ক্রিসপার: জীবন বদলের হাতিয়ার

একুশ শতক হবে জীববিজ্ঞানের উত্কর্ষের সময়—এমন আভাস পাওয়া যায় শতকের শুরুতেই। ক্লোনিং থেকে শুরু করে জিএম শস্য—এসব নিয়ে বিজ্ঞানী থেকে বিজ্ঞানসচেতন সাধারণ মানুষ পর্যন্ত সবার উচ্ছ্বসিত বিতর্ক, আশা-হতাশা আলোচনাটা লক্ষণীয় ছিল সর্বত্র। মানব জিনোমের তথ্যও জানা হয়েছিল শতকের শুরুতেই। কিন্তু তারপর মাত্র এক দশকের মধ্যে জিনোম তথ্য উদ্ঘাটনের প্রযুক্তি অচিন্তনীয় গতিতে এগিয়েছে। নেক্সট জেনারেশন সিকোয়েন্সিং প্রযুক্তি জিনোম তথ্য উদ্ঘাটনের বছরের কাজ নামিয়ে এনেছে দিন-সপ্তাহের গণ্ডিতে। কম্পিউটার বিজ্ঞানের কল্যাণে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তথ্য বিশ্লেষণের গতিও হয়েছে দ্রুততর। গত এক দশকে জীববিজ্ঞানকে কাজে লাগানোর জন্য অসংখ্য সফটওয়্যার তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি তথ্য রাখার ডেটাবেইস হয়েছে আরও পরিসর, উন্মুক্ত এবং সহজে ব্যবহারযোগ্য।

জিনোম তথ্য উদঘাটন ও বিশ্লেষণের এই অগ্রগতির সঙ্গে—কীভাবে ব্যবহার করা যায় এ তথ্য—তা স্বাভাবিকভাবেই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা যে প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন, তা পুরো বিশ্বকে নাড়িয়ে দিচ্ছে। জীবনকে ঘিরে যা কিছু ছিল কেবলই কল্পকাহিনির উপাদান, তা এখন সাক্ষাত্ হাতের নাগালে। বিষয়টা এতটাই তাড়াতাড়ি ঘটেছে যে এমনকি এর আবিষ্কারকরাও হিমশিম খাচ্ছেন—কীভাবে নিশ্চিত করবেন এ প্রযুক্তির সুব্যবহার। আক্ষরিক অর্থেই জীবনকে বদলে দেওয়ার এ প্রযুক্তির নাম ক্রিসপার।

ক্রিসপার (CRISPR) শব্দটি Clustered Regularly Interspaced Short Palindromic Repeats-এর সংক্ষিপ্ত প্রকাশ। গত শতকের নব্বইয়ের দশকে ব্যাকটেরিয়াতে এর উপস্থিতি আবিষ্কার করেন স্প্যানিশ বিজ্ঞানী ফ্রানসিসকো মহিকা (Francisco Mojica)। বিশেষত ভাইরাসের আক্রমণের বিরুদ্ধে নিজেদের সুরক্ষিত রাখার জন্য ক্রিসপার কৌশল ব্যবহার করে আদিকোষী ব্যাকটেরিয়া। এর মাধ্যমে একটি আক্রান্ত ব্যাকটেরিয়া আক্রমণকারী ভাইরাস কিংবা প্রতিযোগী অন্য ব্যাকটেরিয়ার ডিএনএকে কেটে অকার্যকর করে ফেলতে পারে।

প্রায় আড়াই দশক আগের ক্রিসপার সম্পর্কিত এ আবিষ্কারকে সম্পূর্ণ নতুন অর্থ দিলেন সাম্প্র্রতিককালের বিজ্ঞানীরা। বিশেষত, ২০১২-২০১৪ সালের মধ্যে বিজ্ঞানীরা ক্রিসপার পদ্ধতির মূলনীতি তথা ডিএনএকে কেটে দেওয়ার এই সামর্থ্যকে নিজেদের ইচ্ছেমতো যেকোনো জীবের ডিএনএতে বিভিন্ন পরিবর্তন আনার পন্থায় উন্নীত করেন। আর এ কাজটির পেছনে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বার্কলি ক্যাম্পাস) এবং এমআইটির ব্রড ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা। তারপর থেকে খুব দ্রুত এ সম্পর্কিত গবেষণা বিস্তৃত হয়ে যায় সারা পৃথিবীর সব শীর্ষ গবেষণাগারে। শুধু ডিএনএকে কেটে অকার্যকর করার জন্যই নয়, বরং ডিএনএতে যেকোনো রকমের পরিবর্তন, পরিমার্জনের জন্যও ক্রিসপার-ভিত্তিক বেশ কয়েকটি কৌশল আবিষ্কার হয়ে গেছে এর মধ্যেই। প্রকৃতিতে বিরাজমান কৌশলকে কীভাবে গবেষণা ও জীবন উন্নয়নের কাজে ব্যবহার করা যায় তারও একটি উত্কৃষ্ট নিদর্শন ক্রিসপার সম্পর্কিত এই নতুন উদ্ভাবন।

