চাঁদের বুকে পৃথিবীর অক্সিজেন

চাঁদ থেকে তোলা পৃথিবীর ছবিনাসা

চাঁদ। পৃথিবীর একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহ। পৃথিবীর মতো এর কোনো বায়ুমণ্ডল নেই বলেই জানি আমরা। একেবারে নেই বলা অবশ্য ভুল। চাঁদের পুরো বায়ুমণ্ডলের মোট ভর যোগ করলে ১০ মেট্রিক টনের সামান্য কম হয়। পরিমাণটা যদি আপনার বেশি মনে হয়ে থাকে, তবে একটি তথ্য জেনে নিশ্চয়ই চমকে যাবেন। চাঁদের বায়ুমণ্ডলের এটুকু পদার্থের চাপ পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলীয় চাপের তুলনায় ১০ কোটি কোটি গুণ (১ এর পরে ১৫টি শূন্য) কম। চাঁদের এই সামান্য বায়ুর উপস্থিতির পেছনেও দায়ী সূর্য। সৌরবায়ুর প্রভাবে চাঁদের পৃষ্ঠের বিভিন্ন পদার্থের খাঁজে লুকিয়ে থাকা, জমে থাকা ও শোষিত গ্যাস বের হয়ে এসে উত্পন্ন হয় এই বায়ু।

২০১৭ সালের ৩১ জানুয়ারি নেচার অ্যাস্ট্রোনমি জার্নালে প্রকাশিত এক নিবন্ধে জানা গেছে, একই সৌরবায়ুর প্রভাবে পৃথিবীর কিছু অক্সিজেনও চলে যাচ্ছে চাঁদে এবং সম্ভবত সেটি ঘটছে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের সৃষ্টির পর থেকেই। সেটা কয়েক শ কোটি বছর আগের কথা।

বিজ্ঞানীরা দেখলেন, প্রায় প্রতি মাসে একবার ঘটছে এটি। আমরা জানি, চাঁদ পৃথিবীর চারদিকে উপবৃত্তাকার কক্ষপথে ঘুরছে। এ প্রদক্ষিণের সময় চাঁদ পাঁচ দিনের মতো অবস্থান করে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ম্যাগনেটোস্ফিয়ার অঞ্চলে। পৃথিবীর বাসযোগ্যতার পেছনে ম্যাগনেটোস্ফিয়ারের গুরুত্ব খুব বেশি। এ অঞ্চল পৃথিবীকে সূর্য ও মহাকাশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা ক্ষতিকর বিকিরণ থেকে সুরক্ষা দেয়। তবে এ অঞ্চলের সৃষ্টির পেছনে ভূমিকা রাখে পৃথিবীর অভ্যন্তরভাগে পরিচালিত কিছু প্রক্রিয়া। ভূপৃষ্ঠের গভীরের বহিঃস্থ কেন্দ্রমণ্ডলে গলিত লোহার পরিচলন গতি থেকে তৈরি হয় ম্যাগনেটোস্ফিয়ারের চৌম্বকক্ষেত্র।

পৃথিবীর যে পাশে দিন থাকে সে পাশে ম্যাগনেটোস্ফিয়ারের বিস্তৃতি থাকে পৃথিবীর ব্যাসার্ধের ৬ থেকে ১০ গুণ। তবে পৃথিবীর যে পাশে রাত সে পাশে সৌর বিকিরণের অনুপস্থিতিতে সেটা পৌঁছে যায় চাঁদের কক্ষপথ থেকেও বহু দূর। পৃথিবীর ব্যাসার্ধের কয়েক শ গুণ পর্যন্ত।

মাঝে মাঝে চাঁদ এ অঞ্চল পাড়ি দেওয়ার সময় অবস্থান করে পৃথিবীর পেছনে, সূর্য থেকে উল্টো দিকে। সে জন্য এ সময় এটি নিজে সরাসরি সৌরবায়ুর প্রবাহ থেকে মুক্ত থাকে। কিন্তু পৃথিবী থেকে নির্গত পদার্থের প্রবাহ ঠিকই এর দিকে যেতে থাকে। বিজ্ঞানীরা আগেই জেনেছেন, নাইট্রোজেনসহ কিছু গ্যাস চাঁদের দিকে চলে যাচ্ছে। তবে অক্সিজেন চলে যাওয়ার প্রমাণ এবারই প্রথম।

