকে বলা হয় কোষের বিশৃঙ্খল ও অপরিচ্ছন্ন মৃত্যু এবং সুনিয়ন্ত্রিত অ্যাপোপটোসিসকে বলা হয় কোষের সুশৃঙ্খল ও পরিচ্ছন্ন মৃত্যু।

লেখক: চিকিৎসক, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