সংক্ষেপে শুধু ক্রিসপার হিসেবে পরিচিত হলেও এর পুরো নাম আসলে ‘ক্রিসপার-ক্যাস’ সিস্টেম। ক্যাস৯ (Cas9) হচ্ছে একধরনের এনডোনিউক্লিয়েজ এনজাইম প্রোটিন। অন্য যেকোনো এনডোনিউক্লিয়েজের মতোই ক্যাস৯ ডিএনএকে কেটে দেওয়ার সামর্থ্য রাখে। তবে ক্রিসপার-ক্যাস৯ সিস্টেমের মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর সুনির্দিষ্টতা। অন্যান্য সাধারণ এনডোনিউক্লিয়েজ যেমন যেকোনো জায়গায় ডিএনএকে কেটে দেয়, ক্রিসপার-ক্যাস৯ সেখানে খুবই স্থির উদ্দেশ্যমণ্ডিত। ক্রিসপার-ক্যাস৯-এর যৌথ কর্মযজ্ঞে ক্রিসপার অংশটি মূলত কাজ করে ক্যাস৯ এনজাইমটিকে নির্দিষ্ট জিনের কাছে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার। ক্রিসপার অংশটি গঠিত হয় দুই ধরনের আরএনএর সমন্বয়ে প্রদর্শক (Guide) আরএনএ এবং নির্দেশক (Tracr) আরএনএ। প্রদর্শক আরএনএ কোন জিনের নিউক্লিওটাইড অনুক্রম (Nucleotide sequence)-এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তৈরি করা হয়, যা ঠিক করে দেয় ডিএনএর কোনো জায়গায় ক্যাস৯ কাটবে। অপর দিকে নির্দেশক আরএনএ ক্যাস৯ এনজাইমটিকে সংকেত দেয় মূলত প্রদর্শক আরএনএর সঙ্গে যুক্ত হওয়ার।

ক্রিসপার-ক্যাস৯-এর মাধ্যমে ডিএনএ (বা জিনের) কোনো অংশে এভাবে অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট পরিবর্তন করতে পারার বিষয়টি জীবের জিনোম তথ্য ব্যবহার করার পথে একটি যুগান্তকারী মাইলফলক।

এ কথা বোধ হয় এই লেখার প্রায় সব পাঠকেরই জানা যে জীবের স্বকীয়তা ও জীবনসংক্রান্ত প্রায় সব তথ্য সংরক্ষিত থাকে তাদের ডিএনএতে। ডিএনএর যে নিউক্লিওটাইড অনুক্রম, তাতে যেকোনো রকমের অসংগতির উদ্ভব হলে তা ভয়ানক পরিণতি নিয়ে আসতে পারে জীবনের জন্য, বিশেষত এই অসংগতি যদি হয় ডিএনএর কার্যকর একক (ফাংশনাল ইউনিট) তথা জিনের কোন অংশে।

ক্রিসপার-ক্যাস৯ পদ্ধতির মাধ্যমে জিনের পরিবর্তন বা অনুক্রম সুনির্দিষ্টভাবে পরিবর্তন বা পরিমার্জন করার বিষয়টি অত্যন্ত আশাপ্রদ বিষয়। বিশেষত জিনের অনুক্রম পরিবর্তনের কারণে যেসব রোগ হয় আমাদের, তার স্থায়ী এবং নিশ্চিত চিকিত্সায় এ পদ্ধতির ব্যবহার খুবই সম্ভাবনাময়। বংশগত নানা রোগ থেকে ক্যানসারের মতো জটিল রোগের চিকিত্সায় বড় ধরনের অগ্রগতির সুযোগ সৃষ্টি করেছে ক্রিসপার।