জাপানের ওসাকা ইউনিভার্সিটির জ্যোতিঃপদার্থবিদ কেন্তারো তেরাদা বলেন, ‘আমাদের প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, পৃথিবী ও চাঁদ শুধু একই সঙ্গে সৃষ্টিই হয়নি, এই দুটোর রাসায়নিক প্রক্রিয়াগুলোও চলেছে সমান্তরালে।’

প্রাপ্ত নতুন এই তথ্যের মাধ্যমে চাঁদের পাথরের রাসায়নিক উপাদান সম্পর্কে দীর্ঘদিনের একটি রহস্যের সমাধান হতে পারে। চাঁদের চারপাশে কিন্তু পৃথিবীর মতো কোনো চৌম্বকক্ষেত্র নেই। ফলে সূর্য থেকে আসা উচ্চ আধানগ্রস্ত কণিকা দ্বারা এটি সরাসরি আঘাতপ্রাপ্ত হয়। ফলে আগে মনে করা হতো, চাঁদের উন্মুক্ত পৃষ্ঠ থেকে সংগৃহীত নমুনার সঙ্গে সৌরবায়ুর রাসায়নিক উপাদানের মিল থাকবে। ২০০৬ সালে চাঁদের পাথরের নমুনা পরীক্ষা করে দেখা গেল, অক্সিজেনের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। অর্থাত্ চাঁদের পৃষ্ঠের অক্সিজেনে অন্য কোনো উেসরও ভূমিকা আছে। এবার সে উেসর সন্ধান পাওয়া গেল।

এ তথ্য সংগৃহিত হয়েছিল জাপানের সেলিনি (স্থানীয় নাম কাগুইয়া) চন্দ্রযানের মাধ্যমে। ২০০৭ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে যানটি চাঁদকে ঘিরে প্রদক্ষিণ করে নেমে যায় চাঁদের বুকে। কক্ষপথে থাকার সময় এটি চাঁদের বায়ুমণ্ডলে উচ্চমাত্রার ধনাত্মক চার্জধারী অক্সিজেন অণু আবিষ্কার করে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, অক্সিজেনের মাত্রা সব সময় এক রকম ছিল না। চান্দ্রমাসের ২৭ দিনের মধ্যে শুধু ৫ দিন দেখা যাচ্ছিল এই রাসায়নিক উপাদান। পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, এই ৫ দিন সময়ে চাঁদ থাকে সূর্য থেকে পৃথিবীর উল্টো দিকে। সুরক্ষা পায় পৃথিবীর ম্যাগনেটোস্ফিয়ার অঞ্চলের মাধ্যমে। আগেই বলেছি, সৌরঝড় থেকে বাঁচার জন্য চাঁদের নিজস্ব কোনো চৌম্বকক্ষেত্র নেই।

পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের আকৃতি গোলাকার নয়, বরং গড়িয়ে পড়া অশ্রুর মতো
নাসা

ছবিতে দেখা যাচ্ছে, সুরক্ষাদানকারী চৌম্বকক্ষেত্রের আকৃতি গোলাকার নয়। বরং গড়িয়ে পড়া অশ্রুর মতো। এই অংশ সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে, লম্বা লেজ ছড়িয়ে থাকে পৃথিবীর উল্টো দিকে। এর নাম ম্যাগনেটোটেইল বা চৌম্বক লেজ। ম্যাগনেটোস্ফিয়ারের মধ্যে থাকা সবকিছু সূর্যের বিকিরণ থেকে সুরক্ষা পায়। কিন্তু বিকিরণের ধাক্কায় পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল থেকে কিছু কণা বেরিয়ে পড়ে। চলে আসে চৌম্বক লেজের প্লাজমা শিট নামের অঞ্চলে। তেরাদার মতে, খুব সম্ভবত বেরিয়ে পড়া এই অক্সিজেনের কিছু অংশ চাঁদে আশ্রয় নেয়, আর কিছু অংশ চলে যায় আন্তনাক্ষত্রিক জগতে।

লেখক: শিক্ষার্থী, পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: সায়েন্স অ্যালার্ট ডটকম, নাসা হেলিওফিজিক্স, উইকিপিডিয়া