ক্যানসার চিকিত্সায় ক্রিসপার-ক্যাস৯ ব্যবহারের বেশ কয়েকটি ক্ষেত্র আছে। ক্যানসার প্রতিরোধ ও প্রতিকার দুই জায়গাতেই ভূমিকা রাখবে ক্রিসপার। যেসব ক্যানসার কোনো জিনের নির্দিষ্ট পরিবর্তনের কারণে সূচিত হয়, তাদের উপস্থিতি কারও জিনোমে পাওয়া গেলে ক্রিসপার-ক্যাস৯ ব্যবহার করে সেই জিনের পরিমার্জন সম্ভব। বংশগত ভিত্তি আছে এমন সব ক্যানসার বা ক্যানসার-পূর্ব অবস্থার জন্য দায়ী জিনের সংশোধন এখন ক্রিসপার পদ্ধতিতে খুব সফলভাবে করা সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বৃহদান্ত্রের ক্যানসারপূর্ব অবস্থা—ফ্যামিলিয়াল অ্যাডিনোমেটাস পলিপসিস (Familial adenomatous polyposis-FAP) একটি বংশগত রোগ। এর অন্যতম কারণ হিসেবে এপিসি (APC) জিনের মিউটেশনকে (ডিএনএতে যেকোনো অস্বাভাবিক পরিবর্তন) দায়ী ভাবা হয়। অচঈ মিউটেশনকে সংশোধনের সুযোগ আছে ক্রিসপার ব্যবহার করে। একই কথা প্রযোজ্য ব্রেস্ট ক্যানসার কিংবা রেটিনোব্লাস্টোমার ক্ষেত্রেও। ইজঈঅ জিনে মিউটেশন থাকলে ব্রেস্ট ক্যানসারের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়, অন্যদিকে রেটিনোব্লাস্টোমার জন্য দায়ী জই১ জিনের মিউটেশন। এসব জিনকে সংশোধন করে ক্যানসারের ঝুঁকি কমানো যায় কি না, সেটাও গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করছেন বিজ্ঞানীরা।

এখানে মনে রাখা দরকার যে যেসব মিউটেশন কোনো ক্যানসারের ‘কারণ’ হিসেবে কাজ করে কেবল সেগুলোকে এভাবে সংশোধন করে ক্যানসার প্রতিকার সম্ভব। বেশির ভাগ মিউটেশনই কেবল ‘দর্শক’ বা অন্য গুরুত্বপূর্ণ মিউটেশনের ধারাবাহিকতায় আবির্ভূত হয়। এসব মিউটেশন পরিমার্জন করে ক্যানসার চিকিত্সায় কোনো ইতিবাচক ফল পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। বর্তমান সময়ে ক্যানসার চিকিত্সার সবচেয়ে সম্ভাবনাময় উপায় হিসেবে দেখা হয় ইমিউনোথেরাপিকে। এর মাধ্যমে আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধকারী কোষ, বিশেষত টি-সেল (T-Cell)-কে ক্যানসার কোষ চিহ্নিত ও ধ্বংস করার জন্য বিশেষভাবে উপযোগী করে তোলা হয়। ক্রিসপার পদ্ধতিতে এভাবে যদি টি-সেলের কোনো বিশেষ জিন বা জিনগুচ্ছকে পরিমার্জন করে আরও বেশি সক্ষম ও শক্তিশালী করা যায়, তাহলে তা ক্যানসার চিকিত্সায় এক যুগান্তকারী অগ্রগতির সূচনা করবে।

ছবি: বিজ্ঞানচিন্তা

ক্রিসপার পদ্ধতিতে কোনো জিনকে সংশোধন করে লাভ হবে কি না, সেটা নির্ভর করে জিনটির গুরুত্ব বা ভূমিকার ওপর। ক্রিসপার একটি হাতিয়ারমাত্র। এখানে একটি বিষয় বলে রাখা দরকার যে ক্রিসপার-ক্যাস৯-এর আগেও বিজ্ঞানীরা নিউক্লিয়েজ ব্যবহার করে ডিএনএ অনুক্রম পরিবর্তন করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন, যা ব্যবহারও হয়েছে বহুলভাবে। টালেন (Transcription Activator-Like Effector Nucleases-TALENs) এবং জিঙ্ক ফিঙ্গার নিউক্লিয়েস (Zinc-finger Nucleases-ZFNs) এ রকম দুটো জনপ্রিয় পদ্ধতি, যা ক্রিসপারের আগে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু এই কৌশলগুলোর তুলনায় ক্রিসপারের খরচ অনেক কম, ব্যবহার করা সহজ এবং যেমনটি আগে বলা হলো, অনেক সুনির্দিষ্ট।

জিনোম তথ্য পরিমার্জনের বিষয়টি আগে যেমনটি ছিল কেবলই বনেদি গবেষণাগারগুলোর ব্যয়সাপেক্ষ গবেষণার বিষয়, ক্রিসপার তা এখন সাধারণ পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে। ক্রিসপার নিয়ে বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানসচেতন মানুষের সম্ভাবনা ও শঙ্কার জায়গাটিও ওখানেই। জিনোম সিকোয়েন্সিং প্রযুক্তির ব্যাপক অগ্রগতির পাশাপাশি জিনোম পরিমার্জনের এই সহজলভ্যতা এখন আমরা কীভাবে ব্যবহার করি সেটাই নির্ধারণ করবে জিনোম তথ্যের খোলা পটে অঙ্কিত ভবিষ্যত্।

লেখক: পিএইচডি গবেষক, ক্যানসার অ্যান্ড ইমিউনোজেনেটিকস ল্যাব, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রভাষক, জিন প্রকৌশল ও জীবপ্রযুক্তি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

  • লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার মার্চ সংখ্যায় প্রকাশিত